তিন দফা দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া শাহবাগ ছাড়বেন না আন্দোলনকারীরা
Published: 11th, May 2025 GMT
তিন দফা দাবিতে এখনো রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া তাঁরা শাহবাগ ছাড়বেন না, ঘরে ফিরবেন না।
আজ রোববার বেলা আড়াইটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আহত ব্যক্তিরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে একই মঞ্চে অবস্থান করছেন আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
আন্দোলনকারীদের তিন দফা দাবি হলো—আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা। জুলাইয়ের সনদ ঘোষণা করা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হাসনাত আব্দুল্লাহ, আমরা শাহবাগে উপস্থিত আছি, আপনাকে শাহবাগে আসতে হবে, আমাদের দাবি পূরণ করতে হবে।’
সাকিব হোসেন নামের আরেক আহত ব্যক্তি বলেন, গতকাল বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁদের দাবি, আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে, যাঁরা জুলাই আন্দোলনে আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। আর তৃতীয় দাবি হচ্ছে, জুলাই সনদ প্রদান করা। এই তিনটি দাবি বাস্তবায়ন হওয়া ছাড়া তাঁরা ঘরে ফিরবেন না।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার জান্নাত বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও তাদের পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো জুলাই সনদ দেওয়া হয়নি। তাঁরা দ্রুত জুলাই সনদ ঘোষণা দাবি জানান।
আরও পড়ুনশাহবাগ ছাড়েননি জুলাইয়ে আহতরা, সুচিকিৎসাসহ তিন দফা দাবি২ ঘণ্টা আগেঅবরোধের কারণে শাহবাগ মোড় দিয়ে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। অনেক যাত্রীকে যানবাহন থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে তিন দিন ধরে টানা কর্মসূচি পালন করছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ ছাত্র-জনতা। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল শনিবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাত সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত এই বিশেষ সভা হয়। পরে যমুনার সামনে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সভার সিদ্ধান্ত জানান আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর শাহবাগে উল্লাস১৫ ঘণ্টা আগেলিখিত বক্তব্যে আসিফ নজরুল বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে। এর পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গৃহীত হয়েছে।
এই ঘোষণা আসার পর গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরা শাহবাগ ছাড়েন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরাও তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে ছিলেন। তবে তাঁরা শাহবাগ ছাড়েননি। তাঁদের সঙ্গে একই মঞ্চে অবস্থান নেন আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ হব গ ছ ড় ন ষ দ ধ কর অবস থ ন উপদ ষ ট ত হয় ছ আওয় ম ন করছ
এছাড়াও পড়ুন:
নেই অফিস, নিবন্ধনের আড়ালে লোক দেখানো রাজনীতি!
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল গজিয়ে উঠছে একের পর এক। খাতা-কলমে আবেদন জমা পড়েছে ১৪৭টি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক দল শুধু নামেই দল। নেই অফিস, নেই কার্যক্রম, নেই সাংগঠনিক কাঠামো। বেশ কিছু ‘কেন্দ্রীয় কার্যালয়’ খুঁজে পাওয়া গেল হোটেলের ভেতরে, ট্রাভেল এজেন্সির কক্ষ কিংবা তালাবদ্ধ ব্যক্তিগত বাসার ড্রয়িংরুমে।
রাজধানীর নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, সিদ্ধেশ্বরী, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই ‘ঠিকানার ভেলকি’। এমন তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
হোটেলের ভেতরে ‘দলীয় কার্যালয়’
পুরানা পল্টনের ৫৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় রয়েছে ‘মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘর’। অথচ এই ঠিকানাকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয় বলে উল্লেখ করেছে ‘বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল’। বৃস্পতিবার (২৬ জুন) দলের চেয়ারম্যান মো. মিনহাজ প্রধান দাবি করেন, ভবনের তৃতীয় তলায় তাদের অফিস রয়েছে, যা বর্তমানে ‘সংস্কারে’।
কিন্তু স্থানীয়দের মতে, উক্ত তলা বহুদিন ধরে বন্ধ। হোটেল ম্যানেজার স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেন, “মিনহাজ সাহেব মাঝে মধ্যে নাশতা করতে আসেন। এখানে কোনো দলীয় অফিস নেই।”
ট্রাভেল এজেন্সি নয়, এখন ‘ন্যায় বিচার পার্টি’!
ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় গেলে চোখে পড়ে ‘আল আমিন ট্রাভেলস’-এর সাইনবোর্ড। অথচ কাগজে-কলমে এখানে বসেছে ‘জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টির’ কেন্দ্রীয় কার্যালয়। চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান বলেন, “তাড়াহুড়ো করে ঠিকানাটা দিয়েছি। পরে বদলাব।”
ঠিক এমনিভাবে, ‘বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি’, ‘আজাদী পার্টি’, ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’, ‘বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি’- সবাই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
১২ বাই ৬ ফুট কক্ষেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়!
পুরানা পল্টনের একটি ছোট্ট কক্ষে নাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ’। এক পাশে বুকশেলফ, অন্য পাশে দুই সিটের সোফা। দলের সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা বলেন, “ছোট পরিসরে শুরু করেছি। আপাতত বড় অফিস নেওয়ার দরকার নেই।”
আর ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট পার্টি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলছেন, তারা শুধু জানেন আলমগীর হোসেন একজন আইনজীবী। তিনি কোনো দলের সভাপতি, সে খবর তাদের অজানা।
ড্রয়িংরুম, আধাপাকা বাড়ি ঠিকানা
দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে যে ভবনের ঠিকানা ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’ দিয়েছে, বাস্তবে সেটি একটি আধাপাকা একতলা বাড়ি।
বাড়ির মালিক আবুল কালাম বলেন, “এখানে কোনো অফিস বা দল কখনো ছিল না। আমাদের পরিবারই থাকে। অর্থাৎ, দল আছে খাতা-কলমে; বাস্তবে নয়।”
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব (নিবন্ধন) কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, “নিবন্ধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা সরেজমিন যাচাই করছি। ঠিকানা ও সংগঠন নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে সেই দল নিবন্ধন পাবে না।”
কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু দলীয় নাম থাকলেই চলবে না—সাংগঠনিক কাঠামো, নেতৃত্ব, অফিস, কার্যক্রম—সব যাচাই করা হবে।
নামেই বড় দল
এইসব দলের নাম শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, বুঝি বিরাট কোনো রাজনীতির দল: মানবতার জাস্টিস পার্টি, বেকার মুক্তি পরিষদ, জনজোট, আজাদী মুভমেন্ট, নাগরিক পার্টি। বাস্তবতা হলো, সাইনবোর্ড নেই, কোনো সভা-সমাবেশ নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি। শুধু আছে তালাবদ্ধ ঘর বা খাবারের দোকান, যেখানে মাঝে মাঝে নেতারা নাশতা করতে আসেন।
নিবন্ধন নয়, পেছনের দরজা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ‘ঠিকানা ভিত্তিক’ নিবন্ধনের ধারা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নিবন্ধন একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। অথচ অনেকেই এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে ক্ষমতার পেছনের দরজা খোলা রাখতে।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তানভীর আহমেদ বলেন, “যারা রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার ক্ষমতা রাখে না, তারা শুধু কাগজে-কলমে দল তৈরি করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিবন্ধন নিতে চায়। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, রাজনীতিতে দায়হীনতা বাড়ে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র আবির রায়হান বলেন, “রাজনীতি জনগণের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, জবাবদিহিতার জন্য। সেই রাজনীতির মূলধারা যদি শুরু হয় মিথ্যা ঠিকানা আর লোক দেখানো কক্ষ দিয়ে, তাহলে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কীভাবে বিশ্বাস রাখা যায়?”
এই নিবন্ধনের প্রক্রিয়া যেন লোক দেখানো ‘ঠিকানার খেলা’তে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই এখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। না হলে, খাতায় ১৪৭টি নতুন দল থাকলেও বাস্তবে থাকবে না একটিও গণতান্ত্রিক দল।
ঢাকা/এস