ঠাকুরগাঁওয়ে দলের পাশাপাশি ভোটের মাঠও গোছাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত
Published: 27th, April 2025 GMT
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা আত্মগোপনে। দলের ন্যূনতম তৎপরতাও নেই। অন্যদিকে জেলা বিএনপির কার্যালয়টিতে এখন আর লোক ধরে না। কিছুদিন আগেও যেসব নেতা-কর্মী নানা ঝামেলা এড়াতে দলের কর্মসূচি থেকে দূরে থাকতেন, কার্যালয়টি এখন তাঁদের আনাগোনায় জমজমাট।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জামায়াত প্রকাশ্যে দলের কর্মকাণ্ড চালাতে না পারলেও এখন দলটির নেতা-কর্মীরা সরব। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জেলার রাজনীতিতে সক্রিয় আছে। শহরে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের কখনো দেখা মিললেও দলটির কর্মকাণ্ড নেই। বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) দেখা মিললেও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডও নেই।
সব মিলিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলার রাজনীতির মাঠে এখন বিএনপি আর জামায়াত বেশ সক্রিয়। দল দুটি সংগঠনকে গোছানোর পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের মাঠও গোছাচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী আসনে এখন বেশ সক্রিয়। সুযোগ পেলেই জনসংযোগের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। বার্তা দিচ্ছেন ঐক্য আর শান্তির। আবার কেউ কেউ দিয়ে যাচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতিও।
জমজমাট বিএনপি কার্যালয়
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঠাকুরগাঁওয়ে শতাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছিল বিএনপির সাত হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে। কারাভোগ করতে হয়েছে অসংখ্য নেতা-কর্মীকে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে দলের কর্মসূচি থেকে অনেক নেতা-কর্মী নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। কিন্তু এখন সেই দিন পাল্টেছে। গত বছরের ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দলীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ায় পর সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এখন সেই কার্যালয় ঘিরে দিনরাত চলে নেতা-কর্মীদের আড্ডা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও। এ জেলায় বিএনপির কর্মকাণ্ড তাঁর নির্দেশনাতেই পরিচালিত হয়। নানা কর্মসূচিতে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা চাঙা হলেও বিএনপির জেলা ও উপজেলার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ রয়ে গেছে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর সবশেষ ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সম্মেলন হয়েছিল। দুই বছর পরপর সম্মেলন আয়োজনের কথা থাকলেও কয়েক দফা তারিখ ঘোষণা করেও জেলা সম্মেলন করতে পারেনি দলটি। বিএনপির সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দল ও ছাত্রদল মাঠে সক্রিয় থাকলেও সংগঠন দুটি চলছে পুরোনো কমিটি নিয়ে।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল হামিদ বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের মামলা-হামলা ও নির্যাতন উপেক্ষা করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে ছিলেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঝে প্রাণ ফিরে এসেছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সল আমীন বলেন, ‘আগামী মাসের মাঝামাঝিতে জেলার সম্মেলন আয়োজন করা হবে। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী যেসব সংগঠন মেয়াদোত্তীর্ণ, তা ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। দলকে নির্বাচনমুখীও করা হচ্ছে।’
উচ্ছ্বসিত জামায়াতের নেতা-কর্মীরা
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঠাকুরগাঁওয়ে প্রকাশ্যে সংগঠনের কর্মকাণ্ড চালাতে পারেনি জামায়াত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নির্বিঘ্নে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে পেরে উচ্ছ্বসিত নেতা-কর্মীরা। দলটি তৃণমূলে সভা-সমাবেশ করছে। নেতারা ধর্মীয় ও সামাজিক নানা আয়োজনে যোগ দিয়ে জনগণের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে কাজ করছেন।
জামায়াতের প্রতিটি ইউনিয়ন, পৌরসভা, থানা ও জেলা কমিটি হালনাগাদ আছে। জেলা জামায়াতের আমির বেলাল উদ্দিন প্রধান বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময়ে সাংগঠনিক কাজ প্রকাশ্যে করতে না পারলেও আমরা চালিয়ে গেছি। দলের কার্যালয় বন্ধ থাকলেও এলাকার বাড়িতে বাড়িতে জামায়াতের কার্যালয় গড়ে উঠেছিল। এখন সেই বাধা নেই। কর্মী-সমর্থকেরাও সাংগঠনিক কাজ নিয়ে সক্রিয় আছেন।’
আত্মগোপনে আওয়ামী লীগের নেতারা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ঠাকুরগাঁও শহরের জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কার্যালয়ও। গ্রেপ্তার এড়াতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা আত্মগোপনে আছেন। জেলায় আওয়ামী লীগের ৮৭১ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে ১৮টি মামলা হয়েছে। সেসব মামলায় ১ হাজার ৬৩০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে।
