কাশ্মীরের পেহেলগাম অঞ্চলে পর্যটকদের উপর হামলার ঘটনায় কিছুদিন ধরেই পারমাণবিক ক্ষমতাধর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছিল, এখন তা চূড়ান্ত হামলায় গড়িয়েছে। কূটনীতিক বহিষ্কার, বিমান চলাচলের জন্য আকাশপথ বন্ধ করাসহ পাল্টাপাল্টি বেশ অনেকগুলো পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে দুই দেশই। সর্বশেষ খবর হলো- পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরসহ দেশটির কয়েকটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। মঙ্গলবার মধ্যরাতে চালানো এ হামলায় পাকিস্তানে নিহত বেড়ে ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে দেশটি। 

১৯৪৭ সালে বিভক্তির পর থেকে দুই দেশ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে। এ সময়ে একাধিক যুদ্ধে জড়ানোর ইতিহাস রয়েছে তাদের। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উভয় দেশ উল্লেখ করার মতো সামরিক শক্তিও বজায় রেখে চলেছে। ১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাতের পর প্রথমবারের মতো পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ্যে আসে। এরপর থেকেই দেশটির মাঝে সামরিক প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।

বিশ্বে সামরিক শক্তি এবং অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে ধারণা তুলে ধরে গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে ২০২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের পরে ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক শক্তি হবে। তুলনামূলকভাবে, পাকিস্তানের অবস্থান কিছুটা পেছনে। ১৪৫টি দেশের মধ্যে ১২তম অবস্থানে তারা।

সৈন্য সংখ্যা বেশি কার
সুইডিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পাকিস্তানের তুলনায় প্রতিরক্ষা খাতে নয় গুণ বেশি ব্যয় করেছে ভারত।

সে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে, ভারত তার প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে, যেখানে পাকিস্তান ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি বরাদ্দ দিয়েছে।

সেনাসংখ্যায় এগিয়ে রয়েছে ভারত। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের মতে, ভারতের মোট সক্রিয় সৈন্য সাড়ে ১৪ লাখের কিছু বেশি, অন্যদিকে পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের কিছু বেশি। রিজার্ভ সেনা বা প্যারামিলিটারি বাহিনীর ক্ষেত্রেও এগিয়ে ভারত।

স্থলভাগের শক্তিতে ভারত নাকি পাকিস্তান এগিয়ে
স্থলভাগের শক্তি বিবেচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ভারত। তবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি ও মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর বা রকেট লঞ্চারের সংখ্যায় এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি সংখ্যা ৬৬২, ভারতের ১০০। পাকিস্তানের মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর ৬০০, ভারতের ২৬৪।

অন্য বেশ কিছু দিকে সংখ্যায় এগিয়ে ভারত। ভারতের ট্যাংক সংখ্যা ৪ হাজার২০১টি, সাঁজোয়া যান ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৪টি, টোওড আর্টিলারি বা টেনে নেয়ার কামান ৩ হাজার ৯৭৫টি। পাকিস্তানের ট্যাংক রয়েছে ২ হাজার ৬২৭ টি, সাঁজোয়া যান ১৭ হাজার ৫১৬টি, টোওড আর্টিলারি ২ হাজার ৬২৯ টি।

নৌবাহিনীর রণতরীতে এগিয়ে ভারত
শুধু মাইন ওয়ারফেয়ার ছাড়া নৌবাহিনীর রণতরীর সবদিকেই পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে ভারত।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনীর মোট ২৯৩টি যুদ্ধজাহাজের মধ্যে রয়েছে দুটি বিমানবাহী রণতরী, ১৩টি ডেস্ট্রয়ার, ১৪টি ফ্রিগেট, ১৮টি সাবমেরিন, ১৮টি কর্ভেট ও ১৩৫টি টহল জাহাজ।

পাকিস্তানি নৌবাহিনীর মোট ১২১টি যুদ্ধজাহাজের মধ্যে বিমানবাহী রণতরী ও ডেস্ট্রয়ার নেই। তাদের রয়েছে নয়টি ফ্রিগেট, আটটি সাবমেরিন, নয়টি কর্ভেট, এবং ৬৯টি টহল জাহাজ।

আকাশ পথের শক্তি
ভারতের বিমানবাহিনীর অধীনে রয়েছে ৩১টি স্কোয়াড্রন, যেখানে প্রতিটি স্কোয়াড্রনে ১৭ থেকে ১৮টি যুদ্ধবিমান থাকে। অপরদিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রয়েছে ১১টি স্কোয়াড্রন।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের কাছে মোট ২ হাজার ২২৯টি বিমান রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের আছে ১ হাজার ৩৯৯টি।

