প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই চোখ আটকে যায় ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেয়ালজুড়ে আঁকা গ্রাফিতির দিকে। আন্দোলনের সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রংতুলি হাতে নিয়ে নেমে যান দেয়ালজুড়ে নানা রকম গ্রাফিতি আঁকার কাজ নিয়ে। আমি ঘুরে ঘুরে তাঁদের গ্রাফিতি আঁকা দেখতাম। এক দুর্দান্ত আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও একাগ্রতা নিয়ে তাঁরা তাঁদের মনের ভাব দেয়ালজুড়ে প্রকাশ করতেন।

’২৪-এর জুলাই এবং তার পরবর্তী সময়ের গ্রাফিতিগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা ছাত্রছাত্রীদের অনুভূতি এবং দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা চমৎকারভাবে দেখতে পাই। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা দেশ নিয়ে কী যে চমৎকার করে ভাবতে পারেন, সে বিষয়টি আমাদের ভাবনায় ছিল না। বিষয়টিকে তাঁরা যেন এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আর সেই সঙ্গে দিনের পর দিন জুড়ে আঁকা গ্রাফিতিগুলো যেন তাঁদের সেই কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

প্রায়ই এই গ্রাফিতিগুলোর দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে সেগুলোর মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করি আর ভাবি, দেশটাকে কি আমরা তাঁদের জন্য তাঁদের মতো করে গড়ে যেতে পারছি? গণ-অভ্যুত্থান শেষ হয়ে গেলেও গ্রাফিতিগুলো যেন স্থির হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ভুলে যেয়ো না এই দেশকে, ভুলে যেয়ো না আমাদের সেই সব ছাত্রছাত্রীকে যাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন জুলাই আন্দোলনের সময়। আর এভাবেই গ্রাফিতিগুলো আমাদের মনস্তত্ত্বে ক্রমাগত ভাবনার উদ্রেক ঘটিয়ে মনের একটি কোনায় রয়ে যায়। এর ছাপ পড়ে দেশ নিয়ে আমাদের ইতিবাচক চিন্তায়। একে ব্যক্তিগতভাবে গ্রাফিতির অসাধারণ একটি প্রভাব হিসেবে দেখি, যা আমাদের দেশভাবনায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

একটি হতাশাময় সময় পার করতে করতে এ দেশটিকে নিয়ে ইতিবাচক ভাবনাগুলো যেন অগোচরে হারিয়ে যায়। তবে এটাও ঠিক যে প্রতিদিন হানাহানি আর নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অনেকেই আবার তেমন কিছু ভাবতে পারেন না, যেমনটি জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পের ‘অনুভূতি ভোঁতা’ হয়ে যাওয়ার মতো একটি বিষয়। যা অন্যভাবে শক্তির একটি উৎস হিসেবেও কাজ করে। যে শক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আরও দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এমন একটি অনুভূতির সাদৃশ্যও কিন্তু আমরা ’২৪-এর জুলাইয়ে দেখেছি, যেখানে গ্রাফিতির মাধ্যমে তরুণেরা তাঁদের মনের ভাব প্রকাশ করার পাশাপাশি নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তিরও প্রস্ফুটন ঘটিয়েছেন, যা তাঁদের আন্দোলনকে যেমন বেগবান করেছে, তেমনি সাধারণ জনতার মধ্যেও তাঁদের আন্দোলনের একটি যৌক্তিক ভিত্তি দিয়েছে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে গ্রাফিতিকে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করার ফলে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে গ্রাফিতির সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োগ ও প্রভাব নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গবেষণা দেখা যায়। তবে এ নিয়ে আমাদের দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের তেমন একটা গবেষণা না থাকলেও ভবিষ্যতে এ নিয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সেই বিবেচনায় গ্রাফিতিগুলো কেবল শিল্পকর্ম নয়, আন্দোলনের সময়ের কিছু দাবিদাওয়া ও স্লোগান নয়; এর যেমন তাৎক্ষণিক একটি প্রভাব রয়েছে, তেমনি এর একটি দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও আমাদের জীবনে রয়ে যায়। যদিও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গ্রাফিতিকে একসময় অসাধু বা অনৈতিক কাজ হিসেবে দেখা হতো, যা সমাজ ও আইন বৈধতা দিত না। গ্রাফিতির চর্চা আমরা প্রাচীন রোমান সভ্যতায় যেমন দেখতে পাই, তেমনি দেখতে পাই প্রাচীন মায়া সভ্যতায়। এরপর আধুনিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই গ্রাফিতির ব্যবহার ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের একটি মাধ্যম হিসেবে।

