কুমিল্লায় ছুটির বিকেলে তিন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্রের মহড়া, ককটেলের শব্দে আতঙ্ক
Published: 25th, April 2025 GMT
কুমিল্লা নগরে কাছাকাছি সময়ে তিনটি এলাকায় দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় একটি এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শোনা গেছে। এ ঘটনায় আজ শুক্রবার ছুটির দিনের পুরো বিকেল নগরবাসীর কেটেছে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। প্রকাশ্যে কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্রের মহড়া দেখে সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রানীর দিঘির পাড়, তালপুকুরপাড় ও আদালতপাড়া এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপের সদস্যরা মহড়া দেয়। বিকেলে নগরের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অস্ত্রের মহড়ার কারণে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রানীর দিঘির পাড়ে অবস্থিত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখায় কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুক্রবার রাতে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের মহড়ার খবর পেয়ে এরই মধ্যে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে নেমেছে। এখন পর্যন্ত দেশীয় অস্ত্রসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন।
ওসি বলেন, ‘বিগত সময়ে ধারাবাহিকভাবে অভিযানের কারণে কিশোর গ্যাং প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে নতুন করে তারা মাথাচাড়া দিতে চাইছে। আজকে কাছাকাছি সময়ে বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের মহড়ায় সেটিই মনে হচ্ছে।’
আরও পড়ুনকুমিল্লায় আবার বেপরোয়া ‘কিশোর গ্যাং’, ছোটদের হাতে ঘটছে বড় অপরাধ০৫ জানুয়ারি ২০২৫প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন জানান, শুক্রবার বিকেলে নগরের কান্দিরপাড় এলাকা পার হয়ে রানীর দিঘির দক্ষিণ পাড়ে শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়েছে। তাদের মহড়ার সামনে অন্তত ১৫ মোটর সাইকেল বিকট আওয়াজ তুলে সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অভিভাবকেরা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাইরে রানীর দিঘির পাড়ে অবস্থান করছিলেন। কয়েক শ অভিভাবক চরমভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বিকেল চারটায় পরীক্ষা শুরুর আগমুহূর্তে অস্ত্রের মহড়া দেওয়ায় পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও কিশোর গ্যাং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বারান্দায় গিয়ে দেখি তারা দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছে। তাদের হাতে ছেনি, রামদা, চাপাতি, হকিস্টিক, রডসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। এ সময় কয়েকটি ককটেলও বিস্ফোরণ ঘটলে গোটা এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েশাহনাজ আক্তার, ভাড়াটিয়া, তালপুকুরপাড় এলাকা, কুমিল্লাচাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থেকে মেয়েকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই কিশোর-তরুণেরা যখন অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়ে যাচ্ছিল, তখন মনে হয় প্রাণটা সঙ্গে ছিল না। বারবারই মনে হচ্ছিল এই বুঝি কুপিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে। এমন অবস্থার সম্মুখীন আর জীবনেও হইনি। কতটা আতঙ্কে ছিলাম বলে শেষ করতে পারব না। এই অবস্থা হলে কীভাবে চলবে?’
নোয়াখালীর মাইজদী থেকে ছেলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য আসা আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি দেখে আমরা আতঙ্কিত। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হলেও ছেলেকে ভর্তি করাব কি না, সেটিও এখন চিন্তা করতে হবে। এভাবে তারা প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দিল। তাদের মধ্যে ন্যূনতম কোনো ভয় দেখলাম না।’
নগরের তালপুকুরপাড় এলাকার একটি বাসার ভাড়াটে শাহনাজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাসা ৫ তলায়। কিশোর গ্যাংয়ের চিৎকার শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখি তারা দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছে। তাদের হাতে ছেনি, রামদা, চাপাতি, হকিস্টিক, রডসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। এ সময় কয়েকটি ককটেলও বিস্ফোরণ ঘটলে গোটা এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।’
প্রায় একইভাবে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে নগরের আদালতপাড়া এলাকায় কিশোর গ্যাং মহড়া দিয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান স্থানীয় বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে কিশোর গ্যাং অতীতের চেয়ে এখন বেশি বেপরোয়া। তাদের অস্ত্রের মহড়ার কারণে মুহূর্তের মধ্যেই পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।’
এর আগে গত ৩ জানুয়ারি বিকেলে নগরের কান্দিরপাড় এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজ–সংলগ্ন রানীর দিঘির পাড়ে অস্ত্রের মহড়া দেয় কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধশতাধিক সদস্য। এ সময় ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটানো হয়। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কুমিল্লা নগরে কমপক্ষে ১৫টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে। ২০১৭ সালের পর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের হাতে আট বছরে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে এসব গ্যাং।
আরও পড়ুনকুমিল্লায় প্রকাশ্যে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ অস্ত্রের মহড়া, ককটেল বিস্ফোরণ০৩ জানুয়ারি ২০২৫আরও পড়ুনকুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের দেশি অস্ত্রের মহড়া, ককটেল বিস্ফোরণ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক শ ক রব র পর ক ষ র এল ক য় ক এ সময় ক র মহড় র এল ক র সদস য অবস থ ককট ল
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।