পাকিস্তানের কাছে আছে ৪১৮টি যুদ্ধবিমান- যার মধ্যে ৯০টি বোমারু বিমান। বিপরীতে ভারতের রয়েছে ৬৪৩টি যুদ্ধবিমান, যার মধ্যে ১৩০টি বোমারু বিমান।

পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর দুটি অস্ত্র হলো—যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা এফ-১৬ এবং চীনের সহায়তায় তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার। জেএফ-১৭ হলো হালকা, সব আবহাওয়ায় দিন-রাত ব্যবহারের উপযোগী যুদ্ধবিমান, যা পাকিস্তানের কামরায় অবস্থিত পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স এবং চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রির যৌথ উদ্যোগে তৈরি।

গত কয়েক বছরে ভারতের বিমানবাহিনীতে বড় সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয়েছে ফ্রান্স থেকে আনা রাফাল যুদ্ধবিমান। এই বিমান পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম এবং আকাশে ১৫০ কি.

মি. দূরত্বে এবং আকাশ থেকে ভূমিতে ৩০০ কি.মি দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানতে সক্ষম।

এটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত মিরাজ ২০০০-এর আধুনিক সংস্করণ এবং বর্তমানে ভারতের কাছে ৫১টি মিরাজ ২০০০ বিমান রয়েছে।

যুদ্ধবিমানের বাইরেও ভারতের রয়েছে ২৭০টি পরিবহন বিমান, ৩৫১টি প্রশিক্ষণ বিমান, ৬টি রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার এবং ৯৭৯টি হেলিকপ্টার, যার মধ্যে ৮০টি আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার।

পাকিস্তানের রয়েছে ৬৪টি পরিবহন বিমান, ৫৬৫টি প্রশিক্ষণ বিমান, ৪টি রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার এবং ৪৩০টি হেলিকপ্টার, যার মধ্যে ৫৭টি আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার।

ভারতের সক্রিয় সামরিক বিমানঘাঁটির সংখ্যা ৩১১টি আর পাকিস্তানের ১১৬টি।

পারমাণবিক অস্ত্র
পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে সুইডিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন বলছে পারমাণবিক ওয়ারহেডের দিক থেকে দুটি দেশ প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে।

সে প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতে আনুমানিক ১৭২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, আর পাকিস্তানে আছে আনুমানিক ১৭০টি।

তবে, দুই দেশের কয়টি ওয়ারহেড ঠিক অপারেশনাল বা প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে, তা ঠিক স্পষ্টভাবে জানা যায় না।

এসআইপিআরআই-এর এর মতে, পাকিস্তান মূলত ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, আর ভারত মনোযোগ দিচ্ছে দূরপাল্লার অস্ত্রের দিকে। অর্থাৎ এমন অস্ত্র যা চীনকেও লক্ষ্যবস্তু করতে পারে।

চীন, যা ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিবেশী এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তি, ২০২৪ সালে তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বা ওয়ারহেডের সংখ্যা ২২ শতাংশ বাড়িয়েছে। এখন তাদের মোট ওয়ারহেড সংখ্যা ৪১০ থেকে বেড়ে ৫০০ হয়েছে।

ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতায় দুই দেশের অবস্থান
ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন ও দূরত্ব পাড়ি দেয়ার সক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায় সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ থেকে।

পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে ক্ৰুজ, ট্যাকটিক্যাল ও স্বল্প-মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

ট্যাকটিক্যাল ক্ষেপণাস্ত্র যেমন হাতাফ-১ ও নাসের ৬০-১০০ কি.মি দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে আব্দালি (২০০ কি.মি), গজনবি (৩০০ কি.মি), রা'দ (৩৫০ কি.মি), বাবর (৭০০ কি.মি) ও শাহীন-১ (৭৫০-১০০০ কি.মি)।

মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে গৌরি-১ (১৫০০ কি.মি), গৌরি-২ (২০০০ কি.মি), আবাবিল (২২০০ কি.মি), শাহীন-২ ও শাহীন-৩ (২৫০০-২৭৫০ কি.মি) উল্লেখযোগ্য। আবাবিল ও শাহীন-৩ একসাথে কয়েকটি ওয়ারহেড বহনে এবং শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম ।

ক্যানবেরার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্ট্র্যাটেজিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ের শিক্ষক ড. মনসুর আহমদের মতে, আবাবিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র যা একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম এবং একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

