ইথিওপিয়া হিজরত মক্কার নিপীড়িত জীবনে নবিজির (সা.) একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হলে যখন নির্যাতনের মাত্রা তীব্র হলো, নবিজি তাঁর সাহাবিদেরকে ইথিওপিয়ায় (তখনকার আবিসিনিয়া) হিজরতের নির্দেশ দিলেন। প্রশ্ন হলো, ইথিওপিয়াই কেন, যার দূরত্ব আবার মক্কা থেকে চার হাজার চারশ ছিয়াশি কিলোমিটার? অন্য কোনো দেশ নয় কেন? মুহাম্মদ (সা.
নবীজির (সা.)ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। সম্রাট নাজ্জাশির ইথিওপিয়া উদার বক্ষে গ্রহণ করেছিল মুহাজির মুসলিমদেরকে। যদিও মক্কার কাফেরদের ক্রোধের থাবা বিস্তৃত হয়েছিল সাগরের ওপারের নিরীহ দেশটি পর্যন্ত। কিন্তু আসহামা নাজ্জাশির বিচক্ষণতা এবং ন্যায়পরায়ণতার সামনে কাফেরদের কোনো চক্রান্ত টিকে থাকতে পারেনি।
আরও পড়ুনআসিয়া (আ.): আল্লাহর পথে উৎসর্গিত জীবন১৭ এপ্রিল ২০২৫ইথিওপিয়ায় হিজরতের ঘটনা ঘটেছিল দুইবার। প্রথমবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ষোলজন। এঁদের মধ্যে বারোজন ছিল পুরুষ এবং চারজন নারী। দলপতি ছিলেন ওসমান ইবনে আফফান (রা.)। দ্বিতীয়বারের দলটি ছিল বড়। তিরাশি জন পুরুষ এবং আঠারো জন নারী ছিল সেই দলে। মক্কার কাফেররা যখন জানতে পারল, মুসলমানরা তাদের হাত ফস্কে বেরিয়ে ইথিওপিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে, ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেল তারা। মুসলমানদের ফিরিয়ে আনতে তারা আমর বিন আস এবং আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে পাঠাল ইথিওপিয়ায়। অজস্র উপঢৌকন নিয়ে তারা হাজির হলো লোহিত সাগরের ওপারের দেশে। প্রথমে চামড়ার উপহার সামগ্রী প্রদান করে তারা হাত করল নাজ্জাশির পারিষদবর্গকে। তারপর অবশিষ্ট উপঢৌকন নিয়ে প্রবেশ করল সম্রাটের দরবারে। বলল, আমাদের দেশের একদল ধর্মদ্রোহী আপনার দেশের আশ্রয় নিয়েছে, মহামান্য সম্রাট। এরা মক্কার পরিবেশ নষ্ট করে এখন এসেছে আপনার এখানে। এরা নতুন এক ধর্মমত প্রচার করছে। যার সাথে না আমাদের ধর্মের মিল আছে না আপনার ধর্মের। এরা খুব বিপজ্জনক। পূর্বপুরুষের ধর্ম এবং ঐতিহ্যের সাথে এরা গাদ্দারি করেছে। মক্কার নেতৃবর্গ এদের ফিরিয়ে নিতে আমাদেরকে পাঠিয়েছেন।
আরও পড়ুনরমজানে কেন বিয়ের আয়োজন হয় না২৪ মার্চ ২০২৫মহামান্য সম্রাট, ধর্মদ্রোহীদেরকে আমাদের হাতে ন্যস্ত করুন। আমরা ওদেরকে মক্কায় নিয়ে যেতে চাই। কথা শেষ করে তারা সম্রাটের সামনে উপঢৌকন পেশ করল। পারিষদবর্গ সায় দিল তাদের কথায়। কিন্তু প্রতিনিধিদ্বয়ের বিবরণে খটকা লাগল সম্রাটের মনে। ইনজিলে বর্ণিত প্রতিশ্রুত সেই মহামানব কি তবে এসে গেছেন বসুন্ধরায়! খানিক