জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবিতে যমুনার সামনে অবস্থান, পরে সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ
Published: 30th, June 2025 GMT
জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ না পাওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। আজ সোমবার বেলা তিনটার দিকে তাঁরা যমুনার বিপরীত পাশে রমনা পার্কের অরুণোদয় গেটের সামনে অবস্থান নেন। বিকেলে পুলিশ সেখানে গিয়ে তাঁদের সরিয়ে দেয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনকারীরা ঘোষণাপত্রের দাবিতে রমনা পার্কের পাশে অবস্থান নেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আর কোনো টালবাহানা চলবে না বলে উল্লেখ করেন আন্দোলনকারীরা। বলেন, তাঁরা শহীদ মিনারে কর্মসূচি পালন করেছিলেন, তখন বলা হয়েছিল ঘোষণা দেওয়া হবে। সর্বশেষ ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে রাত আটটার দিকে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার কাছে কিছু ব্যক্তি বেআইনি সমাবেশের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের সরিয়ে দেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
উল্লেখ্য, জনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে যমুনা ও সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল, গণজমায়েত ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে, যা এখনো বলবৎ রয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবস থ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না—এনসিপি নেতার এ বক্তব্য কেন?
৫ আগস্ট চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানবার্ষিকীতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন নড়েচড়ে বসেছে। তারা প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংস্কার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। বেসামরিক প্রশাসনের কৃপাপ্রার্থী হতে হবে না।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পরও নির্বাচনের সময়সীমার বিতর্কটি শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না। তিনি যেদিন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে জানিয়ে দিলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে আমরা প্রস্তুত, নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করে দিয়েছি,’ সেদিনই ঢাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।’
আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সুযোগ নিতে পারে পতিত ফ্যাসিস্ট১৬ ঘণ্টা আগেপ্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছিলেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তাঁর দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় যুব শক্তি আয়োজিত ‘জাতীয় যুব সম্মেলন ২০২৫’-এ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তীব্র বিরোধিতা করে নাসীরুদ্দীন বলেন, ‘সংস্কার ও নতুন সংবিধান ছাড়া এ নির্বাচন হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের মায়েদের বুকে তাঁদের সন্তানদের ফেরত দিতে হবে।’
সংস্কার ও বিচারকাজ শেষ করেই নির্বাচন হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এনসিপির এই নেতা। অবশ্য তাঁর এ বক্তব্য ব্যক্তিগত না দলীয় পরিষ্কার নয়। জামায়াতের মতো এনসিপিও আনুপাতিক ভোটের কথা বললেও সারা দেশে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির সময় নিজেদের সম্ভাব্য প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কিছুটা বেকায়দায় থাকা এনসিপির নেতা–কর্মীদের মনোভাব চাঙা করতে কিংবা অন্যান্য দলের সঙ্গে দর–কষাকষি বাড়াতেও তারা এ কৌশল নিতে পারে।
ভোটের মাঠে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবে? ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) মাঠে না থাকায় নির্বাচনে জামায়াতই হবে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে এই দুই দলের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জামায়াত ইতিমধ্যে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে ও প্রচারও চালাচ্ছে। অন্যান্য ইসলামি দলের সঙ্গে জামায়াত নির্বাচনী সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগি করতে পারে। এনসিপি সে সমঝোতায় নিজেকে যুক্ত করবে, না এককভাবে ভোট করবে, তা পরিষ্কার নয়।
অতি আত্মবিশ্বাসী এনসিপির নেতারা কিছুদিন আগেও বলতেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করবেন অথবা প্রধান বিরোধী দল হবেন। এক নেতা তো ভবিষ৵দ্বাণীই করে ফেলেছিলেন, বিএনপি ৯০ থেকে ১০০ আসনের বেশি পাবে না।
জাতীয় যুব সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে তাঁরা ছাড় দিলেও জুলাই সনদে ছাড় দেবেন না।’ জুলাই সনদ, বিচার ও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আরও পড়ুনবিএনপি ও এনসিপির টানাপোড়েনে ‘প্রিজনার্স ডিলেমায়’ পড়তে পারে দেশ ১৯ ঘণ্টা আগেরংপুর অঞ্চলের নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশন এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ চ্যালেঞ্জ এককভাবে ইসির পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এটি করতে হবে ইসি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মিলিতভাবে।
জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও আগামী নির্বাচনে এটি সম্ভব নয়। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় আছে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী তিন শত সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’ সে ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রথমে সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বললেও পরবর্তী আলোচনা বর্তমান সংবিধানকে ভিত্তি ধরেই এগোচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় উচ্চকক্ষে আনুপাতিক হারে ভোটের বিষয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, নিম্নকক্ষের বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
নির্বাচনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় এখনো কাটেনি বলেই মনে করে অনেক দল। তারা বলছে, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে।২.ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘পালস সার্ভে ৩’-এর ফলাফলে দেখা যায়, ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ বলছেন, কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। গত বছরের অক্টোবরে ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তাঁরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। কাকে ভোট দেবেন, তা বলতে চান না ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ। আর ভোট দেবেন না বলেছেন ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। নির্বাচনের দিন–তারিখ কাছাকাছি ভোটারের মনস্থির করার কথা। তাহলে ভোটারদের মধ্যেও কি নির্বাচনের বিষয়ে সংশয় রয়ে গেছে?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন—এ প্রশ্নে ১২ শতাংশ বিএনপি, ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী ও ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ জাতীয় নাগরিক পার্টির কথা বলেছেন। আট মাস আগে গত অক্টোবরে একই প্রশ্ন করা হলে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ বিএনপি, ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ জামায়াত ও ২ শতাংশ মানুষ এনসিপিকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ আট মাস পর বিএনপি ও জামায়াতের ভোট কিছুটা কমেছে আর এনসিপির ভোট সামান্য বেড়েছে।
জরিপে গত অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ভোট দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেটি এখন কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আপনার নির্বাচনী এলাকায় কোন দলের প্রার্থী জিতবে বলে মনে হয়—এমন প্রশ্নে ৩৮ শতাংশ মানুষ বিএনপির কথা বলেছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে ১৩ শতাংশ মানুষ জামায়াত ও ১ শতাংশ এনসিপির কথা বলেছেন। আর আওয়ামী লীগের কথা বলেছেন ৭ শতাংশ মানুষ। গত ১ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত সময়ে এই জরিপ চালানো হয়।
এই জরিপে এনসিপির ভোট সামান্য বাড়ার কথা বলা হলেও সেটি কোনোভাবে বিএনপি, জামায়াত বা কার্যক্রম নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের কাছাকাছি নয়। এটাও এনসিপিকে নতুন ভাবনায় ফেলে দিয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
নির্বাচনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় এখনো কাটেনি বলেই মনে করে অনেক দল। তারা বলছে, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে।
নির্বাচনের ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র, সংস্কারপ্রক্রিয়া ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ঘিরে মতভেদ রয়েছে কোনো কোনো দলের মধ্যে। এ ছাড়া নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়েও রয়েছে সংশয়।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ইলেকশন যদি ফেয়ার না হয়, পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক) না হয়, লোকেরা যদি স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে না পারে, তাহলে তো এই নির্বাচন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।’
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকেও জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে রমজান মাস শুরুর আগেই নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের তোড়জোড় শুরু হলেও নির্বাচন ঘিরে এখনো সংশয় কাটেনি বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না সংকটের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু নির্বাচনকালে ল অ্যান্ড অর্ডারের ইস্যুটা নিয়ে সংশয় আছে।’
নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশের পাশাপাশি প্রায় সব দলের নেতারাই আরেকটি ১/১১–এর আশঙ্কা করছেন এবং এ জন্য একে অপরকে দায়ী করছেন। আরেকটি ১/১১ মানে আরেকটি ষড়যন্ত্র। আরেকটি ষড়যন্ত্র মানে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবির্ভাব। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শত শত মানুষের জীবন দেওয়ার পর এই সন্দেহ ও দোষারোপ গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
*মতামত লেখকের নিজস্ব