অন্যদিকে ভারতের রয়েছে পৃথ্বী সিরিজ (২৫০-৬০০ কি.মি), অগ্নি সিরিজ (১২০০-৮০০০ কি.মি), নির্ভয়া ও ব্রহ্মোস ক্ৰুজ ক্ষেপণাস্ত্র। অগ্নি-৫ একটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র যা সাত থেকে আট হাজার কি.মি পাড়ি দিতে সক্ষম।

ভারতের ধনুষ হলো নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র।। ভারতের সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য কে-১৫ বা বি-০৫ (সাগরিকা/শৌর্য) ক্ষেপণাস্ত্রের রেঞ্জ প্রায় ৭০০ কি.মি।

ভারতের সুপারসোনিক ক্ৰুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্রহ্মোস পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। ২০২২ সালে একটি ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র ভুলবশত পাকিস্তানে গিয়ে পড়েছিল।

২০২৪ সালে ভারত সফলভাবে একটি হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যার রেঞ্জ ১৫০০ কি.মির বেশি এবং এটি আকাশ, স্থল ও জলপথ, সব জায়গা থেকে আঘাত হানতে সক্ষম।

হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত শব্দের গতির পাঁচ গুণ দ্রুত চলে। আর সুপারসনিক গতি সাধারণত শব্দের গতির চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়।

দুই দেশই বাড়িয়েছে ড্রোনের সংখ্যা
ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই তাদের অস্ত্রাগারে সামরিক ড্রোনের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিদেশ থেকে উন্নত ড্রোন কেনার পাশাপাশি নিজেরাও ড্রোন তৈরি করছে। এসব ড্রোন পাইলট ছাড়া শত্রুর ওপর নজরদারি, গুপ্তচরবৃত্তি ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়।

এই ড্রোনগুলো দীর্ঘ সময় আকাশে উড়তে পারে এবং শত্রুর রাডারে ধরা না পড়ে সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও ঘাঁটি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রাহুল বেদী বিবিসিকে জানান আগামী দুই থেকে চার বছরের মধ্যে ভারতের কাছে প্রায় পাঁচ হাজার ড্রোন থাকবে। তার মতে পাকিস্তানের ড্রোন সংখ্যা ভারতের চেয়ে কম হলেও, সেগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে যার সক্ষমতার জায়গা ভিন্ন ভিন্ন এবং ১০ থেকে ১১ ধরনের ভিন্ন ব্র্যান্ড বা মডেল রয়েছে তাদের।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে ৩১টি 'প্রেডেটর' ড্রোন কেনে যেটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সফল ও ভয়ংকর ড্রোন বলা হয়। একই সাথে ৫০ কোটি ডলার মূল্যের বোমা এবং লেজার গাইডেড মিসাইলও কেনা হবে।

পাকিস্তানের নিজস্ব তৈরি ড্রোনের মধ্যে আছে 'শাহপার' (১, ২, ৩), 'বুরাক' ও 'উকাব'। শাহপার-৩ মাঝারি উচ্চতায় ৩০ ঘণ্টা উড়তে পারে এবং অস্ত্র বহনে সক্ষম। বুরাক ২০১৫ সালে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবহার করা হয়। উকাব মূলত নজরদারি ও ছোট লক্ষ্যবস্তু শনাক্তে ব্যবহৃত হয়।

রাহুল বেদীর মতে, পাকিস্তান তুরস্ক এবং চীন থেকে ড্রোন আমদানি করে। তবে, এটি জার্মানি এবং ইতালি থেকেও ড্রোন কিনেছে।

সূত্র: বিবিসি

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল আর ট ল র অন য য় ক ষমত অবস থ র বহন ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে উদ্বাস্তু জীবনের ভাবনা

২০ জুন ছিল বিশ্ব শরণার্থী দিবস। সেই দিবস উপলক্ষে ১৯ জুন কক্সবাজার শহরে কোস্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। সভায় ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান: ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

আলোচনা সভাটি ছিল মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা ও ক্যাম্পে শরণার্থীদের পরিপোষণের বার্ষিক বাজেট সংগ্রহ হ্রাসের উদ্বিগ্নতাকে ঘিরে। তার সঙ্গে আলোচনায় চলে ছিল ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নানান বিষয়ে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি তহবিল ঘাটতির কথা বলে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম হ্রাস করায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে নিযুক্ত শত শত শিক্ষকের চাকরিচ্যুতির বিষয়টিও আলোচনায় প্রাধান্য পায়।