এনসিপিসহ অন্য দলের অবস্থা
এনসিপি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সদস্য সংগ্রহে কাজ চললেও তা দৃশ্যমান নয়। আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টির কোনো কর্মসূচি দৃশ্যমান নয়। তবে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় নানা ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণ অধিকার পরিষদের তৎপরতা চোখে পড়ছে। এর বাইরে বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) তৎপরতা দেখা গেছে।
যোগাযোগ করলে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক গোলাম মর্তুজা সেলিম বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এখনো কমিটি করা হয়নি। দলের সদস্য সংগ্রহের কাজ চলছে।
সংসদীয় আসনভিত্তিক তৎপরতা
ঠাকুরগাঁও জেলায় তিনটি সংসদীয় আসন আছে। সদর উপজেলা নিয়ে ঠাকুরগাঁও-১, বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার দুটি ইউনিয়ন নিয়ে ঠাকুরগাঁও-২ আসন। আর রানীশংকৈল ও পীরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ঠাকুরগাঁও-৩ আসন।
ঠাকুরগাঁও-১ আসনে ১৯৮৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০টি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সাতবার, বিএনপি দুইবার ও জাতীয় পার্টি একবার জয়ী হয়েছে। জেলা বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হবেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁকে ঘিরে দলের নেতা-কর্মীরা এলাকার গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক করে যাচ্ছেন। জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পয়গাম আলী বলেন, ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের অভিভাবক। এই আসনে তাঁর কোনো বিকল্প নেই।’
এই আসনে জামায়াত কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ মহানগরীর সহ-সেক্রেটারি দেলাওয়ার হোসেনের নাম ঘোষণা করেছে। তিনি এখন সামাজিক ও ধর্মীয় নানা আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন।
ঠাকুরগাঁও-২ আসনে গত ১০টি সংসদ নির্বাচনের আটটিতে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তার জোটের শরিকেরা। এই আসনে প্রার্থী হিসেবে জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আবদুল হাকিমের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত। তিনি তৃণমূলে গণসংযোগ করছেন।
এই আসনে কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য জুলফিকার মর্তুজা চৌধুরী, ড্যাবের সাবেক মহাসচিব আবদুস সালাম, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক টি এম মাহবুবর রহমান, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ফয়জুল ইসলাম মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা-কর্মী। তবে এই আসনে বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সল আমীনকে দলের প্রার্থী হিসেবে দাবি করছেন।
এই আসনে গণ অধিকার পরিষদ থেকে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির মুখপাত্র ফারুক হোসেন। তিনি এলাকায় গণসংযোগ করছেন।
ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে গত ১০টি সংসদ নির্বাচনের ৪টিতে জয়ী হয়েছিল জাতীয় পার্টি, দুইবার করে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিএনপি। এই আসনে পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল ইসলাম, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ওবায়দুল্লাহ মাসুদ, যুবদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল আনোয়ার আহাম্মদ, রানীশংকৈল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আল্লামা আল ওয়াদুদ বিন নুর আলিফের নাম আলোচনায় আছে।
এ আসনে জামায়াত দলটির রানীশংকৈল উপজেলার আমির মিজানুর রহমানের নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিনি দলীয় বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
সিপিবির পীরগঞ্জ উপজেলার সভাপতি প্রভাত সমির শাহাজান আলম, গণ অধিকার পরিষদ ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক গোলাম মর্তুজা সেলিম ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই আসন থেকে ১৯৮৮, ২০০১, ২০০৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। প্রার্থী হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেক বয়স হয়েছে। এখন আর নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাচ্ছি না।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপজ ল র ল ইসল ম সরক র র ন দলট র হয় ছ ল ঠ ক রগ কর ম র দল র ক করছ ন স গঠন এখন স আওয় ম সদস য এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে
দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।
বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’
কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি।
এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়।
মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন।
বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।
শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ
রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে।
প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।