ভবিষ্যৎ দেশ চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপি কী বলছে
Published: 28th, April 2025 GMT
সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে দলটি প্রথম ১৮ মাসের মধ্যে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে। দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারে নিয়োজিত করাই হবে যেকোনো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ হিসাবে বিএনপি একটি সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।
দেশের ১০ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ১৯। আর দুই–তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স ১৮ থেকে ৬০। এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অবহেলাই করা হয়েছে বিগত সরকারের সময়। কর্মসংস্থানমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা না করে বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় খরচ বাড়িয়ে লুটপাটের পথ তৈরি করা হয়েছিল। গত বছরের জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক কিছুই নতুন করে শুরু করার আলাপ–আলোচনা চলছে। নতুন পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে আমাদের।
অনেকেই বিএনপির এসব পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষী বলছেন। প্রশ্ন করছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব কি না। বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, যা প্রায় আমাদের এক বছরের বর্তমান বাজেটের কাছাকাছি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এখনো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, এ বিষয়টি স্বীকার করতেই হবে।
এ অবস্থায় বিএনপির বিভিন্ন প্রস্তাব আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়টি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করার আগে আমাদের মনে করতে হবে কৃষি খাত ছাড়া ঘন শ্রমভিত্তিক শ্রম সংস্থানের দুটি খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প ও বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আসার পর এই তিনটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। খাল খনন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তেল, সার সহজলভ্য করা হয়। কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন ও কারিগরি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
ওই সময় দেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিকাশ ঘটতে শুরু করে সরকারের সহজ নীতির কারণে। নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সারা দেশে কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ শুরু করে। সরকারের উন্নয়নবান্ধব নীতি–কৌশলের কারণেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বিকাশ শুরু হয় এবং গ্রামীণ জীবনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পরিবার পরিকল্পনার প্রতি গ্রামীণ মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে এই দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নতুন করে গতির সঞ্চার করবে, এমন আশা করার কারণ রয়েছে।জিয়াউর রহমানের আমলে দুটি উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প স্থাপন ও বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি শুরু করা। এই দুটি খাতে ধীরে ধীরে বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রমের সংস্থান হতে শুরু করে। বিপুলভাবে এই দুটি খাতের বিকাশ ঘটে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর।
খালেদা জিয়া যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশে সচল পোশাকশিল্পের সংখ্যা ছিল ২৫০টির মতো। কিন্তু ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া দায়িত্ব ছাড়ার সময় দেশে সচল পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের মতো। এই হিসাব পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি বিজেএমইএর ওয়েবসাইটেই দেওয়া আছে। ওই সময় সরকার আমদানি ও রপ্তানি নীতি সহজ করে দেওয়ার কারণে পোশাক রপ্তানির কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছিল এই পোশাক খাতে।
সার্বিকভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪-৫ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে তা ছিল ৬ শতাংশ।
বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশের উন্নয়ন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত শ্রমকে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া। এতে করে নতুন নতুন মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, মানুষজন এক শ্রমবাজার থেকে আরেক শ্রমবাজারে প্রবেশও করেছে। যেমন পোশাকশিল্পের বিকাশের কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ শ্রমবাজার থেকে মানুষজন পোশাক কারখানার শহরের দিকে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শহুরে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ শুরু হয়। যার সরাসরি প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায়।
এই হচ্ছে বিএনপির অতীত সাফল্যের উদাহরণ। এবার দেখা যাক বিএনপি ভবিষ্যতের জন্য কী ভাবছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারের নিয়োজিত করার কী পরিকল্পনা করছে।
সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি, বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি, সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।
প্রযুক্তি খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের জন্য স্টার্টআপ এক্সিলারেটর ও ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করার পরিকল্পনা বিএনপির রয়েছে। এই খাতে দুই লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে বিএনপি মনে করছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নতুন করে তিন লাখ মানুষের কর্মের সংস্থান করতে চায় বিএনপি। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান করবে বিএনপি সরকারে গেলে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে অধিকতর পরিবেশবান্ধব করে এই খাতে তিন লাখ নতুন চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। খুচরা ব্যবসা ও সেবা খাতে ১১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে। এই সময়ে মানসম্পন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা দিয়ে ১৫ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠাবে দলটির সরকার।
দেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে ৫ লাখ মানুষকে এই খাতে নিয়োজিত করতে চায় দলটি। কৃষিতে উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত, সরবরাহশিল্পের শিল্পের নবতর বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে নতুন করে কৃষি খাতে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
সব থেকে বেশি কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে শিল্প খাতে। করছাড়, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শিল্প খাতে নতুন করে গতি সঞ্চার করতে চায় বিএনপি। এই খাতে সব থেকে বেশি, মানে, ২১ লাখ শ্রমিকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় দলটি।
বিএনপির পরিকল্পনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা যায় যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের থমকে যাওয়া উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে চায় দলটি। এতে জনগণের চাহিদা অনুসারে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ।
বিএনপির এই পরিকল্পনা মোটেও উচ্চাভিলাষী বা রাজনীতির কথার কথা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের পরিকল্পনা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য খুবই জরুরি। শুধু বিএনপিই নয়, অন্যান্য দলেরও এ ধরনের পরিকল্পনা থাকা জরুরি। বিএনপিই এসব পরিকল্পনা প্রকাশ করে অন্যদের থেকে এগিয়ে গেল। রাজনীতিতে নানা কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক থাকবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রতিটি দলেরই নিজস্ব দার্শনিক ভিত্তি থাকতে হবে, যাতে জনসাধারণ বুঝতে পারবে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে এই দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নতুন করে গতির সঞ্চার করবে, এমন আশা করার কারণ রয়েছে।
ড.
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ রমব জ র সরক র র ব এনপ র কর র ক র জন য এই খ ত র জন ত আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব’
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ২০ মিনিট। মাথার ওপর প্রখর রোদের উত্তাপ। প্রচণ্ড গরমে ত্রাহি অবস্থায় একটু বিশ্রাম নিতে গাছের ছায়ার খোঁজে ক্লান্ত পথিক। এমন সময় ঘর্মাক্ত শরীরে একটি ভবন নির্মাণের কাজ করতে দেখা গেল কয়েকজন শ্রমিককে। তাদের একজন তোঁতা মিয়া, অপরজন হাবিবুল।
হাবিবুল পাথর ভরেই যাচ্ছেন, তোঁতা মিয়া সেগুলো মাথায় করে একের পর এক টুড়ি ছাদ ঢালাইয়ের জন্য পৌঁছে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট স্থানে। সেখানেও বালু-পাথরের মিশ্রণ করছেন আরও কয়েকজন। তাদের কর্মযজ্ঞের এক ফাঁকে কথা হয় তোঁতা মিয়ার সঙ্গে।
আলাপকালে তোঁতা মিয়া বলেন, ‘সারাদিন কাম (কাজ) কইরা ৫০০ ট্যাহা (টাকা) হাজিরা পাই। এইডি দিয়া কোনোমতে বউ-পুলাপান নিয়া দিন পার করতাছি। মে দিবস-টিবস কী কইতারতাম না। আমরার মতো গরিব মানুষ কাম না করলে পেডে ভাত জুটতো না এইডাই কইতারবাম।’
গতকাল বুধবার ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ করার সময় এসব কথা বলেন তোঁতা মিয়া (৪৫)। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া এলাকায়। এ সময় কথা হয় আরেক নির্মাণ শ্রমিক একাদুল মিয়ার সঙ্গে। একাদুলও জানেন না মে দিবস কী। তিনি বলেন, ‘এই কাম কইরা খাইয়া-না খাইয়া বউ-পুলাপান লইয়া কোনোরহমে দিন পার করতাছি। বর্তমান বাজারো জিনিসপাতির দাম বাড়লেও আমরার মজুরি বাড়ে না। পাঁচ বছর আগেও যা পাইতাম, অহনও তাই পাই।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক ট্যাহা সঞ্চয় করবাম এই বাও (উপায়) নাই। অসুখ অইয়া চার দিন ঘরে পইড়া থাকলে না খাইয়া থাহন লাগব। আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব?’
আজ বৃহস্পতিবার মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এই দিনটি সারাবিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় নানা আয়োজনে। কিন্তু যাদের অধিকার আদায়ের জন্য এ দিনটি পালন করা হয়– তারাই জানেন না দিবসটি সম্পর্কে। তাদের আরেকজন দিনমজুর রাজন মিয়া। রাজন জানান, এসব দিবসে তাদের মতো গরিব মানুষের কোনো লাভ-লোকসান নেই।