সভায় বক্তাদের সমস্যার বিবরণ ও তালিকা পেশ ব্যতীত সমাধানের কোনো পথনির্দেশের হদিস পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া আলোচনা সভায় স্থানীয় জেলা প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালান রোধের রূপরেখার কিছুই জানা যায়নি। আলোচনা সভায় উখিয়া-টেকনাফের জনপ্রতিনিধিদের মুখে সবচেয়ে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে রোহিঙ্গাদের অবাধে শ্রমমজুরিতে প্রবেশ ও হাটবাজারে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারায় টেকনাফ-উখিয়া উপজেলার সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন নির্বাহের অচলাবস্থা সৃষ্টির বিষয়টি নিয়ে।

সভায় জনপ্রতিনিধিরা আরও জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য দূষণের কারণে কৃষকদের কৃষি কাজে মারাত্মক পরিবেশদূষণের বাধা-বিঘ্নতা। এখনো ফয়সালা হয়নি একটানা কয়েক বছর ধরে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় জেলেদের নিয়মিত মাছধরার কাজে বাধাগ্রস্ত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দারিদ্র্য ও হতাশায় জীবনধারণের বিষয়টিও আলোচনায় গুরুত্ব পায়। আলোচনা সভায় সরকারি কর্মকর্তাদের মুখেই শোনা গেছে সীমান্তে মাদক চোরাচালানে সীমান্ত পাহারাদারদের ব্যর্থতার কথা।

আলোচনায় আরও প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গাদের পরস্পরের মধ্যে হানাহানি এবং রোহিঙ্গা কর্তৃক স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করার মতো অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা। বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসকারী স্থানীয় জনসংখ্যার তুলনায় অধিকসংখ্যক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পবাসী কীভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেলার সর্বত্র বেপরোয়াভাবে বিচরণ করছে এবং নানান পেশায়—ব্যবসায় যুক্ত হতে পারছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানা যায়নি। এতে স্থানীয় জনগণ উদ্বিগ্ন।

সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিদের বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় ব্যভিচারী ব্যবসার চিত্র। এ আলোচনা সভায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে—রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে শঙ্কা বাড়া বৈ কমেনি। সরকারের উদ্যোগে রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি সব দপ্তরের প্রধান, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির নেতা ও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্ণিত সব সমস্যা সমাধানের জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি উঠেছে সভায়।

২০২৪ সালের বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের পর এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। রাষ্ট্রভাবনার বিশেষজ্ঞরা, সব রাজনৈতিক দল, অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সব ব্যক্তি ও সংস্থার আর কোনো সংশয় নেই যে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি ক্রমে একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। যার পরিণতি ঘটেছে একটি অভ্যুত্থানে।

এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার এক বছরের মাথায় বিশ্ব শরণার্থী দিবসের কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনপ্রাণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে তাঁদের কথা ভেবে, যাঁরা আমাদের দেশের, আমাদের পরিচিতজনেরা, বন্ধুরা; যাঁরা কিনা এক বছর আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাঁরা নিজ দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা পরদেশে শরণার্থী হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করবেন।

রোহিঙ্গারা তাদের রাষ্ট্র ও সেই রাষ্ট্রের জনগণ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে, নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের অধিকার বঞ্চিত হয়ে, পরিশেষে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার দলনেতা শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ প্রভৃতি বলে যে কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছিলেন, ভাগ্যের কী করুণ পরিণতি, তাঁদের দলনেতাসহ অনেকেই আজ উদ্বাস্তু ও শরণার্থী!

এখন আমাদের সবার ভেবে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে, একটি রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের হঠাৎ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ কোথায় নিহিত রয়েছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা আকস্মিকভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন, তার জন্য অনেকে ক্ষুব্ধ, অনেকে খুশিতে ডগমগ, অনেকে চোখের জলে ভাসছেন। কিন্তু আমার মন তাঁদের জন্য দুঃখে ভারাক্রান্ত। এই উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ খুঁজে পেলে দেখতে পাব, রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণের সঙ্গে আমাদের বারবার উদ্বাস্তু হওয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।

