আত্মপ্রকাশের সাড়ে তিন মাস পর নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে ৪৩ হাজার ৩১৬ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট নিয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের প্রতীক হিসেবে দলটি জাতীয় ফুল শাপলা চেয়েছে। ইতোমধ্যে দলটি সেল গঠন করেছে ১৩টি, পার্টির অঙ্গসংগঠন ১০টি, ৩৩টি জেলা, ১৫৫টি উপজেলা এবং দুটি মহানগরে কমিটি দিয়েছে। বলা যায়, তুলনামূলক অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল কর্মযজ্ঞ সমাপ্ত করেছে তারা।
অবশ্য প্রতীক হিসেবে দলটির শাপলা চাওয়া নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, শাপলা জাতীয় প্রতীক। দেশের সংবিধানে এ ব্যাপারে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে– ‘জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীক’ অংশে ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক হইতেছে উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষবেষ্টিত, পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পরসংযুক্ত পত্র, তাহার উভয়পার্শ্বে দুইটি করিয়া তারকা।’
জাতীয় প্রতীকের অন্যতম অংশ ধানের শীষ বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রতীক হচ্ছে জাতীয় প্রতীকের অংশ তারকা। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালে জাতীয় ফল কাঁঠাল প্রতীক নিয়ে নিবন্ধন লাভ করে। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ। পার্টির সাবেক নেতা শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ২০০৭ জুলাই এনপিপি নামে একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় প্রতীকের অংশ অথবা জাতীয় ফল, ফুল নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে নেওয়ার পূর্ব রেকর্ড রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। নেপালের জাতীয় পশু গরু। দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রী পার্টি গরু প্রতীকে নির্বাচন করে থাকে। পাকিস্তানের হাজারা ডেমোক্রেটিক পার্টি দেশটির জাতীয় প্রতীকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ক্রিসেন্ট প্রতীকে নির্বাচন করে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্ম ফুল দেশটির অন্যতম জাতীয় প্রতীক।
নির্বাচনী প্রতীক এমন হওয়া চাই, যা সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য সহজেই মনে রাখার মতো। জাতীয় প্রতীকও জাতির মৌলিকত্বের প্রতিনিধিত্বকারী হয়। তাই জাতীয় প্রতীকের অংশ কিংবা জাতীয় ফুল নির্বাচনী প্রতীক হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রথমে লাঙ্গল প্রতীক চায় যুক্তফ্রন্ট। শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির লাঙ্গল প্রতীক থাকায় তদানীন্তন পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন লাঙ্গল প্রতীক যুক্তফ্রন্টকে বরাদ্দ দেয়নি। পরে দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে নৌকা প্রতীক বেছে নেয়। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ এবং নৌকা প্রতীকও নেয় দলটি। ভাসানী প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। মার্কা হিসেবে তিনি সে সময়ে বেছে নিয়েছিলেন ধানের শীষ।
যাদু মিয়া জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে ছিলেন। এখান থেকেই বিএনপির জন্ম হয় এবং বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক হয়ে ওঠে ধানের শীষ। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের অবিভক্ত ভারতের কৃষক প্রজা পার্টির লাঙ্গল কালের বিবর্তনে আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগের প্রতীক হয়। পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে দলটি অংশগ্রহণ করে। পরে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আতাউর রহমান খান, প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন সে সময়। এভাবেই এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রতীক হয়ে ওঠে লাঙ্গল। ইতিহাসের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এই তিনটি দলের প্রতীকই মূলত অন্য দল থেকে আত্তীকৃত।
দল গঠনের সময় এনসিপি দেশজুড়ে জনমত জরিপ চালায়। ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’– এ প্রতিপাদ্যে দেশবাসীর মতামত গ্রহণ করে তারা। লাখেরও বেশি মানুষের অংশগ্রহণে হওয়া জনমত জরিপে তাদের অন্যতম প্রশ্ন ছিল দলের প্রতীক প্রসঙ্গে। দলের প্রতীক হিসেবে শাপলা চেয়ে আবেদনের সময় সেই বিপুলসংখ্যক মানুষের চাওয়াকেও নিশ্চয়ই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
আরজু আহমাদ: লেখক ও
কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় নাগরিক
পার্টি (এনসিপি)
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে নতুন করে সংশয়ে বিএনপি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল লন্ডন বৈঠকের পর সেটা কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছিল; কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংশয় তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। বিশেষ করে ভোটের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেওয়ায় এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা বাড়ছে।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন নির্বাচনের কমিশনের কার্যক্রম তারা দেখছেন না। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ কিছু বিষয় নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এটাকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছে বিএনপি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তাঁরা দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন। বিএনপির নীতি–নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ধারণা করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার যমুনায় এই বৈঠকে সিইসিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর কথা বলবেন; কিন্তু সরকারের দিক থেকে এই বৈঠককে শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হয়েছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনও কোনো বক্তব্য দেয়নি। ফলে বিএনপি মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সিইসিকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি। যার ফলে প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির সাক্ষাতে কী আলাপ হয়েছে, তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে গত শুক্রবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি উভয় পক্ষ থেকে জাতির সামনে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হই।’
আরও পড়ুননির্বাচন বিলম্বিত বা না হওয়ার জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে: সালাহউদ্দিন আহমদ৯ ঘণ্টা আগেযারা স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি তুলছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে; হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অথবা নির্বাচন না হওয়া।সালাহউদ্দিন আহমদ, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপিসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবারের ওই সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংস্কারপ্রক্রিয়া কতটা এগিয়েছে এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে সিইসির কাছে জানতে চেয়েছেন। তবে কবে নাগাদ নির্বাচন আয়োজন করা হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো আলোচনার কথা জানা যায়নি।
১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে লন্ডন বৈঠকের ওই ঘোষণার কোনো প্রতিফলন নেই; বরং রাজনীতিতে নতুন নতুন কিছু ইস্যু তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছেন। এর মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা এবং আগামী নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জোরদার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুনপ্রধান উপদেষ্টা-সিইসির কী আলাপ হলো, পরিষ্কার করার আহ্বান সালাহউদ্দিনের২৭ জুন ২০২৫প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়