শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত কি উচিত নয়, এ নিয়ে তর্ক কম হয়নি। এই তর্কের কোনো মীমাংসা হয়তো সম্ভবও নয়।

এর পক্ষে যেমন যুক্তি দেওয়া যায়, এর বিপক্ষেও তেমনি যুক্তি দাঁড় করানো যায়। তবে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে যত মতই থাকুক, এর সহিংস রূপকে নিশ্চয় কেউ সমর্থন করতে পারেন না।

সম্প্রতি আদালতের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এগুলো দেখে শঙ্কা জাগে, ছাত্ররাজনীতি আগের পথেই হাঁটছে কি না।

যেকোনো ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাধিক পক্ষ তৈরি হতে পারে। এক পক্ষ এর সমর্থনে এবং অন্য পক্ষ এর প্রতিবাদে কর্মসূচিও দিতে পারে। কিন্তু পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি যেন কোনোভাবেই সহিংস হয়ে না ওঠে, সেদিকে সব পক্ষেরই খেয়াল রাখা দরকার।

আরও পড়ুনছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না২৮ আগস্ট ২০২৪

জাতীয় রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আমরা তখনই আশা করতে পারব, যখন ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন দেখা যাবে। নিজের মত প্রকাশ করা যেমন অধিকার, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করা তেমনি দায়িত্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বক্তব্য ও কর্মসূচি দেখে প্রায়ই হতাশ হতে হয়। সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ অবলম্বন করে দেওয়া।

এই পক্ষাবলম্বন অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর অনুভূতি বা চাওয়ার সঙ্গে মেলে না। রাজনৈতিক দলের প্রতি ছাত্রনেতাদের ‘অন্ধ সমর্থনে’র বিশেষ কারণও থাকে। তাঁরা রাজনীতি করেন নিজেদের দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা ক্ষমতায় বসানোর জন্য। এর বিপরীতে তাঁরা অর্থ ও ক্ষমতার সুবিধা চান।

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে প্রতিপক্ষকে রাজনীতি করার ন্যূনতম সুযোগটুকুও তারা দিতে চায় না। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই এমনটি দেখা যাচ্ছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের অনুসারী ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে আধিপত্য ও দখলদারি কায়েম করে।

আরও পড়ুনছাত্ররাজনীতি বলে এখন কি কিছু আছে?০৯ এপ্রিল ২০২৪

একতরফা সমর্থনের বিনিময়ে নিজেদের অপকর্মের বৈধতা আদায় করে। এই দলীয় ‘লেজুড়বৃত্তি’ ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। ছাত্ররাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে।

ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন, যৌক্তিক দাবিতে সোচ্চার হবেন, ক্যাম্পাসে শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবেন—এমনটাই আশা করি আমরা। কিন্তু বরাবরই দেখা যায় যে ক্যাম্পাসগুলোয় রাজনীতির নামে অপরাজনীতি চলে।

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, এমনকি ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্রনেতারা জড়িত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়।

সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হন। তাঁদের একরকম জোর করে মিটিং-মিছিলে নেওয়া হয়। প্রতিপক্ষের ওপর হামলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও তাঁদের ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। আবাসিক হলগুলোয় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।

হল প্রশাসন অনেক কিছু বুঝেও প্রায় ক্ষেত্রেই নির্বিকার থাকে। কারণ, ক্ষমতালিপ্সু শিক্ষকরাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও রাজনৈতিক দলের ‘অন্ধ সমর্থক’ বানিয়ে তোলে। ফলে তাঁদের পক্ষে ছাত্রনেোদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বহু মতের ছাত্রসংগঠন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পক্ষেরই এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া উচিত নয় যা আক্রমণাত্মক এবং নিজেদের জন্য আত্মঘাতী। ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষা ও তৎসংশ্লিষ্ট অধিকারের কথা বলবে, জাতীয় রাজনীতি ও ইস্যুতেও কথা বলতে পারে, কিন্তু কেবল যেন রাজনৈতিক দলের ধ্বজাধারী না হয়।

অথচ এসব থেকে মুক্তির উপায় খুব জটিল ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হলে সবাইকে নিয়ে একটি সুন্দর শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরি করা সম্ভব।

বর্তমান বাস্তবতায় সেই সুযোগও তৈরি হয়েছে। এ জন্য সবার আগে দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেও ছাত্রসংসদ প্রতিনিধি থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবাধ ভোটে ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। এ জন্য ছাত্রসংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিয়মিত করা জরুরি। এভাবে ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব।

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বহু মতের ছাত্রসংগঠন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পক্ষেরই এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া উচিত নয় যা আক্রমণাত্মক এবং নিজেদের জন্য আত্মঘাতী।

ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষা ও তৎসংশ্লিষ্ট অধিকারের কথা বলবে, জাতীয় রাজনীতি ও ইস্যুতেও কথা বলতে পারে, কিন্তু কেবল যেন রাজনৈতিক দলের ধ্বজাধারী না হয়।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত র য় র জন ত র জন য ছ ত রন ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পর ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বেরোবি

‎বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থীদের। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে ‎বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গেজেট প্রকাশ হয়ছে গঠনতন্ত্র।

এরই মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর হতে যাচ্ছে কাঙিক্ষত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ব্যাকসু নির্বাচন। তবে এর জন্য আমরণ অনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মসুচিই পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

আরো পড়ুন:

‘আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে চাই’

‎বেরোবিতে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের মডেল প্রদর্শন

‎জুলাই অভ্যুত্থান পর গণরুম ও গেস্ট রুমের যে সাংস্কৃতি ছিল, তা এখন বন্ধ হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে সামিল হওয়াও বাধ্যতামুলক নয়।

‎তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাত্র সংসদ। যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।

‎কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বেরোবির বিধিমালা অনুযায়ী, ১৩টি পদে সরাসরি নির্বাচন ও হল সংসদে নয়টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব ধরনের কথা তুলে ধরতে পারবেন।

‎পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শেখর রায় বলেন, “সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও লেজুরবিত্তিক রাজনীতি ব্যতীত একটি নির্বাচন হোক। যোগ্য, আদর্শ, উত্তম চরিত্র ও মনের প্রার্থী বিজয়ী হোক। নির্বাচিত হয়ে তারা হয়ে উঠুক বেরোবির একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। তারা ন্যায়ের পক্ষে থাকুক । তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক বেরোবি।”

‎গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাওয়াদ সাজিদ বলেন, “ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দাবি, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার প্রধান মঞ্চ। এটি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কণ্ঠ পৌঁছে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে। কিন্তু এজন্য সংসদকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। প্রকৃত অর্থে ছাত্র সংসদ তখনই সফল, যখন তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান ও কল্যাণে কাজ করে।”

‎অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, “আমরা এমন ছাত্র সংসদ চাই, ‎যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে এবং সব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে। সবমিলিয়ে সবার বিশ্বস্ত জায়গা হবে এই ছাত্র সংসদ।”

ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