ভেবে তিনি বলেন, তোমাদের কথা শুনলাম, কিন্তু যাচাই-বাছাই না করে তো আমি আশ্রিতদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না। তিনি আশ্রিত মুসলমানদেরকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। মুহাজির মুসলমানদের দলটি যখন সম্রাটের কাছে এল, সম্রাট বললেন, যে ধর্মের কারণে তোমরা পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করেছ, সেই ধর্ম সম্পর্কে আমাকে জানাও।
মুসলমানদের মনোনীত মুখপাত্র জাফর বিন আবি তালিব খানিকটা এগিয়ে গেলেন। তারপর যা বললেন তার সারসংক্ষেপ এই: আমরা অজ্ঞতা, অশ্লীলতা, পাপাচারে লিপ্ত ছিলাম। আমরা ছিলাম নারী নিপীড়ক। মৃত প্রাণী ছিল আমাদের আহার। আমরা এক আল্লাহকে ভুলে বহু খোদার বন্দেগি করতাম। দুর্বলের সম্পদ গ্রাস করা ছিল আমাদের পেশা। হত্যা, লুণ্ঠন, মদ, জুয়ায় আমরা আকণ্ঠ ডুবে ছিলাম। এই যখন অবস্থা, তখন আমাদেরই ভেতর থেকে আল্লাহ একজন রসুল পাঠালেন। তিনি আমাদের আহ্বান করলেন একত্ববাদের দিকে। আমাদেরকে ডাকলেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে। আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন নামাজ পড়তে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে। আমাদেরকে ত্যাগ করতে বললেন হত্যা, লুণ্ঠন, অশ্লীলতা, মিথ্যা।
আরও পড়ুনসুরা যখন বিয়ের মোহরানা১৬ নভেম্বর ২০২৪তোমাদের রসুল আল্লাহর কাছ থেকে যা এনেছেন তার কোনো নিদর্শন দেখাতে পারবে?
জাফর (রা.) হৃদয়ে আবেগ আর কণ্ঠে মমতা ঢেলে পাঠ করলেন সুরা মরিয়ামের প্রথম কয়েকটি আয়াত। কোরআনের সুর লহরিতে দরবারে এমন এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হলো, সকলে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে লাগলেন সম্রাট ও পাদ্রিগণ। চোখের জলে তাদের দাড়ি এবং সামনে রাখা সহিফাগুলো ভিজে গেল। নাজ্জাশি চোখ মুছে ভরাট কণ্ঠে বললেন, এই বাণী আর হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ বাণী একই উৎস থেকে নাজিল হয়েছে। এবার তিনি শক্ত চেহারায় তাকালেন মক্কার প্রতিনিধিদ্বয়ের দিকে। বললেন, তোমরা যে উদ্দেশ্যে আমার কাছে এসেছ, সেই উদ্দেশ্য আমি সফল হতে দেব না। ফিরিয়ে নাও তোমাদের উৎকোচ। এঁরা আগে যেমন আমার আশ্রয়ে ছিল এখনো তেমনি থাকবে। এঁদেরকে কখনোই তোমাদের হাতে ন্যস্ত করব না। এরপর আশ্রিতদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যারা তোমাদেরকে অভিসম্পাত করবে, তাদেরকে আমি জরিমানা করব। এক পাহাড় স্বর্ণ দিলেও তোমাদের গায়ে আঘাত লাগতে দেব না। আল্লাহ যখন আমাকে এই রাজ্য দিয়েছেন, তখন আমার থেকে কোনো উৎকোচ নেননি। তাহলে আমি কেন উৎকোচ গ্রহণ করব!
