রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে টানা তৃতীয় দিনের ন্যায় চিকিৎসাসেবা বন্ধ হইয়া রহিয়াছে বলিয়া শনিবার সমকাল যে সংবাদ দিয়াছে উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রতিবেদন মতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সহিত চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের পরিণামে গত বুধবার হইতে হাসপাতালটিতে এই অচলাবস্থা চলিতেছে। শুক্রবার ছুটির দিনেও জরুরি বিভাগসহ ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীরা স্বাভাবিক চিকিৎসা পায় নাই। কবে নাগাদ এই সংকটের অবসান হইবে, তাহাও কেহ বলিতে পারিতেছে না। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিছক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নহে। চক্ষু চিকিৎসার জন্য দেশের অন্যতম বিশেষায়িত একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। অর্থাৎ এখানে শুধু সাধারণ চক্ষুরোগীরাই আসেন না, অন্যান্য চক্ষু হাসপাতাল হইতে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে ভিড় করেন। একই কারণে জুলাই আন্দোলনে গুলি ও অন্যান্য কারণে যাহারা চোখে আঘাত পাইয়াছেন তাহারাও এই হাসপাতাল হইতেই চিকিৎসা গ্রহণ করিয়াছেন। তাহাদের অনেকে অদ্যাবধি সেখানে ভর্তি রহিয়াছেন। চলমান অচলাবস্থার কারণে এই রোগীদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাইতে হইতেছে তাহা আমরা বুঝি। একই কারণে দেশের বহু সাধারণ মানুষও যে ক্ষতির মুখে পড়িয়াছেন তাহাও না বলিলেই নহে। ইহাও বলা প্রয়োজন যে, সরকারি হাসপাতাল হইবার কারণে সাধারণত চিকিৎসা ব্যয় এই হাসপাতালে বিশেষ বেসরকারি হাসপাতাল অপেক্ষা অনেক কম। ফলে এখানকার রোগীদের বাধ্য হইয়া বেসরকারি হাসপাতালে যাইতে হইলে তাহাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও কম হইবে না।
প্রতিবেদন অনুসারে, গত ২৫ মে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত চার রোগী বিষপান করিলে প্রথম উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে। উহার ধারাবাহিকতায় বুধবার হাসপাতালে ভর্তি থাকা জুলাই আন্দোলনকারী, কর্মচারী এবং রোগীর স্বজনদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। ইহার মধ্যে একপক্ষ অপরপক্ষকে এমন ভাষায় আক্রমণ করিতেছে, যাহার কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করিতে পারে বলিয়া অনেকের আশঙ্কা। অথচ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনার শুরুতেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিলে হয়তো বিষয়টি এতদূর গড়াইত না। প্রতিবেদন হইতে স্পষ্ট বোঝা যায়, জুলাই আন্দোলনকারীদের মধ্যে চিকিৎসাসহ যথাযথ পুনর্বাসন বিষয়ে প্রচুর ক্ষোভ-বিক্ষোভ কাজ করিতেছে, যাহার একটা প্রকাশ হিসাবে বুধবারের সংঘর্ষটি ঘটিয়া থাকিতে পারে। ইহা অনস্বীকার্য যে, আহত আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেক জটিল রোগী রহিয়াছে, যাহাদের যথাযথ চিকিৎসা হয়তো আলোচ্য হাসপাতালে সম্ভবপর নহে। তাই এই সকল রোগীকে বিদেশের উন্নত হাসপাতালে পাঠাইবার দাবি দীর্ঘদিন যাবৎ শুনিয়া আসিতেছি। কিন্তু সমস্যা হইল, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই বিষয়ে অদ্যাবধি আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ রহিয়াছেন। প্রত্যাশিত পুনর্বাসনের অভাবে কোনো কোনো জুলাই আন্দোলনকারী যে সুস্থ হইবার পরও হাসপাতালে অবস্থা করিতেছেন এবং এই কারণে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটিতেছে, উহাও সত্য। উহার দায়ও সংশ্লিষ্ট সরকারি নীতিনির্ধারকদেরই উপর বর্তায়। আবার জুলাই আন্দোলনকারীদের পক্ষ হইতে হাসপাতালে চিকিৎসক ও কর্মচারীদের অসংবেদনশীল আচরণের যে অভিযোগ উঠিয়াছে উহারও বাস্তবতা রহিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি। কারণ বিভিন্ন সময়ে দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালেও আমরা এহেন অভিযোগ উঠিতে দেখিয়াছি। এমনকি কখনও কখনও সেই সকল হাসপাতালে চিকিৎসক-কর্মচারীদের সহিত রোগী ও রোগীর স্বজনদের সংঘর্ষও ঘটিয়াছে। অতএব, আলোচ্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের উক্ত অভিযোগটিও বিবেচনায় লইতে হইবে।
আমরা মনে করি, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকে দ্রুত প্রাণ ফিরিয়া পাইতে হইবে। পরিস্থিতি আরও জটিল হইবার পূর্বেই এই লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ লইতে হইবে। তবে সরকারকে এই বিষয়টিও ভাবিয়া দেখা প্রয়োজন, কেন
জুলাই আন্দোলনে আহতদের প্রদত্ত তাহাদের প্রতিশ্রুতি নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়িত হইল না, যাহার খেসারত দিতে হইতেছে উক্ত ঘটনার সহিত ন্যূনতম সম্পর্কহীন সাধারণ রোগীদের।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক স ঘর ষ রহ য় ছ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।