আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। তাঁর জীবন ছিল দাওয়াতের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তিনি নিজের জ্ঞান, বাগ্মিতা এবং আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা দিয়ে ইসলামের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

নবীজি (সা.) যখন আরবের গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিচ্ছিলেন, তখন আবু বকর (রা.

) ছায়ার মতো থাকতেন তাঁর সঙ্গী হয়ে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি যাদের দাওয়াত দিয়েছি, সবাই দ্বিধায় পড়েছে, কিন্তু আবু বকর বিনা দ্বিধায় আমাকে গ্রহণ করেছে (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃ. ১৪১)।’

নবীজি (সা.)-এর উপস্থিতিতে ও অনুপস্থিতিতে তিনি তাঁর পক্ষে কথা বলতেন, তবে কখনো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আগে এগিয়ে যেতেন না।ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া

আরব গোত্র সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান

তিনি ছিলেন আরব গোত্রের বংশপরিচয় ও ইতিহাসের অগাধ পণ্ডিত। (ইমাম সুয়ুতি, তারিখুল খুলাফা, ১৯৯৭, পৃ. ১০০)। এই জ্ঞান তিনি দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি জানতেন কোন গোত্রের কী শক্তি, কী ঐতিহ্য এবং কীভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তিনি প্রমাণ করেছেন যে কোনো জ্ঞান, তা তাত্ত্বিক হোক বা ব্যবহারিক—আল্লাহর পথে ব্যবহার করা যায়।

ইসলামের বাণী প্রচারে তাঁর বাগ্মিতা

আবু বকর (রা.) ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। তাঁর কথার মাধুর্য মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যেত। নবীজি (সা.) যখন হজের মৌসুমে আরব গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতেন, তখন আবু বকর (রা.) তাঁর পাশে থেকে মানুষকে প্রস্তুত করতেন। তিনি গোত্রের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁদের সম্মান দিতেন এবং নবীজির বাণী শুনতে উৎসাহিত করতেন। ইবনে কাসির লিখেছেন, ‘নবীজি (সা.)-এর উপস্থিতিতে ও অনুপস্থিতিতে তিনি তাঁর পক্ষে কথা বলতেন, তবে কখনো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আগে এগিয়ে যেতেন না।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৯৯৬, ২/৯২)।’ তাঁর এই বিনয় ও কৌশল দাওয়াতের পথকে আরও ফলপ্রসূ করেছিল।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি যাদের দাওয়াত দিয়েছি, সবাই দ্বিধায় পড়েছে, কিন্তু আবু বকর বিনা দ্বিধায় আমাকে গ্রহণ করেছে।

তিনি গোত্রের শক্তি, সংখ্যা এবং ঐতিহ্য জেনে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি তাঁদের সম্মান দিয়ে দাওয়াতের পথ সুগম করতেন। কেননা দাওয়াতে সফলতার জন্য শ্রোতার প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরি।

আরও পড়ুনকোরআনের সবচেয়ে চমৎকার কাহিনি১৭ মে ২০২৫

বনু শায়বানের কাছে দাওয়াত

নবীজি (সা.) একবার আরব গোত্র বনু শায়বান বিন সালাবার কাছে দাওয়াত নিয়ে যান। সঙ্গে ছিলেন আলী (রা.) ও আবু বকর (রা.)। আলী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমরা একটি সম্মানিত সভায় পৌঁছালাম, আবু বকর এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন গোত্রের?’ তারা বলল, ‘বনু শায়বান।’ তিনি নবীজির (সা.) দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনার জন্য আমার মা-বাবা কোরবান, এরা তাদের গোত্রের শ্রেষ্ঠ, মানুষের মধ্যে মণি। এদের মধ্যে আছেন মুফাররাক বিন আমর, হানি বিন কুবাইসা, মুসান্না বিন হারিস ও নুমান বিন শারিক।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৯৮৮, ২/১৪৩-১৪৫)।

আবু বকর (রা.) মুফাররাকের সঙ্গে কথা শুরু করলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের সংখ্যা কত?’ মুফাররাক বললেন, ‘আমরা এক হাজারের বেশি নই, কিন্তু হাজার কখনো পরাজিত হয় না।’ আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের শক্তি কেমন?’ মুফাররাক বললেন, ‘আমরা যুদ্ধে রাগলে সবচেয়ে শক্তিশালী, আমরা সন্তানের চেয়ে ঘোড়াকে, দুধের গাভির চেয়ে অস্ত্রকে বেশি ভালোবাসি। জয় আল্লাহর হাতে, কখনো আমরা জয়ী হই, কখনো পরাজিত। আপনি কি এই কুরাইশির ভাই (আল্লাহর রাসুলের দিকে ইঙ্গিত করে)?’ আবু বকর বললেন, ‘যদি শুনে থাকেন যে আল্লাহর রাসুলের আবির্ভাব হয়েছে, তিনি এখানেই আছেন।’

‘আমরা পারস্যের কিসরার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। আমরা কোনো নতুন বিষয় শুরু করতে পারি না, কাউকে আশ্রয় দিতে পারি না। তবে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’

নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমি আপনাদের আহ্বান করছি এই সাক্ষ্য দিতে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই এবং আমি তাঁর বান্দা ও রাসুল। আপনারা আমাকে আশ্রয় দিন, আমাকে সাহায্য করুন, কারণ কুরাইশ আল্লাহর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তারা রাসুলকে মিথ্যাবাদী বলেছে।’ (ইবনে কাসির, ১৯৮৮, পৃ. ১৪৪)। নবীজি (সা.) পাঠ করলেন, ‘বলো, এসো, আমি তোমাদের পড়ে শোনাই, যা তোমাদের রব তোমাদের জন্য হারাম করেছেন: তাঁর সঙ্গে কিছু শরিক করবে না, পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, দারিদ্র্যের কারণে সন্তান হত্যা করবে না…।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৫১)।

মুফাররাক বললেন, ‘আপনি উত্তম নৈতিকতা ও সুন্দর কাজের দাওয়াত দিচ্ছেন। যারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে, তারা মিথ্যাবাদী।’ তবে হানি বিন কুবাইসা বললেন, ‘আমরা আমাদের ধর্ম ছেড়ে আপনার ধর্ম গ্রহণ করতে পারি না। এটি তাড়াহুড়ো হবে। আমরা ফিরে গিয়ে ভাবব।’ মুসান্না বিন হারিস বললেন, ‘আমরা পারস্যের কিসরার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। আমরা কোনো নতুন বিষয় শুরু করতে পারি না, কাউকে আশ্রয় দিতে পারি না। তবে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’ (ইবনে কাসির, ১৯৮৮, পৃ. ১৪৫)।

নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমরা সত্য কথা বলে ভালো উত্তর দিয়েছ। কিন্তু আল্লাহর দীনকে সে-ই সমর্থন করবে, যে এটিকে সব দিক থেকে রক্ষা করবে। তোমরা কি দেখ না, অল্প সময়ের মধ্যে আল্লাহ তোমাদের তাদের জমি, ঘরবাড়ি দান করবেন? তখন কি তোমরা আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করবে না?’ নুমান বিন শারিক বললেন, ‘হে আল্লাহ, এটি যেন হয়!’ (ইবনে কাসির, ১৯৮৮, পৃ. ১৪৫)।

বনু শায়বান প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেনি। কারণ, তারা পারস্যের কিসরার ভয়ে চুক্তি ভাঙতে চায়নি। কিন্তু দশ বছর পর, ইসলাম গ্রহণের পর, তাদের নেতা মুসান্না বিন হারিস হজরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতের সময় পারস্যের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেন। ইসলাম তাদের ভয়কে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল (তারিখুল ফুতুহাত, ১৯৮৮, পৃ. ২০)।

আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫

জীবন থেকে শিক্ষা

আবু বকর (রা.) নবী (সা.)-এর সঙ্গে সব সময় ছিলেন। এই সঙ্গীত্ব তাঁকে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বোঝাপড়া দিয়েছে। তিনি ইসলামের মূল সত্য, জীবনের উদ্দেশ্য এবং হক ও বাতিলের সংগ্রাম বুঝেছিলেন। তাঁর হৃদয়ে রাতের নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত এবং আল্লাহর জিকিরের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল (হামিদি, তারিখুল ইসলাম, ১৯৯৮, পৃ. ৬৯)।

তাঁর দাওয়াতে অংশগ্রহণ ছিল ইসলামের প্রাথমিক সাফল্যের একটি মূল চাবিকাঠি। তিনি প্রমাণ করেছেন, দাওয়াতে সফলতার জন্য জ্ঞান, কৌশল এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ নির্ভরতা প্রয়োজন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তিনি তাদের পথ সহজ করে দেন।’ (সুরা আনকাবুত: ৬৯)

আরও পড়ুনসুরা আর রাহমানে সবকিছু যুগ্মভাবে বর্ণনা করা হয়েছে২০ ডিসেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র ক র ক বলল ন আরব গ ত র প রস য র ইসল ম র আল ল হ র জন য ণ কর ছ আপন র করল ন বলত ন করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

বিএসবির বাশার প্রতারণার আরও ৯ মামলায় গ্রেপ্তার

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’-এর চেয়ারম্যান খায়রুল বাশারকে আরও নয়টি প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত আজ বুধবার এই আদেশ দেন।

ঢাকার সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) শামসুদ্দোহা সুমন প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

১০ দিনের রিমান্ড শেষে খায়রুল বাশারকে আজ বুধবার দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়। প্রতারণার পৃথক নয়টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়। শুনানি নিয়ে আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত।

মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় ১৪ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে খায়রুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খায়রুল বাশার তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশারকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র গড়ে তোলেন। চক্রটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, স্কলারশিপ ও ভিসা প্রক্রিয়াকরণের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ভুয়া ভিসা প্রসেসিং, মনগড়া প্রতিনিধিত্ব ও চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা হতো। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের অনেকের নামে বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করা হয়নি। আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছেন।

সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন ভুক্তভোগী প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা করেছেন।

আরও পড়ুনউচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান বাশার গ্রেপ্তার১৪ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