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঘাবড়ে গেল প্রতিনিধিদ্বয়। সম্রাটকে বিভ্রান্ত করতে শেষ প্রচেষ্টা চালাল আমর বিন আস। সে বলল, এরা আপনাদের নবি ঈসার ব্যাপারে মূর্খতাসুলভ কথা বলে, যা খুবই ভয়ঙ্কর।
জাফর বিন আবি তালিব বললেন, আমাদের নবী (সা.) থেকে জেনেছি, ঈসা আলাইহিস সালাম ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও রসুল। তার মা ছিলেন সতী-সাধ্বী-বিদুষী নারী। আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছায় স্বামী ছাড়াই তিনি ঈসা আলাইহিস সালামকে প্রসব করেছিলেন।
আরও পড়ুনবিয়ের আগে মেয়েকে মা১৭ এপ্রিল ২০২৫আমর বিন আস ভেবেছিলেন, এই কথা শোনার পর সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন। শাস্তি দেবেন মুসলমানদের। কিন্তু আমরের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে সম্রাটের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এক টুকরো দণ্ড উঁচু করে ধরে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, জাফর যা বললেন ঈসা আলাইহিস সালাম তারচেয়ে এই দণ্ড পরিমাণও বেশি ছিলেন না। এরপর তিনি মুখ ফেরালেন জাফরের দিকে। বললেন, তোমরা নিরাপদে, শান্তিতে বসবাস করো আমার দেশে, যতদিন খুশি।
মুহাজির মুসলমানদের এই সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য নাজ্জাশিকে এতটাই প্রভাবিত করে, পরবর্তীকালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মৃত্যুর সংবাদে নবীজি (সা.)গায়েবানা জানাজার নামাজ পড়েন মদিনায়। মক্কার দুর্বিষহ দিনে ইথিওপিয়ার হিজরত নবিজির এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মুসলমান মুশরিকদের নিপীড়ন থেকে নিরাপদ শান্তিময় জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন। এবং যে সময়ে দুস্থ-অসহায়দের ঈমানের জোর ব্যতীত ইসলামের পার্থিব কোনো শক্তি ছিল না, সেই সময়ে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার দূরের এক খ্রিষ্টান শাসক মুসলমানদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।
সূত্র: প্রজ্ঞায় যার উজালা জগৎ
আরও পড়ুনসাহাবিদের বিয়ের আয়োজন ছিল সাদামাটা২৩ জানুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ জরত র ম সলম ন আল ল হ আম দ র বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বংশে তিনি প্রথম, তাই এত আয়োজন
চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া দেশটির যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য দারুণ সম্মানের। এ বছর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লি গুওইয়াও।
লির বাড়ি জেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনজউ শহরে। এর আগে তাঁর বংশে শত বছরের ইতিহাসে কেউ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। এত বড় সম্মানের উপলক্ষ উদ্যাপন করতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি লির পরিবার ও গ্রামের বাসিন্দারা। রীতিমতো লালগালিচা বিছিয়ে, মোটর শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড বাজিয়ে পরিবার ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা লিকে সংবর্ধনা দেন তাঁরা, সঙ্গে ছিল ভূরিভোজের ব্যবস্থা। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে এই সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি ‘গাওকাও’ নামে পরিচিত। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পরীক্ষায় মোট ৭৫০ নম্বরের মধ্যে লি পেয়েছেন ৬৯১।
লির গ্রামের এক প্রতিবেশী জানান, লির বাবা নির্মাণশ্রমিক। লির মা মাত্র ২ হাজার ৮০০ ইউয়ান বেতনে একটি সুপারশপে কাজ করেন। সত্যি বলতে, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে এটা অর্জন করেছেন।
প্রতিবেশী আরেক গ্রামবাসী বলেন, লি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে প্রশ্নোত্তর অনুশীলন করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় গ্রামের গ্রন্থাগারে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে লিখে তারপর সেগুলো অনুশীলন করতেন। মাধ্যমিকে তিনি কখনো কোনো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়েননি।
লিকে সংবর্ধনা দিতে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে তাঁদের গ্রামের পূর্বপুরুষদের মন্দিরের প্রধান ফটক খোলা হয়, যা একটি বিশেষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
লিকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনলাইনে একজন লেখেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬৯১ নম্বর! এটা অবিশ্বাস্য। সত্যিই পুরো পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে!’
তবে কেউ কেউ এই জমকালো উদ্যাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তাঁরা বলেছেন, এটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? উৎসবটা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ, এতে ছেলেটার ওপর অকারণ চাপ তৈরি হতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর কি পরিবার তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করবে না?