আমার এই লেখায় উদ্বাস্তু বা শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা, সেই দুঃসহ জীবনের ভার বা তার মর্মবস্তুর কোনো ছিটেফোঁটাও ব্যক্ত করতে পারব না। এখানে তা ব্যক্ত করার দুঃসাহস দেখানো আমার উদ্দেশ্যও নয়। কারণ সেই উদ্বাস্তু জীবনযাপনের সেই দুর্ভাগ্য আমার জীবনে কখনো নেমে আসেনি। একাত্তরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার দুঃসহ-দুর্গম যাত্রার বিবরণ ও জীবনযাপনের কাহিনি বহু আমি পড়েছি; কিন্তু উদ্বাস্তু জীবনভোগী মানুষের অভিজ্ঞতার কিয়দংশও কারও জীবনচরিত পাঠে জানা যাবে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। আমিও তা–ই মানি। আমি ভাবতে চাইছি, মানবজীবনে সেই উদ্বাস্তু জীবনযাপনের দুঃসহ-দুর্ভাগ্য যেন কারও জীবনে নেমে না আসে, তার কারণ ও করণীয় কি খুঁজে দেখতে।

তা বোঝার জন্য একটু পেছনে ফিরে তাকাতে চাই। ব্রিটিশ–শাসিত এই অখণ্ড বাংলার নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যার প্রধান অংশ কৃষিজীবী ও বাঙালি মুসলমান, তারা মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চাইলেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে শুধু পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে বিভিন্ন জাতির মুসলমানদের মধ্যে ভাই ভাই সম্প্রীতি ও মর্যাদার সুর প্রধান হয়ে বাজলেও পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর সেই সুর ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। দেখা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রে পশ্চিম পাকিস্তানের নানান জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ভূস্বামী ও সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার হিসেবে এবং রাষ্ট্রের অধিকার ভোগে একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে কিংবা বাঙালি মুসলমানদের সমমর্যাদায় ও সম–অধিকারে একই পঙ্‌ক্তিতে বসাতে রাজি নন।

১৯৭০ সালের পার্লামেন্ট  নির্বাচনে বাঙালিদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিপুল বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির সমমর্যাদা ও সম–অধিকারে রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পাওয়া যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তখন সেই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার হীন চেষ্টা ও আঘাত থেকেই চরম বিরোধের সৃষ্টি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে সেই বিরোধ ও বাধা থেকেই অনিবার্য উঠেছিল সংঘর্ষ ও বিদ্রোহ। তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল একাত্তরের জনযুদ্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্বাস্তু জীবনের সূত্রপাত। সব কথাই আমাদের সবার জানা কথা। আমাদের রাজনীতিবিদদের আত্মবিস্মৃত স্বভাবের চরিত্রের জন্যই এই জানা কথার পুনরাবৃত্তি। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জনগণের কারও কারও উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ একই ঘটনার সূত্রে গ্রথিত।

১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর থেকে ১৯৯০ অভ্যুত্থান এবং ১৯৯১ থেকে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের সব জাতি-গোষ্ঠী, সব ধর্ম-বর্ণ ও ধনী-নির্ধন জনগোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমমর্যাদা ও সম–অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থাপনা থেকেই একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ও ফ্যাসিবাদের জন্ম। রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠীর ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে  যার যার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে একত্রে মিলেমিশে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রে বসবাস করার ব্যবস্থাপনা তৈরি করার শাসক শ্রেণির যে দায়িত্ব ছিল তার ব্যর্থতা থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম। সেই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু বাসনার দানা বেঁধেছিল একাত্তরে।

যে রাজনৈতিক চর্চা ও রাষ্ট্রশাসনের ব্যবস্থা অন্য সবাইকে বঞ্চিত করার প্ররোচনা দেয়, নিজের ভাবাদর্শে ও মতবাদে মিলে যেতে জবরদস্তি ও বল প্রয়োগ করে, পরিশেষে রাষ্ট্রের অন্য সবাইকে মর্যাদা ও অধিকার দিতে অস্বীকার করে, সেই ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তোলার চর্চার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের কারও না কারও উদ্বাস্তু হওয়ার বীজ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই যার যার চিন্তা, যার যার ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই একটি জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিক অধিকার ভোগবাসনার বন্দোবস্ত।

বহু ব্যর্থতা ও ত্যাগের পর ২০২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র গড়ে তোলার আবার সুযোগ এসেছে। আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জনগণ বহু জাতির, বহু ধর্মের এবং বহু বৈচিত্র্যের। যার যার সৌন্দর্য ও মর্যাদা তার তার। কারও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে অন্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, অন্যের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা এবং সর্বোপরি সেই অপচেষ্টা রাষ্ট্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টার মধ্যেই নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। রাষ্ট্রের মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর সব নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে নাগরিকের বিভিন্নতার বিসর্জনের প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্নতা নিয়ে নাগরিকের সমবিকাশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