আধুনিক সময়ে গ্রাফিতির মধ্য দিয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে একটি ভিন্ন ও প্রতীকী ভাষায় প্রকাশ করে থাকে, যা সরাসরি ভাষা বা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই এ ধরনের প্রতিবাদ এমনভাবে করা হয়, যাতে প্রতিবাদকারীর পরিচয় প্রকাশ না পায়। আর তাই একে অনেক সময় দুর্বলের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবেও আমরা দেখতে পারি, যেমনটা বিখ্যাত গবেষক জেমস সি স্কটের ‘উয়েপনস অব দ্য উইক’ ধারণার সঙ্গেও মিলে যায়।

তাই গ্রাফিতিকে প্রাথমিকভাবে যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হলেও আদতে এর মাধ্যমে একভাবে প্রথাগত যোগাযোগমাধ্যমকেও চ্যালেঞ্জ করা হয় গণমানুষের দাবির কণ্ঠস্বরকে প্রতীকী মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। এ প্রেক্ষাপটে সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রাফিতির প্রচলন আমরা দেখতে পাই, যা অনেক সময় ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন হয় কথা বলার অধিকার সীমিত বা না থাকার কারণে। যে বিষয়টি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিলিয়ে দেখতে পারি।

গ্রাফিতির এক অদৃশ্য শক্তি আছে বলে মনে করা হয়, তাই রাজনৈতিক বা সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবের সঙ্গে গ্রাফিতির ব্যবহারকে অনেক সময় অনিবার্য হিসেবে দেখা হয়।.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক আম দ র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

দুই রকমের নাগলিঙ্গম ফুল

প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক পিজি হাসপাতাল) মধ্য দিয়ে হেঁটে পার হই আর মাঝেমধ্যে রাস্তার এপাশে একটি ও ওপাশে আরেকটি নাগলিঙ্গমগাছের দিকে তাকাই। বছরের নানা সময় দেখি সেই গাছে ফুল ফুটছে। ফুল ফোটার যেন কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম নেই। একদিন সেসব ফুলের ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম, দুটি গাছের ফুলের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। একটির ফুল ফিকে লাল, অন্যটির ফুল টকটকে মেরুন লাল। এর পর থেকে যেখানেই নাগলিঙ্গমগাছ দেখি, সেখানেই ফুলগুলোকে দেখি। প্রায় সব নাগলিঙ্গমগাছের ফুলগুলোই দেখি লাল বা ফিকে লাল। কিন্তু মেরুন বা ঘন লাল রঙের ফুল আর একটিও চোখে পড়েনি।

রমনা পার্কে আছে বেশ কটি নাগলিঙ্গমগাছ। তার প্রায় প্রতিটির ফুলকে দেখার চেষ্টা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের বাগানে আছে একটি প্রাচীন নাগলিঙ্গমগাছ। মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে—সব জায়গার গাছেই প্রায় একই রকমের ফুল। 

কিন্তু এই একটি গাছের ফুল এমন আলাদা হলো কেন? এ গাছটির বয়স তুলনামূলকভাবে কম, বয়সে নবীন। তাই গাছটি অন্যগুলোর চেয়ে পরে লাগানো। মনে প্রশ্ন এল, তাহলে কি নাগলিঙ্গমেরও ভিন্ন ভিন্ন জাত আছে, যেটিকে কখনো এভাবে চরিত্রায়ণ করা হয়নি, নামকরণও না। জানি না। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মাও ঢাকায় নাগেশ্বর ফুল দেখতে দেখতে একদিন দুই রকমের নাগেশ্বর ফুল আবিষ্কার করেছিলেন। তেমনি নাগলিঙ্গমেরও কি দুটি জাতের গাছ ঢাকা শহরে আছে? এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা যেতে পারে। 

