প্রায় দুই বছর আগে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের সঙ্গে জেলার ওসমানীনগর উপজেলা অংশে শুরু হয় বেশ কয়েকটি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ। অবস্থান ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে কয়েকটি স্থানে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলেও প্রকল্পে পরিবর্তন আনা হয়নি। এতে করে সরকারের অর্থ অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে মঙ্গলের চেয়ে দুর্ভোগের আশঙ্কা বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ছয় লেন মহাসড়কের কাজ শুরুর সময় ওই সড়কে ২৩ কিলোমিটার অংশের বিভিন্ন স্থানে নিষ্কাশিত পানির প্রবাহ ছিল। সড়ক-সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ফসলি জমি থেকে এই পানির নিষ্কাশন ও প্রবাহ থাকায় তা অব্যাহত রাখার কথা মাথায় রেখে 
করা হয় প্রকল্প পরিকল্পনা। তাই সেসব স্থানে ছোট ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সড়কের এই অংশে অন্তত ২৪টি এমন প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান।
সংশ্লিষ্ট এলাকার এমন বেশ কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, আগে নালা হয়ে পানি প্রবাহিত হতো বলে সেখানে সেতু বা কালভার্ট স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। সম্প্রতি এসব নালার মধ্যে বেশির ভাগ বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করায় বদলে গেছে সেখানকার অবস্থা। নালা না থাকলেও পূর্বনির্ধারিত স্থানেই প্রকল্প বাস্তবায়নে অনড় কর্তৃপক্ষ। শেরপুর থেকে নাজিরবাজার পর্যন্ত ওসমানীনগর সীমানায় মহাসড়কের প্রায় ২৩ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। উল্লিখিত অংশে এখন পর্যন্ত ২৪টি ব্রিজ ও কালভার্টের আংশিক কাজ দৃশ্যমান। আগে যেসব জায়গায় সেতু-কালভার্ট ছিল এখনও সেখানেই করা হচ্ছে। 
দক্ষিণ গোয়ালাবাজারে একটি কালভার্টের আংশিক কাজ করা হয়েছে। এই কালভার্টের এক প্রান্তে রয়েছে সরকারি কৃষি অফিসসহ জনবসতি। অপর প্রান্তে মার্কেট। এর আশপাশে কোথাও কোনো পানির নালা নেই, যেদিক দিয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। এমন অবস্থাতেও সেখানেই কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দয়ামীর ইউনিয়নের মডেল ফিলিং স্টেশনের মাঝখানে নির্মাণাধীন আরও একটি কালভার্টের পূর্ব পাশের সীমানায় রয়েছে বিশাল প্রাচীর। এর আশপাশে পানির কোনো নালা বা প্রবাহ নেই। সেখানেও কালভার্টের কাজ দৃশ্যমান। স্থানীয়রা বলছেন, একসময় এখানে সড়কের এক পাশ থেকে অন্য পাশে পানির প্রবাহ থাকায় কালভার্ট করা হয়। বর্তমানে অনেক স্থানে সেটির প্রয়োজন না থাকলেও চলমান প্রকল্পের আওতায় কালভার্ট নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল সংশ্লিষ্টরা।
কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন হাওরের পানি মহাসড়কের পূর্ব দিকে প্রবেশের কারণে বন্যার সময় পানির স্তর অনেক উঁচুতে থাকলেও পশ্চিম দিকের পানির স্তর নিচে। বিশেষ করে নাটকিলা, কাগজপুরের খাল, নিরাইয়া বিল, বুড়ি নদীর খালসহ বিভিন্ন খালের ওপর নির্মিত সেতু ও কালভার্ট দিয়ে পূর্ব দিকের পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এসব এলাকার খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ঠিকমতো নামতে পারছে না। তাতে বন্যার সময় দীর্ঘ হচ্ছে জলাবদ্ধতা সমস্যা। এর মধ্যে ভরাট হওয়া স্থানেই নতুন করে সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ স্থাপনা হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে কম উচ্চতায়। এমন অবস্থায় বন্যার সময় ভোগান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 
ওসমানীনগর উপজেলার শেরপুর থেকে নাজিরবাজার অংশ ঘুরে দেখা যায়, এই অংশে ২৪টি সেতু ও কালভার্টের আংশিক কাজ করা হয়েছে। গোয়ালাবাজারের দক্ষিণ গোয়ালাবাজার এলাকায় নির্মিত কালভার্টটি কোনো কাজে আসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তা খালি চোখে দেখেই বলে দেওয়া যায়। দত্তগ্রাম ও ব্রাহ্মণগ্রাম এলাকার নির্মিত দুটি কালভার্টের আশপাশে মানববসতি ও রাস্তাঘাট রয়েছে।
