পেশাদার পুলিশ চাইলে এখনই সংস্কার জরুরি
Published: 2nd, May 2025 GMT
জনগণ প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চাইলেও রাজনৈতিক নেতারা কখনো তা চাননি। ১৯৩০ সাল থেকে দমন করাই ছিল পুলিশের কাজ। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এ জন্য পুলিশ সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়।
পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ অডিটরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ: নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকদের বক্তব্যে এমন মতামত উঠে এসেছে। এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সব মহানগর পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শ্রমিকনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পুলিশের সাবেক দুজন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। পুলিশকে একটি দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, পুলিশের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে, এর কারণ অনুসন্ধানের মতো উদার চিন্তা থাকা উচিত। পুলিশ দলীয় পুলিশ হয়ে যায়, সেটা তো বাহ্যিক। কিন্তু ভেতরে সমস্যা আছে।
বিচারব্যবস্থার কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, সেখানে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করলে সেটা আদালতের হাতে চলে যায়। প্রায়ই আমরা পুলিশের থেকে শুনেছি, আমাদের দেশের ফৌজদারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা যায় না। আদালত জামিন দিয়ে দেন, অপরাধী মুক্ত হয়ে যায়। কোনো ক্ষেত্রে নিরপরাধ শাস্তি পায়, অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এটা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।
সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবাই স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতা দিলে ভালো লাগে না। তখন গোলামি ভালো লাগে। অনেকেই গোলামি করতে চায়। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য মন্ত্রীদের বাসায় গিয়ে গোলামি করতে চায়। এ দ্বিচারিতার অবসান হওয়া উচিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়ে সমালোচনাপুলিশ সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম ও প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশ নিয়ে মতবিনিময় সভায় সমালোচনা করেছেন বক্তাদের কেউ কেউ। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ১৮৬১ সালের যে পুলিশ আইন এবং পুলিশ বিধি রয়েছে, তার পদে পদে সমস্যা
আছে। সর্বশেষ যে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়া হলো, তারাও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্বের গোড়ায় যেতে হবে। জনগণের বিপক্ষে পুলিশকে দাঁড় করানো যাবে না।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, এই প্রতিবেদনে যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, এগুলো সাত দিনেই তৈরি করা যায়। বর্তমান আইজিপিও সংস্কার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কমিশন কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছে। যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষারই দরকার হয়, তাহলে এই কমিশনের দরকার ছিল কি?
সূচনা বক্তব্যে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ইতিবাচক হয়, যখন মানুষ দেখে এই বাহিনী কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করছে।
নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে দেয় না। অতীতে দেখা গেছে, রাষ্ট্র কতটা নির্লজ্জ হলে পুলিশ সদস্যদের পদক দেওয়ার কারণ হিসেবে বিরোধী দলকে দমন করার কথা উল্লেখ করা হয়। তাঁর মতে, পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে।
জাহেদ উর রহমান বলেন, এর আগে পুলিশ সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবি উঠত। ওই আইনে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। অথচ পুলিশই এই আইন বাতিল চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা করতে না পেরে এই আইনের প্রয়োগে কিছু শর্ত যুক্ত করার কথাও বলেছিল পুলিশ।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, নতুন বাংলাদেশে পুলিশ যদি সত্যের পথে থাকে, তাহলে মানুষের কাছে তাদের আস্থার জায়গা তৈরি হবে। পুলিশকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
শিল্পোদ্যোক্তা সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। পুলিশে ঊর্ধ্বতন পদসহ বিভিন্ন পদে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে সেবার মানসিকতা তৈরি করা যাচ্ছে কি না, দেখতে হবে।
অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, বিরোধী দল দমনে পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সংস্কারের ক্ষেত্রে এগুলো বিবেচনায় না নিলে পুলিশ মানুষের পুলিশ হয়ে উঠতে পারবে না।
আইজিপি বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন মতবিনিময় সভা-সংক্রান্ত উপকমিটির সভাপতি ও পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক আইজ প মতব ন
এছাড়াও পড়ুন:
কোনো ব্যক্তির মনে যাতে ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছা না আসে, সেজন্য নির্বাচন প্রয়োজন
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কেউ যখন এক ব্যক্তিকে অপরিহার্য মনে করে, তখনই স্বেচ্ছাচারিতা তৈরি হয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মনে যাতে ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছা না আসে, সেজন্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজন।
মহান মে দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১ মে) রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল আয়োজিত শ্রমিক সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এছাড়াও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও নজরুল ইসলাম খানসহ সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রাখেন। শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে সমাবেশ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু প্রমুখ।
তারেক রহমান বলেছেন, গত দেড় দশকে পরাধীনতার শেকলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদের পতন হলেও জনগণের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এজন্য মানুষ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি পৌঁছে দিতে পারছে না।
তিনি আরো বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির সরকার অবৈধ না, কিন্তু জনগণের নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সবাইকে ভালো রাখার জন্যই বিএনপি রাজনীতি করে। বিএনপি সরকার প্রতিবারই মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে কাজ করেছে, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। তাই, বিএনপির নেতাকর্মীদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়নি।
রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা দিতে মানবিক করিডর দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণকে জানায়নি সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করেনি। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কি না, সেই বিতর্ক তুলতে চাই না। তবে, করিডর দেওয়া না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে।
তারেক রহমান আরো বলেন, বিদেশিদের স্বার্থ নয়, দেশের মানুষের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমার, ভারত বা অন্য দেশ নয়, সবার আগে বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা।
বর্তমান সরকারের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অংশ সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিভেদ উসকে দিতে চায়। জনগণের মনে এমন সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। তাহলে জনগণের সন্দেহ কেটে যাবে।
তিনি বলেন, দেশে এখন সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু, অর্থনীতির চালিকাশক্তি শ্রমিকরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় তাদের কথা বলতে পারছেন না। এজন্য নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) শিল্পীদের দেশাত্মবোধক গান ও গণসংগীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সমাবেশ।
বিভিন্ন জেলা ও শহর থেকে আসা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাথায় ছিল লাল, সবুজ, সাদা ও কালো টুপি, পরনে ছিল টি-শার্ট।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়া পল্টন এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়।
ঢাকা/এএএম/রফিক