তবে জাতটাত যা–ই হোক, দুটি জাতের ফুলই দেখতে চমৎকার। যেকোনো উদ্যানে এ গাছ থাকলে যিনি কখনো নাগলিঙ্গমের ফুল দেখেননি, তিনি অবশ্যই চমৎকৃত হবেন। কেননা এ গাছের মোটা গুঁড়ির চারদিক থেকে শলা বা কাঠির মতো কুঁড়িসহ নস্যি রঙের মঞ্জরিদণ্ডÐবেরিয়ে আসে। সেসব মঞ্জরিদণ্ডের আগায় একসঙ্গে একাধিক ফুল ফোটে। পর্যায়ক্রমে তাতে আরও ফুল ফুটতে থাকে। ফুলগুলোর ঘ্রাণে গাছের চারপাশ আমোদিত হয়ে ওঠে। রমনা পার্কে ভোরবেলায় যখন এসব গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, মনে হয় সেসব গাছে যেন স্বর্গের পরিরা আতর মেখে বসে আছে! গাছের গোড়ায় ঝুলছে ঘুঙুরের মতো সবুজাভ-হলদে কুঁড়ি আর লাল ফুল, সকাল হতেই খসতে শুরু করে ফুলের পাপড়িগুলো। বলধা উদ্যানের প্রাচীন নাগলিঙ্গমগাছের তলায় একবার দেখেছিলাম সেসব ঝরা ফুলের বিছানাকে, ফুলে ফুলে বিছানো ছিল গাছের তলা, কোনো মাটি দেখা যাচ্ছিল না।

নাগলিঙ্গমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Couroupita guianensis ও গোত্র লেসিথিডেসি, পাতাঝরা প্রকৃতির বহুবর্ষী বৃক্ষ। গাছ ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। একটি বয়স্ক গাছে দিনে হাজারটা ফুলও ফুটতে পারে। নাগলিঙ্গমের ফুলগুলো বড্ড অদ্ভুত, সাধারণ কোনো ফুলের মতো গড়ন না। হঠাৎ দেখলে মনে হয় অসংখ্য দাঁত নিয়ে হাঁ করে আছে কোনো সাপের ফণা! জননাঙ্গটা সাদাটে দুই পাটি মাড়ির মতো, বক্রাকার সে অঙ্গের ওপরের অংশে গেঁথে আছে অসংখ্য হলদে- গোলাপি লোমের মতো পুরুষকেশর, নিচে রয়েছে ঘন লাল রঙের খাড়া কেশরগুচ্ছ। ফুলের সৌন্দর্যে ও সৌরভে কীটপতঙ্গরা ছুটে আসে। কিন্তু এসে খানিকক্ষণ ফুলে ঘোরাঘুরি করে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়, নাগলিঙ্গম ফুল যে মধুশূন্য। কেবল কাঠ মৌমাছিরাই থেকে যায় ফুলের রেণু সংগ্রহের জন্য। ফুলের হলদে গুঁড়ার মতো রেণুই যে ওদের বাচ্চাদের খাবার, মধুর সঙ্গে মিশিয়ে পাউরুটির মতো তা বাচ্চাদের খাওয়ায়। মাথা ও পিঠে মেখে সেসব রেণু বয়ে নিয়ে যায় ওরা। উড়ে আবার সে ফুল থেকে পাশের ফুলে যায়। ডানা ঝাপটায় আর ফুলের পরাগায়ন ঘটায়। এতে লাভ হয় দুজনেরই। কাঠ মৌমাছি পায় ছানাদের খাবার, নাগলিঙ্গম ফুল পায় বীজ ও ফলগঠনের সাহায্য। প্রকৃতিতে এ এক চমৎকার পারস্পরিক মেলবন্ধন।

নাগলিঙ্গমের গাঢ় লাল ফুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুই রকমের নাগলিঙ্গম ফুল