এক সময় খাল-বিলে চাই, পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব হতো। বেশ কদর ছিল চাই, আনতা, পলোর মতো মাছ ধরার উপকরণের। কালের বিবর্তনে এসবের জায়গা দখল করেছে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও ম্যাজিক জাল। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য, বিপন্ন হচ্ছে দেশি মাছের জীবন চক্র।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো কুমিল্লার তিতাসেও এক সময় প্রচুর আনতা, পলো, চাই তৈরি হতো। বাঁশ কেটে, চাটাই বুনে মাছ ধরার এসব সরঞ্জাম তৈরির শিল্পে সম্পৃক্ত ছিল গ্রামীণ অনেক পরিবার। কেউ পেশায় জেলে, কেউ কারিগর, কেউ পাইকার। চাহিদা একেবারে কমে যাওয়ায় অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
স্থানীয় কারিগর হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বছরে অন্তত ৫০০টা আনতা তৈরি করতাম, এখন ১০০টাও বিক্রি হয় না। লোকজন এখন কারেন্ট ও ম্যাজিক জালেই সব মাছ মারে। আমাদের মতো গরিবরা এখন কাজ ছাড়া বসে থাকি।’
কারেন্ট ও ম্যাজিক জাল পরিবেশ ও মাছের জীবন চক্রের জন্য হুমকি। এসব জাল নিষিদ্ধ। যথাযথ নজরদারি না থাকায় এসব জাল অবাধে ব্যবহার হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মৎস্য কর্মকর্তারা।
স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা জানান, কারেন্ট জালে মাছের ডিম-বাচ্চাও ধরা পড়ে। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম নষ্ট হয়। এভাবে চললে ১০ বছরের মধ্যে দেশি মাছ হারিয়ে যাবে।
তিতাস উপজেলার একাধিক গ্রামের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারেন্ট জালের কারণে ছোট ছোট মাছও রেহাই পাচ্ছে না। ফলে দেশি মাছের প্রজনন ধ্বংসের পথে।
আবু তাহের নামে এক জেলে বলেন, ‘আগে এক ফালি খালে চাই ফেললে রুই, কাতলা, শিং, ট্যাংরা উঠত। এখন তো পানি আছে, মাছ নাই। এই জালগুলা সব শেষ কইরা দিতাছে।’
একটি আনতা তৈরি করতে যেখানে কারিগর, বাঁশ-কাঠ ব্যবসায়ী, বিক্রেতা ও পরিবহনকর্মীদের কাজ থাকে, সেখানে কারেন্ট জালের আধিপত্যে তা থেমে গেছে। ফলে শুধু মাছ নয়, বাঁশশিল্প, জাল তৈরি শিল্প, দেশীয় হাট-বাজারের একাংশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
যারা আনতা, পলো তৈরি করতেন, তারা অনেকেই কাজ হারিয়ে গ্রামে বসে আছেন। কিছু পরিবার অভাবের তাড়নায় অন্য পেশায় পা রাখলেও, তাদের কষ্টের কথা চোখে পড়ে সহজেই।
রোকেয়া বেগম নামে এক নারী কারিগর বলেন, ‘পাঁচটা সন্তান নিয়ে এই আনতা তৈরি করে আমার সংসার চলত। এখন কারেন্ট জালের কারণে কেউ আর নিচ্ছে না। আমাগো ঘরে অভাব লেগেই আছে।’
বাতাকান্দি বাজারের মাছ ধরার সরঞ্জামের এক পুরোনো দোকানি সিদ্দিক মিয়া। আলাপকালে তিনি জানান, আগে আনতা, দাড়ি, ভাড়, চাই খুব চলত। এখন কেউ খোঁজও নেয় না। লোকজন এখন ৫০ টাকার ম্যাজিক জাল নেয়। প্রায় ৫ বছর ধরে তাঁর চাই আর দাড়ি বিক্রি হয় না বললেই চলে।
গত বুধবার দুপুরে বাতাকান্দি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে– কয়েকটি আনতা, চাই, পলোর দোকান সরঞ্জাম সাজিয়ে রেখেছে। তবে ক্রেতা নেই, দুই-একজন যা আসছেন, দরদামে বনিবনা না হওয়া বেচাকেনা হচ্ছে না।
আনতা, চাই বিক্রেতা বিমল সরকার জানান, দুপুর ১টা পর্যন্ত একটি সরঞ্জামও বিক্রি করতে পারেননি। আগে অনেক টাকায় বিক্রি করতে পারতেন। তাঁর বাবা-দাদা সবাই এই ব্যবসা করেছেন, কিন্তু কারেন্ট জাল ও রিং জালের কারণে এখন আনতা, চাই কম চলে।
বাজারে আরেক ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলামের ভাষ্য, আগে প্রতিহাটে ৬০-৭০ হাজার টাকার সরঞ্জাম বিক্রি করতে পারতেন। এখন পুরো বর্ষা মৌসুমেও ৫-১০ হাজার টাকা বিক্রি হয় না।
বাতাকান্দি গ্রামের শাহ আলম বলেন, ‘ছোটকাল থেকে দেখে আসছি হাটের দিন এই বাজারে প্রচুর আনতা, পলো, চাই বিক্রি হতো। এখন তেমন একটা বিক্রি হয় না কারেন্ট জাল ও রিং জাল ব্যবহারের কারণে। এতে দেশীয় মাছ ধ্বংসের মুখে।’
বাতাকান্দি বাজারে আনতা কিনতে আসা ক্রেতা শাহ আলম মিয়া জানান, আগে বর্ষার সময় ২০-২৫টি আনতা কিনতেন তিনি। প্রচুর মাছও ধরা পড়ত। এখন কিছু লোক কারেন্ট জাল ও ম্যাজিক জাল ব্যবহার করার কারণে আনতাতে তেমন মাছ ধরা পড়ে না। তাই আনতা ব্যবহার লাভজনক না হওয়ায় কিনছেন না।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় তিতাস উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমা আক্তারের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, কারেন্ট জাল ও রিং জালের আধিপত্যের কারণে দেশীয় মাছ ধরার সামগ্রী আনতা, চাই, পলো হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কারণ ওইসব জাল দিয়ে কম সময়ে নির্বিচারে মাছ শিকার করা যায়। এসব নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধে প্রায়ই বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়েও অভিযান চালিয়ে জাল ধ্বংস করা হচ্ছে। সবাই এগিয়ে এলে মৎস্য সম্পদ রক্ষা পাবে, না হলে একসময় দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র সরঞ জ ম ব যবস এখন ক মৎস য
এছাড়াও পড়ুন:
মালয়েশিয়ায় স্বচ্ছভাবে কর্মী পাঠানোর দাবি ২৩ সংগঠনের