প্রথমপাশা এলাকায় সড়কের দুই পাশে দুটি বিল থাকলেও নির্মাণ করা হচ্ছে সরু কালভার্ট। এক সময়ের খরস্রোতা নাটকিলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার পরেও সেখানকার মাটির গভীরতা যাচাই ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে একটি ব্রিজ। বেগমপুর এলাকায় একটি সরু কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। যার আশপাশে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
তাজপুর থেকে দয়ামীর ইউনিয়ন সীমা পর্যন্ত ১৩টি কালভার্ট তৈরির কাজ চলছে। এর মাঝে দয়ামীর ইউনিয়নের সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানায় রয়েছে ১১টি কালভার্ট। তাজপুরের ছিলমানপুর এলাকায় নির্মিত হচ্ছে একটি। কাশিকাপন এলাকায় ডাবল বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও এর গভীরতা একেবারেই কম। দয়ামীরের চকবাজার এলাকায় নির্মিত একটি কালভার্টের উভয় পাশেই রয়েছে বাসাবাড়ি ও সীমানাপ্রাচীর। এ ছাড়া দয়ামীর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি কালভার্টের একপাশে কৃষিজমি থাকলেও অন্যপাশে রয়েছে মানুষের বসতঘর, পুকুরসহ অন্যান্য স্থাপনা। 
উপজেলার সচেতন মহলের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত বিশিষ্ট লেখক হাই মশাহিদ বলেন, চলমান প্রকল্পটি অপরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে। এর কারণে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে। জনগণের কাজেও  আসবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্প পরিকল্পনা পরিমার্জন করা গেলে ইতিবাচক হতো। প্রকল্পাধীন সেতু ও কালভার্ট উঁচু এলাকায় স্থাপন করা হচ্ছে। এতে করে এগুলো যে পানি নিষ্কাশনের কাজে আসবে না তা বলাই যায়।
দয়ামীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি এস টি এম ফখর উদ্দিন বলেন, দৃশ্যমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনায় কালভার্ট তৈরি হচ্ছে না। অধিকাংশ কালভার্ট কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া কালভার্টের যে গভীরতা দেওয়া হচ্ছে তা খুবই কম। বন্যার সময় এলাকাবাসী ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার উপজেলা পরিষদের সভায় কথা বলেও সাড়া মেলেনি। 
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন জানান, প্রকল্পটি তাদের নয়। এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারবেন 
না। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রজেক্টের 
সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ভালো জানেন। পরিকল্পনা পরিবর্তনে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে মন্তব্য করেননি এই কর্মকর্তা
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শেখ মাহমুদ মুরাদ বলেন, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন। চলতি বছরের মধ্যে মহাসড়কের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করার কথাও জানান তিনি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের সিলেট অংশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেবাশিস রায় বলেন, কালভার্টগুলো পরিকল্পনা করেই তৈরি করা হচ্ছে। যেসব স্থানে এগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো আগেই নির্ধারিত। জমি অধিগ্রহণ করে পানি নিষ্কাশনের পথ করা হবে। দ্রুততম সময়ে জমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করা গেলে প্রকল্পের গতি বাড়বে। ২০২৮ সালের মধ্যে মহাসড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প বন য র সময় ন র ম ণ কর প রকল প ব প রকল প র র এল ক য় র আশপ শ প রব হ থ কল ও অবস থ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।

মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।

তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত। 

এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।

বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।

আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