সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে দলটি প্রথম ১৮ মাসের মধ্যে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে। দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারে নিয়োজিত করাই হবে যেকোনো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ হিসাবে বিএনপি একটি সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।

দেশের ১০ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ১৯। আর দুই–তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স ১৮ থেকে ৬০। এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অবহেলাই করা হয়েছে বিগত সরকারের সময়। কর্মসংস্থানমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা না করে বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় খরচ বাড়িয়ে লুটপাটের পথ তৈরি করা হয়েছিল। গত বছরের জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক কিছুই নতুন করে শুরু করার আলাপ–আলোচনা চলছে। নতুন পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে আমাদের।

অনেকেই বিএনপির এসব পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষী বলছেন। প্রশ্ন করছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব কি না। বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, যা প্রায় আমাদের এক বছরের বর্তমান বাজেটের কাছাকাছি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এখনো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, এ বিষয়টি স্বীকার করতেই হবে।

এ অবস্থায় বিএনপির বিভিন্ন প্রস্তাব আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়টি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করার আগে আমাদের মনে করতে হবে কৃষি খাত ছাড়া ঘন শ্রমভিত্তিক শ্রম সংস্থানের দুটি খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প ও বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আসার পর এই তিনটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। খাল খনন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তেল, সার সহজলভ্য করা হয়। কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন ও কারিগরি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

ওই সময় দেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিকাশ ঘটতে শুরু করে সরকারের সহজ নীতির কারণে। নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সারা দেশে কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ শুরু করে। সরকারের উন্নয়নবান্ধব নীতি–কৌশলের কারণেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বিকাশ শুরু হয় এবং গ্রামীণ জীবনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পরিবার পরিকল্পনার প্রতি গ্রামীণ মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে এই দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নতুন করে গতির সঞ্চার করবে, এমন আশা করার কারণ রয়েছে।  

জিয়াউর রহমানের আমলে দুটি উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প স্থাপন ও বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি শুরু করা। এই দুটি খাতে ধীরে ধীরে বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রমের সংস্থান হতে শুরু করে। বিপুলভাবে এই দুটি খাতের বিকাশ ঘটে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর।

খালেদা জিয়া যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশে সচল পোশাকশিল্পের সংখ্যা ছিল ২৫০টির মতো। কিন্তু ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া দায়িত্ব ছাড়ার সময় দেশে সচল পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের মতো। এই হিসাব পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি বিজেএমইএর ওয়েবসাইটেই দেওয়া আছে। ওই সময় সরকার আমদানি ও রপ্তানি নীতি সহজ করে দেওয়ার কারণে পোশাক রপ্তানির কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছিল এই পোশাক খাতে।

সার্বিকভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪-৫ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে তা ছিল ৬ শতাংশ।

বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশের উন্নয়ন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত শ্রমকে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া। এতে করে নতুন নতুন মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, মানুষজন এক শ্রমবাজার থেকে আরেক শ্রমবাজারে প্রবেশও করেছে। যেমন পোশাকশিল্পের বিকাশের কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ শ্রমবাজার থেকে মানুষজন পোশাক কারখানার শহরের দিকে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শহুরে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ শুরু হয়। যার সরাসরি প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায়।

এই হচ্ছে বিএনপির অতীত সাফল্যের উদাহরণ। এবার দেখা যাক বিএনপি ভবিষ্যতের জন্য কী ভাবছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারের নিয়োজিত করার কী পরিকল্পনা করছে।  

সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি, বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি, সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।

প্রযুক্তি খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের জন্য স্টার্টআপ এক্সিলারেটর ও ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করার পরিকল্পনা বিএনপির রয়েছে। এই খাতে দুই লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে বিএনপি মনে করছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নতুন করে তিন লাখ মানুষের কর্মের সংস্থান করতে চায় বিএনপি। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান করবে বিএনপি সরকারে গেলে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে অধিকতর পরিবেশবান্ধব করে এই খাতে তিন লাখ নতুন চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। খুচরা ব্যবসা ও সেবা খাতে ১১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে। এই সময়ে মানসম্পন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা দিয়ে ১৫ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠাবে দলটির সরকার।

দেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে ৫ লাখ মানুষকে এই খাতে নিয়োজিত করতে চায় দলটি। কৃষিতে উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত, সরবরাহশিল্পের শিল্পের নবতর বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে নতুন করে কৃষি খাতে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

সব থেকে বেশি কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে শিল্প খাতে। করছাড়, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শিল্প খাতে নতুন করে গতি সঞ্চার করতে চায় বিএনপি। এই খাতে সব থেকে বেশি, মানে, ২১ লাখ শ্রমিকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় দলটি।  

বিএনপির পরিকল্পনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা যায় যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের থমকে যাওয়া উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে চায় দলটি। এতে জনগণের চাহিদা অনুসারে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ।

বিএনপির এই পরিকল্পনা মোটেও উচ্চাভিলাষী বা রাজনীতির কথার কথা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের পরিকল্পনা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য খুবই জরুরি। শুধু বিএনপিই নয়, অন্যান্য দলেরও এ ধরনের পরিকল্পনা থাকা জরুরি। বিএনপিই এসব পরিকল্পনা প্রকাশ করে অন্যদের থেকে এগিয়ে গেল। রাজনীতিতে নানা কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক থাকবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রতিটি দলেরই নিজস্ব দার্শনিক ভিত্তি থাকতে হবে, যাতে জনসাধারণ বুঝতে পারবে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে এই দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নতুন করে গতির সঞ্চার করবে, এমন আশা করার কারণ রয়েছে।  

ড.

মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ রমব জ র সরক র র ব এনপ র কর র ক র জন য এই খ ত র জন ত আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

মবকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে একে উসকে দেওয়া হয়েছে

আমাদের সমাজে মব সহিংসতা (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) কেন ঘটছে? অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের ইতিহাসে আগেও মব সহিংসতার ঘটনাগুলো ছিল। তবে এখন এটা চরম আকার ধারণ করেছে। নানা আকারে হচ্ছে। কারণগুলো বিস্তৃত। সাধারণভাবে আপনি-আমিও কোনো অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারি। কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত দেখলে সোচ্চার হতে পারি। ওই ব্যক্তিদের পুলিশের হাতে আমরা তুলে দিতে পারি। অপরাধ প্রমাণিত হলে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করবে, পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাধারণ জনগণ হিসেবে পুলিশে সোপর্দ করার দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। তার মানে এই নয় যে যাকে অপরাধী মনে করা হচ্ছে, তাকে গণপিটুনি দেওয়া যাবে, হেনস্তা করা যাবে, নির্যাতন করা যাবে। অথচ এই জিনিসটাই করতে দেখা যাচ্ছে। আপনি একটা মানুষকে গণপিটুনি দিতে পারেন না। আর এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন আইনি অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে অপরাধী বা আসামিও বলা যাবে না। আমাদের সংবিধান, ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধি—কোনো আইনে আপনাকে মব সৃষ্টি করে কারও বিচার করার অধিকার দেওয়া নেই। মবের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বরং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যতগুলো মব সৃষ্টি করা হয়েছে, ততবার বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এটা কোনো নাগরিকের কাম্য নয়। এটা একধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ির সামনে বসে মব তৈরি করতে দেখা গেছে। বাসার ভেতরে গিয়ে মব তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন অফিসে হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে দেখেছি। সবার আগে স্কুল-কলেজে শুরু হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক বা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বা প্রভাবশালী কাউকে হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছিল, এটা মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা মনে করেছেন, এটা মব না, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে মবের ঘটনাকে অস্বীকার করে মবকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। মবের মাধ্যমে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। মানুষ ভাবছে, বিচারব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আমি ছেড়ে দিলে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ওই ব্যক্তি (যাকে অপরাধী ভাবা হচ্ছে) বের হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, শাস্তি হবে না। যেটা করার আমাদেরই করতে হবে। আমাদেরই বিচার করতে হবে। মানুষ মনে করছে, বৈষম্য হচ্ছে। মানসিক হতাশা থেকে মানুষ রাস্তায় নামছে। মবের ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান ও মানসিক হতাশা প্রকাশ করতে চায়। মবের কোনো ঘটনার বিচার হতে দেখা যাচ্ছে না। কোনোটার বিচার দৃশ্যমান না। সে জন্য আরও বেশি ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও ভঙ্গুর দশায়।