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ‘সিন্ডিকেটের’ (চক্র) সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ২৩টি সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম)। তারা বলেছে, অতীতে সিন্ডিকেটসহ যেসব কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছিল সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। উন্মুক্ত ও স্বচ্ছভাবে কর্মী পাঠানোর দাবি জানিয়েছে বিসিএসএম।
মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে বিসিএসএম। এতে বলা হয়, অতীতে সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিচার করতে হবে এবং কোনোভাবেই যেন তারা নতুন করে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হতে না পারে।
বিবৃতিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত সাবেক সংসদ সদস্য লোটাস কামালের (সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল) পরিবারসহ সাবেক তিন সংসদ সদস্যকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম মালয়েশিয়াকিনি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণে জড়িত প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত স্থগিত করার মালয়েশিয়ার অনুরোধে বাংলাদেশ রাজি হয়েছে।
এসব খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বিসিএসএম বলেছে, মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি না দেওয়া এবং অভিযোগের পুনঃ তদন্ত এবং বিচারিক তদন্তের দাবি জানাচ্ছে তারা। তা ছাড়া এই সিন্ডিকেটের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের যে অভিযোগ আছে, সেই অগ্রগতি সম্পর্কেও সাধারণ নাগরিকদের অবহিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে বিসিএসএম। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণের প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বিসিএসএম এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্রে, গণমাধ্যমে গত এক বছরে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর এবং দুদকের অভিযোগ থেকে জানা যাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে একেকজন কর্মীর কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে এবং কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, যার সঙ্গে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই সিন্ডিকেট জড়িত। এর আগে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দশজনের সিন্ডিকেট হয়েছিল এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ঘিরে নানা অনিয়মের খবর নতুন নয়। কিন্তু কখনোই তাদের বিচার হয়নি।
বিসিএসএমের চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী ও কো–চেয়ার সৈয়দ সাইফুল হকের স্বাক্ষরে পাঠানো বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারা আশঙ্কা করছেন, এখন এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যদি জবাবদিহি ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পায়, তবে একই ধরনের সিন্ডিকেট আবারও গড়ে উঠবে। বিসিএসএম আহ্বান জানাচ্ছে, ১১ থেকে ১৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে শ্রমবাজার উন্মোচন করতে গিয়ে সিন্ডিকেট নির্মূল করার বিষয়টি যেন গুরুত্ব না হারায়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ২৩টি নাগরিক সংগঠনের জোট বিসিএসএম অতীতেও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। এর আগে ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল আরেক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া এলেই স্বচ্ছতার বদলে নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটে। অতীতে সিন্ডিকেটসহ যেসব কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছিল আবার যেন ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
২৩ সংগঠন হচ্ছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু), ওয়্যারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ), বাস্তব, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাসুগ-ডায়াসপোরা অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রাইট যশোর, ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অলটারনেটিভ ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (ইনাফি), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা), ইমা রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড উড ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (বিসিডব্লিউডব্লিউএফ), ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা), বোয়াফ, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন (ডেভকম) লিমিটেড, ফিল্মস ফর পিস ফাউন্ডেশন, চেঞ্জ মেকারস, অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি), সেন্টার ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (সিসিডিএ), কর্মজীবী নারী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস), বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে)।