যেদিকে তাকাই, শুধু অবিশ্বাস: ভারতের বিভিন্ন শহরে ভয়ে ঘরবন্দী কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা
Published: 27th, April 2025 GMT
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধরের সরু ও লোকজনে ঠাসা গলিপথ ধরে হাঁটছিলেন আসিফ দার (নামের প্রথম অংশ পরিবর্তিত)। হঠাৎই তাঁর মনে হলো সব চোখ যেন তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। সে তাকানোটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না।
আসিফ বলেন, ‘আমার মনে হলো ভিড়ের মধ্যে থাকা প্রত্যেকের চোখে যেন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।’
আসিফ ও তাঁর এক বন্ধু একটি এটিএম বুথের সামনে দাঁড়ানোর পর দুই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তাঁদের কাছে এসে পরিচয় জানতে চান। তাঁরা ভয় পেয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালান।
ঘটনাটি ২২ এপ্রিলের। ওই দিনই (গত মঙ্গলবার) বিকেলে কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে বন্দুকধারীর হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হন। আহত হন বেশ কয়েকজন।
কাশ্মীরের ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ে হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর মধ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত কাশ্মীরিরা বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা কট্টর ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোর হয়রানি ও হুমকি-ধমকির শিকার হচ্ছেন। এমনকি সহপাঠীদের হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন তাঁরা।পরদিন ২৩ এপ্রিল বুধবার সকালে দুধ কেনার জন্য আবারও বাড়ি থেকে বের হন আসিফ। তিনি বলেন, ‘তিনজন আমাকে দেখে ইসলামবিদ্বেষী কথাবার্তা ও গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। তাঁদের একজন চিৎকার করে বললেন, “ও কাশ্মীরি, সবকিছু ওদের কারণেই হয়েছে।”’
পেহেলগামে হামলার জন্য ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে দায়ী করা হয়। তবে হামলার কিছু সময় পর দায় স্বীকার করেছে স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাকামী অখ্যাত সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। এ ঘটনায় ভারতের ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন আরও উন্মোচিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, গতকাল শুক্রবার বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি ওই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে এবং আগের দাবির জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেছে।
কাশ্মীরের ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ে হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর মধ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত কাশ্মীরিরা বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা কট্টর ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোর হয়রানি ও হুমকি-ধমকির শিকার হচ্ছেন। এমনকি সহপাঠীদের হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন তাঁরা।
কে না কে হামলা চালিয়েছে, আর সে জন্য আমাদের মূল্য চুকাতে হচ্ছে।আসিফ দার, কাশ্মীরি শিক্ষার্থীউত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশ—দেশজুড়ে বিভিন্ন বাড়ির মালিকেরা কাশ্মীরি ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য করছেন। দোকানিরা কাশ্মীরের মানুষদের সঙ্গে লেনদেন করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। বাড়িতে ফেরার জন্য চেষ্টারত বেশ কয়েকজন কাশ্মীরি শিক্ষার্থীকে বিমানবন্দরেই ঘুমাতে হচ্ছে।
আসিফ বলেন, ‘কে না কে হামলা চালিয়েছে, আর সে জন্য আমাদের মূল্য চুকাতে হচ্ছে।’
‘যেদিকেই তাকাই, শুধু অবিশ্বাস’
কাশ্মীর—একটি বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ড। ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই এর অংশবিশেষ শাসন করে। তবে উভয় দেশ এর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা দাবি করে থাকে।
পেহেলগামের ভয়ানক হামলার পর ভারত দাবি করেছে, পাকিস্তান ‘পরোক্ষভাবে’ এর সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা শুধু কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদকে নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে। তাদের দাবি, পাকিস্তানের জড়িত থাকার ব্যাপারে ভারত এখনো কোনো প্রমাণ হাজির করেনি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক মারাত্মক রকমের খারাপ হয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। দুই দেশই পরস্পরের নাগরিকদের বহিষ্কার করছে, একে অপরের রাজধানী থেকে কূটনৈতিক কর্মীর সংখ্যা কমাচ্ছে।
মঙ্গলবারের হামলার পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কাশ্মীরিরা অন্যদের ক্ষুব্ধ আচরণের শিকার হচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কাশ্মীরি আল–জাজিরাকে বলেছেন, ভারতের অন্তত সাতটি শহরে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ঘরবন্দী করে রেখেছেন। এমনকি অনলাইনে অর্ডার বা ক্যাব বুকিং দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন; যেন কারও সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না হয়।
পেহেলগামে হামলার পর সতর্ক পাহারায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র হয়র ন ক র কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।