মব সহিংসতার কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেকগুলো রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত। সেগুলোকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাসায় ঢুকে ডাকাতি করা হয়েছে। দোকান লুটপাট করা হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল নিষ্ক্রিয় পর্যায়ে। পুলিশ নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দু–একটা ঘটনায় পুলিশ নিজেও মবের শিকার হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, ৪৭৭ জন পুলিশ মবের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার মব সহিংসতার বিরুদ্ধে। অনেক সময় কোনো অপরাধের অভিযোগে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে এলে মব সৃষ্টি করা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কেউ যখন দেখেন অপরাধ করলেও তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে, তখন ওই ব্যক্তি অপরাধ করতে আর ভয় পান না। শাস্তির ভয় থাকে না বলে অপরাধ করতে থাকেন।

আরও পড়ুন‘পানিও দিতে দেয় নাই’, মব তৈরি করে হত্যায় আসামি গ্রেপ্তার মাত্র ১.২৭%১১ ঘণ্টা আগে

মব সহিংসতা বন্ধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। মব সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারকে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। মব সহিংসতার ঘটনাগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মবের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে সরকার নির্দেশনা দিলে এবং সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নিলে মব সহিংসতা কমবে।

রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের কর্মকাণ্ড মানুষ দেখছে। সামনে নির্বাচন। সব দলকে সাধারণ মানুষ পর্যবেক্ষণ করছে। কে কী ধরনের আচরণ করছেন, তা দেখা হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের মব সহিংসতার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়ানো উচিত নয়। কোনো বড় রাজনৈতিক দল যদি ঘোষণা দেয় যে আজ থেকে তারা মবের সঙ্গে থাকবে না। তাহলে তৃণমূলের একজন কর্মী তাঁর পদ হারানোর ভয়ে ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মব সহিংসতায় জড়ানোর আগে দুবার চিন্তা করবেন।

আরও পড়ুনগাইবান্ধায় চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা০২ নভেম্বর ২০২৫

বিচারপ্রক্রিয়ার ত্রুটি দূর করতে হবে। থিওরি (তত্ত্ব) বলে, মানুষ যখন দেখে সে কোনোভাবে সমাজে তার ক্ষমতার চর্চা করতে পারছে না। পাশাপাশি দেখে যে একজন অপরাধী দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো সাজার সম্মুখীন হচ্ছে না। তখন মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিচারে গলদ থেকে গেলে মব সহিংসতা ঠেকানো যাবে না।

গণমাধ্যম মব সহিংসতার বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম মব সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব সহজভাবে বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝাতে পারে। বিষয়গুলোকে আলোচনায় আনতে হবে। সহজভাবে বোঝালে মানুষ তা গ্রহণ করবে।

আরও পড়ুনরূপলাল-প্রদীপকে হত্যায় অংশ নেয় যারা, কী বলছে পরিবার১৯ আগস্ট ২০২৫

আমি নারী হিসেবে বলব, ধর্ষক আমার কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধী। তারপরও বলব, ভুক্তভোগীর মতো ধর্ষকেরও আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। জনগণকে মব সহিংসতাবিরোধী অবস্থানে আসতে হবে। যেকোনো কিছু হলে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যেন মব সহিংসতা করা না হয়। সব বিষয়ে জেনে–বুঝে সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সমাজে মব সহিংসতা ঘটবে না।

শাহারিয়া আফরিন,
সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনপুরান ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড: নিরাপত্তাহীনতায় লাল চাঁদের পরিবার, বাড়িতে মাতম১২ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