এমএফএসের মাধ্যমে ২০২২ সালে ৭৫,০০০ কোটি টাকা পাচার: টিআইবি
Published: 28th, May 2025 GMT
মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি। অর্থাৎ এই সেবার অপব্যবহার হচ্ছে।
টিআইবি জানিয়েছে, ২০২২ সালে কেবল এমএফএসের মাধ্যমে আনুমানিক ৭৮০ কোটি ডলার অর্থাৎ প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। এই অর্থ পাচারের বড় অংশ হুন্ডি, ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন, অনলাইন জুয়া ও বেটিংয়ের মাধ্যমে হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় টিআইবি।
টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগত এমএফএস হিসাবধারীদের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, এজেন্ট হিসাবধারীদের ১৭ শতাংশ ও মার্চেন্ট হিসাবধারীদের ১ দশমিক ৬ শতাংশ জালিয়াতি ও প্রতারণার শিকার হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন যথাক্রমে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, ৮৭ শতাংশ ও ১ দশমিক ৪ শতাংশ হিসাবধারী।
জালিয়াতি বা প্রতারণার শিকার হয়ে ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ হাজার টাকা; এজেন্টদের সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ও মার্চেন্ট হিসাবধারীদের সর্বনিম্ন ৫৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
টিআইবির গবেষণায় আরও দেখা গেছে, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড/নগদ লিমিটেড–সংশ্লিষ্ট এমএফএস বিধিমালার ‘ই-মানি’ ও ‘ট্রাস্ট-কাম-সেটেলমেন্ট’সংক্রান্ত ধারা উপেক্ষা করে ট্রাস্ট ফান্ডে জমা করা অর্থের সীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত প্রায় ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে। এই বিধি লঙ্ঘন গ্রাহকদের অর্থের ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বলে মনে করে টিআইবি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ ছাড়া প্রভাব বিস্তার করে সুরক্ষা ভাতা ও উপবৃত্তির অর্থ বিতরণের সুবিধা গ্রহণ, আন্তলেনদেন প্ল্যাটফর্ম (বিনিময়)–সম্পর্কিত অনিয়ম-দুর্নীতি, এমএফএসপির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও অবৈধ বৈদেশিক লেনদেনের মতো ঘটনাও গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে। ভাতা ও উপবৃত্তি বিতরণে আর্থিক জালিয়াতি, নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ই-মানি সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে প্রায় ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা নগদ লিমিটেডের বেনামি শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে এমএফএস সেবার ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি বলে জানিয়েছে টিআইবি। গবেষণা করে তারা দেখিয়েছে, এমএফএস খাতের গ্রাহকদের পরিষেবা পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তুলনায় প্রায় ৭ থেকে ১৫ গুণ (৬ দশমিক ৯ থেকে ১৫ দশমিক ৯ গুণ) বেশি মাশুল দিতে হয়। তাদের হিসাব, ২০২৪ সালে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৫ দশমিক ৫ লাখ কোটি টাকার ‘ক্যাশআউট’ বাবদ সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৪১০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।
সেই তুলনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এ বাবদ আয় অনেক কম। টিআইবি হিসাব করে দেখাচ্ছে, একই পরিমাণ নগদ উত্তোলনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মাত্র ৬৩৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছে। এমনকি কিছু প্রতিবেশী দেশের মধ্যেও বাংলাদেশে এমএফএস পরিষেবা মাশুল সর্বোচ্চ।
এসব দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারীদের পরিষেবা মাশুল তুলনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলনের জন্য ব্যয় হয় ৩৭২ দশমিক ৫০ টাকা থেকে ৪৬২ দশমিক ৫০ (বিকাশ) টাকা। পাকিস্তানে (ইজি পেসা) একই পরিমাণ নগদ উত্তোলনের জন্য ৩৫৫ দশমিক ৭০ টাকা এবং মিয়ানমারে (ওয়েভ পে) ২৩১ দশমিক ৩ টাকা ব্যয় হয়। ভারতে (ফোন পে) এ ধরনের পরিষেবার জন্য মাশুল আদায় করা হয় না।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এমএফএস খাতে ভোক্তা স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। সেই সঙ্গে জালিয়াতির হার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামোর অভাব, বৈষম্যমূলক মডেল ও শর্তাবলি, পরিষেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের সুযোগের অভাব ও বিদ্যমান আইনি বিধিনিষেধ এমএফএস খাতে একচেটিয়া বাজার তৈরি করেছে। বিশেষ করে, বিকাশ ও নগদ বাজারের সিংহভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে (ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টধারীদের ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ বিকাশ ও ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ নগদ)।
ঘুষ, অর্থ পাচার, অনলাইন জুয়া ও ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে এমএফএস ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের যে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ এমএফএস ব্যবহার করে অবৈধ হুন্ডি লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কারণে নয়, এ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে এমএফএস ব্যবহার করে অর্থ পাচারে জড়িত অপশক্তির পতনের ফলে। এ দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই পরিবর্তনকে স্থায়িত্ব দিতে উদ্যোগী হবে বলে আমরা আশা করি। পাশাপাশি আগে যে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা ছিল, এখন তা এমএফএসের মাধ্যমে করার সুযোগ হয়েছে। তাই এমএফএস খাতকে আয়করের আওতায় আনতে হবে। ফলে বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়, কর ফাঁকি ও ঘুষ লেনদেন চিহ্নিত করা যাবে।’
গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে টিআইবির ১৩ দফা সুপারিশ করেছে। যেমন এমএফএস খাতের জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা, যেখানে সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিসহ সুশাসন নিশ্চিতকল্পে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করা, আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত রীতির আলোকে এমএফএস পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিশ্চিত করা; সেবামূল্য ও এজেন্ট পরিবেশকদের কমিশনের সীমা নির্ধারণ ও তদারকি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এমএফএস খ ত এমএফএস ব অর থ প চ র ব যবহ র ট আইব র র জন য ল নদ ন আর থ ক পর ষ ব দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
এমএফএস-ব্যাংক আন্তলেনদেন চালু হয়েছে, শুরু করতে পারেনি বিকাশ ও নগদ
মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস), ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারগুলোর (পিএসপি) মধ্যে আন্তলেনদেন চালু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় এই সেবা আজ শনিবার চালু হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় দুই এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদ এই সেবা চালু করতে পারেনি। এমনকি রকেটও সেবাটি চালু করতে পারেনি। ফলে বেশির ভাগ ব্যবহারকারী এই সেবার বাইরে রয়ে গেছেন।
বিকাশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে সেবাটি চালুর জন্য। যেকোনো সময় গ্রাহকেরা সেবাটি পাবেন। অন্যদিকে নগদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই সেবা চালু করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছিল, তাতে সাড়া মেলেনি। ফলে চালু করা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেবাটি চালু করতে বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্স না থাকায় নগদকে সংযোগ দেওয়া হয়নি। অনেকেই সেবাটি চালু করেছে। আশা করছি শিগগির সবাই সেবাটি চালু করতে পারবে।’
এর আগে গত মাসের শুরুতে এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, দেশে নগদ অর্থ লেনদেন কমানোর জন্য ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ অব বাংলাদেশ (এনপিএসবি) অবকাঠামো ব্যবহার করে সব ব্যাংক, এমএফএস প্রতিষ্ঠান এবং লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তলেনদেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ ১ নভেম্বর থেকে ব্যাংক, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো এই লেনদেন শুরু করবে।
কারা চালু করতে পেরেছেআজ থেকে কারা এই সুবিধা চালু করতে পেরেছে, তার একটি তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা গেছে, দেশের ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি মিলে ১০টি প্রতিষ্ঠান এই সেবা চালু করেছে। এই তালিকায় রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকের এমক্যাশ, ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, রকেট ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ইসলামিক ওয়ালেট এই সেবা চালু করেছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের টাকা জমা সুবিধা চালু হয়েছে। তবে এসব হিসাব থেকে টাকা পাঠানো সুবিধা চালু হয়নি। বাকি ১০টি প্রতিষ্ঠান জমা ও পাঠানো দুটো সুবিধা চালু করেছে।
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম এক লিখিত বক্তব্যে জানান, ‘বিকাশ শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তলেনদেন সেবা চালুর উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছে এবং সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এই সেবার সর্বশেষ সংস্করণে যুক্ত হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, এই সুবিধা গ্রাহকদের জন্য ডিজিটাল লেনদেন আরও সহজ ও সুবিধাজনক করে তুলবে। তবে আন্তলেনদেনের কার্যকারিতা এই ব্যবস্থায় সংযুক্ত অন্য অংশীজনদের ওপরও নির্ভর করে। তাই এই মুহূর্তে আমরা শক্তিশালী অথেনটিকেশন এবং স্তরভিত্তিক (লেয়ারড) নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, যাতে লেনদেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং এ-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ (ডিসপিউট) দেখা দিলে তা সমাধান করা যায়। সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর আমরা আশা করি খুব দ্রুতই গ্রাহকেরা পূর্ণাঙ্গভাবে সেবাটি ব্যবহার করতে পারবেন।’
নগদের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এনপিএসবির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যদিও মাশুল নির্ধারণ, কারিগরি কমিটিসহ এ-সংক্রান্ত সব সেবায় নগদের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপরও সংযোগ না পাওয়ায় সেবাটি চালু করা যায়নি।
এদিকে রকেটের কর্মকর্তারা বলেন, ‘ছুটির দিনের কারণে এখনো সেবাটি চালু করা যায়নি। তবে আমরা প্রস্তুত আছি। আশা করছি রোববার থেকে শুরু হবে।’
খরচ কতনতুন নিয়মে ব্যাংক থেকে যেকোনো ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপিতে এক হাজার টাকা পাঠালে গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৫০ পয়সা মাশুল গুনতে হবে। তবে ব্যাংক চাইলে আগের মতো বিনা খরচে এ সেবা দিতে পারবে।
বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো এমএফএসগুলো একে অপরের পাশাপাশি ব্যাংক ও পিএসপিতে টাকা পাঠাতে পারবে। এতে এক হাজার টাকা পাঠাতে খরচ হবে সর্বোচ্চ সাড়ে আট টাকা। আর যেকোনো পিএসপি হিসাব থেকে ব্যাংক বা এমএফএসে টাকা পাঠালে প্রতি হাজারে খরচ দিতে হবে দুই টাকা।