নাগরিকের সমবিকাশের অধিকারহীনতা থেকেই জন্ম নেয় বৈষম্যের। অন্য অধিকাংশ মানুষকে অধিকারহীন করে তোলার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ফলে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক এই বৈষম্য সৃষ্টির ফলে প্রতিনিয়ত দেশের মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে যারা উদ্বাস্তু হচ্ছে, আমরা তাদেরকেই শরণার্থী দিবসের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করছি। কিন্তু যে মানুষটি বাপ-দাতার ভিটায় জন্ম নিয়ে, সেই পরিবেশের আলো–হাওয়ায় বেড়ে উঠে জীবন শুরু করেছিল, রাষ্ট্রের বৈষম্য-নীতির ফলে দারিদ্র্যের কশাঘাতে অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়ে কোনো বড় শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে কিংবা কোনো বস্তির গলির আস্তানায় ঠাঁই নিতে হয়েছে। তারাও উদ্বাস্তু হওয়ার কম কিসে?

রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতির বৈষম্যের কারণে বেড়িবাঁধের অভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে যার পৈতৃক বাস্তুভিটা ভাসিয়ে নিয়ে যাকে কোনো শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, সত্যিকার অর্থে সে–ও বাস্তুচ্যুত।

দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বা প্রাকৃতিক দুযোগের কারণে বা দারিদ্র্যের কারণে যারা উপকূল থেকে হোক কিংবা প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা সবাই উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু হওয়া এসব নাগরিক যারা শহরের ফুটপাত বা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও  রাষ্ট্রের সুশাসন দূরে থাক, সকল ধরনের শাসন ও সেবা থেকে বঞ্চিত।

রাজনৈতিক কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়েছে, তারা কোনো না কোনো আইনের আওতায়, কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষের বা সংস্থার সেবা পায়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও অতি দারিদ্র্যে পতিত হয়ে যারা উদ্বাস্তু হয়ে নিজেদের সমাজ ও গ্রাম হারিয়ে শহরের ফুটপাতে বিচ্ছিন্নভাবে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উদ্বাস্তু জীবনের যাতনা কম নয়।

একাত্তরে উদ্বাস্তু হওয়ার মর্মে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমান মর্যাদা ও অধিকার না দিতে চাওয়া শাসকশ্রেণির উদ্যত ও বাড়াবাড়ির মধ্যে আমরা খুঁজে পাব। আমরা কি ২০২৪ সালে আমাদের প্রতিবেশী, পরিচিতজন ও বন্ধুদের উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের কারণ তাদের নিজেদের, নিজেদের দলের ও দলের নেতাদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইয়ের এবং অন্যদের বঞ্চিত করার রাজনৈতিক চর্চার ভুলের মধ্যে খুঁজে পেতে চেষ্টা করব না?

আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদের নিজেদের উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ খুঁজে দেখতে চেষ্টা করব। বর্তমানে, নতুন পর্যায়ের রাষ্ট্র গড়ার সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক কর্মী ও দলনেতারা যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, আমরা যদি আমাদের সমাজের বিভিন্নতাকে, বৈচিত্র্যকে সানন্দে মেনে নিয়ে সবাইকে সমান মর্যাদার চোখে সম–অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, এবং সেই অঙ্গীকার নিয়ে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারার চর্চা না করি, তাহলে একই সঙ্গে আমাদের উদ্বাস্তু হওয়ার বীজ আমরাই বপন করব।

মকবুল আহমেদ সাবেক অধ্যক্ষ ও লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বাড়ার বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে: অর্থ উপদেষ্টা
  • ২১ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৮ কোটি ডলার
  • বাছাইপর্ব পেরিয়ে সবার আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কানাডা
  • এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা
  • হোটেল বয় থেকে কনটেন্ট ক্রিয়েটর বিল্লাল, মাসে আয় লাখ লাখ টাকা
  • বিশ্ব শরণার্থী দিবসে উদ্বাস্তু জীবনের ভাবনা
  • টানা দ্বিতীয়বার জাতিসংঘের ‘কালো তালিকায়’ ইসরায়েল
  • বাংলাদেশে চলে আসা কোচের জায়গা নিলেন ব্রাভো
  • ইরান–ইসরায়েলের অর্থনীতি এই সংঘাত কত দিন চালিয়ে নিতে পারবে
  • কক্সবাজারে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু