‘বাঙালের’ পরিচয়-সূত্র যাঁরাই খোঁজ করেছেন, আজ অবধি তাঁদের কেউই সম্ভবত ইতিবাচক কিছু বলেননি বললেই চলে। কিন্তু কোনো জাতি সম্পর্কে একই জাতির মানুষ কিংবা বাইরের মানুষ যতই খারাপ কথা বলুন না কেন, জাতির স্বতন্ত্র অবস্থান তো আর বদলে ফেলা কিংবা বাতিল করে দেওয়া যায় না। বরং ভালো-মন্দ মিলিয়ে জাতির একটি পরিচয় নির্মিত হয়। সিরাজ সালেকীনের ভাটির দেশের বাঙাল এমনই একটি গ্রন্থ, যেখানে বাঙালির পরিচয়-সূত্র সম্পর্কে একটি বিচার-বিশ্লেষণমূলক ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে।
আকারে ক্ষীণকায় হলেও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের ভার বিপুলই বলতে হবে। বাঙাল বা আরেকটু বাড়িয়ে বাঙালি সম্পর্কে যেকোনো প্রচলিত-প্রথাগত ধারণার বাইরে পাঠককে একটি স্পষ্ট ও চিন্তা–যুক্তিমূলক ভাবনার খোরাক জোগাবে এ বই।
ইংল্যান্ড যেভাবে একটি রাষ্ট্র এবং ইংরেজ যেভাবে একটি জাতি হয়ে উঠেছে—সেখানে নজর দিলে দেখা যাবে, ক্রমাগত বিচিত্র বিষয়চর্চার ভেতর দিয়ে ইংল্যান্ডের বর্বর গোষ্ঠীগুলোই একত্র হয়ে এ সময়কার আধুনিক ইংল্যান্ড রাষ্ট্রটি তৈরি করেছে। ইউরোপের অনেক আধুনিক-উন্নত রাষ্ট্র সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। কিন্তু জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে তাদের পূর্বের ইতিহাস-ধারণাকে তারা খারিজ করে দেয়নি নিশ্চয়। বরং সেই ধারণাচর্চার ভেতর দিয়েই নতুন জাতি নির্মাণে ভূমিকা পালন করেছে। ভাটির দেশের বাঙাল গ্রন্থটি পাঠে পাঠক নিশ্চয় এ বোধটি সহজে উপলব্ধি করতে পারবেন।
গ্রন্থের প্রথমাংশ ‘গাবর-বাঙাল’ অংশে পূর্ব বাংলা সম্পর্কে পুরোনো যে ধারণা, সেসব নানা বইপত্র ঘেঁটে লেখক আমাদের সামনে হাজির করেছেন। দেখিয়েছেন, একটি অঞ্চল সম্পর্কে আরেকটি অঞ্চলের জ্ঞানচর্চার ক্ষমতা-আধিপত্য কীভাবে মাঝেমধ্যে খুব নিচু ধারণা পোষণ করে। বিষয়টি দৈহিকভাবে লাঞ্ছনা কিংবা নির্যাতনের বিষয় না হলেও মানসিক দিক বিবেচনায় তা গুরুতর নির্যাতনের সমান।
ভাটির দেশের বাঙাল—শিরোনাম দেখেই অনুমান করা যায়, এর গায়ে একার্থে নিন্দামূলক শব্দের গন্ধ লেগে আছে। স্বতন্ত্র আবহাওয়া, জলা-জঙ্গল আর বৃহৎ বদ্বীপের নদীমেখলা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য—সব মিলিয়ে ভাটির দেশ হিসেবে পূর্ব বাংলাকে ভিন্ন একটি অবস্থানে রেখেছিল সব সময়। তাই এ বাস্তবতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করা মানুষের সমাজও নিশ্চয় অন্য রকম হবে! গ্রন্থে এসব বিষয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে এনেছেন লেখক। তবে পূর্ব বাংলা সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তা আবার সামগ্রিকভাবে একেবারে মিথ্যাও নয়, তা–ও জানিয়ে রাখতে ভোলেনি তিনি। কিছু সত্য তো আছেই। এই অঞ্চলের স্বতন্ত্র ভূগোল-আবহাওয়া নৃতাত্ত্বিকভাবে এখানকার মানুষকে যে আচরণগত বৈশিষ্ট্য দান করেছে, তা নানা কারণে জাতিরাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সমস্যা নির্ধারণ না করতে পারলে তো সমাধান ব্যাপারটি আর সম্ভব হয় না। লেখক এ ধারণা প্রকাশেও সমর্থ হয়েছেন।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে প্রান্তিক পূর্ব বাংলা সম্পর্কে কেন্দ্রের যে ধারণা ছিল, তা কি ইংরেজ আমলে বদলে গিয়েছিল? এর সরাসরি উত্তর হবে, না। বরং শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতাকাঠামোগত দিক থেকে পূর্ব বাংলা আরও বেশি শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছিল। এই যে কেন্দ্র বাঙালদের অন্য চোখে দেখছে, ইংরেজ আমলে, তা কি কেবল ইংরেজরাই দেখেছে? না, কলকাতার লোকজনও মেট্রোপলিটন মান-নির্মাণের মাধ্যমে এ কাজ করেছে।
লেখক এসব বিষয় নানান স্মৃতিমূলক লেখাপত্রের বরাতে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাজির করেছেন। সচেতন পাঠকমাত্রই বিষয়টি বুঝতে পারবেন নিশ্চয়। ওপরের আলোচনাটি করলাম গ্রন্থটির দ্বিতীয়াংশ ‘কলকাতার চিত্ত’ ধরে।
আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলা সব সময়ই অপর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই অপরায়ণের রাজনীতি শুধু এ অঞ্চলের ক্ষমতা-ধারণাকেই প্রভাবিত করেনি, একই সঙ্গে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি বর্গকে প্রভাবিত করেছে। গ্রন্থের প্রথম দুটি অধ্যায় বা অংশ পাঠ করলে এ ধারণাই স্পষ্ট হয়।
গ্রন্থটির পরিশিষ্ট অংশও আকর্ষণীয়। এই অংশের লৌকিক প্রবাদ-প্রবচন আর নানা উক্তির একটি দারুণ সংকলন চোখে পড়ার মতো, কাজের তো বটেই। এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমাজ সম্পর্কে কৌতূহল জাগলে তা নিবারণের একটি ভালো দাওয়াই দিয়ে রেখেছেন লেখক গ্রন্থপঞ্জিতে। তবে পাঠক নিশ্চয় লেখকের কাছে এই আশা করতে পারেন, গ্রন্থটি আরও বিস্তৃত আকারে নতুন সংস্করণে বাজারে আসবে। আরেকটু হলেও নিবৃত্ত হবে তাঁদের কৌতূহল।
কেবল কোনো একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে না গিয়ে লেখক বরং বিচিত্রমুখী হয়েছেন। ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক—প্রধানত এ তিনটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারাপ্রবাহ এই গ্রন্থ রচনায় কার্যকর থেকেছে। বঙ্গ-পূর্ব বাংলা-পূর্ব পাকিস্তান-বাংলাদেশ—এই ঐতিহাসিক অভিযাত্রায় বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং ‘বাঙাল’দের ঐতিহাসিক-পরিচয় নির্মাণ পাঠে এই গ্রন্থকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া তাই কঠিনই বটে।
ভাটির দেশের বাঙাল
লেখক: সিরাজ সালেকীন
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২২
মূল্য: ৩০০ টাকা
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আমাদের যত ঘুঘু
মনিরা হাঁসের (বৈকাল টিল) সন্ধানে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বটতলা ঘাট থেকে ছেড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আধঘণ্টায় সিমলা পার্কের উল্টো পাশের চরের কাছে আসতেই একটি ঘুঘুকে পাড়ে বসে থাকতে দেখলাম। দ্রুত একটি ছবি তুলে ওটির পরিচয় নিশ্চিত হলাম। এই দুল৴ভ পাখিটি প্রথম দেখি ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ কুয়াশাভরা সকালে হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে। এরপর ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি সুন্দরবনের করমজলে।
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কাছ থেকে ভালো ছবি তোলার আশায় ধীরে ধীরে নৌকা পাখিটির কাছাকাছি নিতে থাকি। তবে নৌকা যতই কাছে যাক না কেন, সেটি কিন্তু অবিচল—একটুও নড়ছে না, চুপচাপ বসে আছে। কৌতূহলবশত নৌকা থেকে পাড়ে নামলাম, পাখিটির একদম কাছে চলে গেলাম। এরপর সেটি ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। আমরাও পিছু নিলাম। কিছুক্ষণ পর অনেকটা অনিচ্ছায় উড়াল দিল পাখিটি।
ঘুঘু পাখি কবুতরের মতো একই গোত্র কোলাম্বিডির (কপোত) সদস্য। ঘুঘুর দেহ কবুতরের মতোই তুলনামূলক ভারী, মাথা ছোট, চঞ্চু ও পা খাটো। ওড়ার পেশি শক্তিশালী। তাই দ্রুত ও দীর্ঘক্ষণ উড়তে সক্ষম। লেজ হাতপাখার মতো বিস্তৃত। তবে আকারে কবুতরের চেয়ে ছোট হয়। এরাও স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষ পিত্তথলিতে উৎপন্ন ক্ষীরের মতো অর্ধতরল দুধ খাইয়ে ছানাগুলোকে বড় করে তোলে, যা ‘পায়রা বা ঘুঘুর দুধ’ নামে পরিচিত। এদেশে এই গোত্রের যে ১৮টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১০টি কবুতর ও ৮টি ঘুঘু রয়েছে। প্রায় অর্ধেকের বেশি প্রজাতি সারা বছর প্রজনন করে। আয়ুষ্কাল চার থেকে ছয় বছর। এখানে এ পাখির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
রামঘুঘু (ওরিয়েন্টাল টার্টল ডাব): ফিচারের শুরুতে লালচে বাদামি বর্ণের যে ঘুঘুর গল্প বললাম, সেটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি রাম, কইতর বা গোলাপ ঘুঘু। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে এর দেখা মেলে। প্রাপ্তবয়স্ক ঘুঘুর দেহের দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬৫ থেকে ২৭৪ গ্রাম।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় উড়ন্ত ধবল ঘুঘু