দুর্দান্ত প্রকৌশলী, প্রাণবন্ত মানুষ
Published: 22nd, September 2025 GMT
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) চত্বরে সবচেয়ে রাজসিক স্থাপনা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন। ছয়তলা, কিন্তু এর সৌকর্যের মধ্যে একটা কিছু আছে, এটাকে আকাশছোঁয়া বলে মনে হয়। ১৯৮০-এর দশকে আমি যখন ওখানকার ছাত্র, সিভিল বিল্ডিংয়ের সামনের পথ দিয়ে রশীদ ভবনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে আবৃত্তি করতাম: ‘আসলে, কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মত দেখায়.
আর আমি যখন ক্লাসে প্রথম তাঁকে পেলাম, তিনি বিলেত থেকে কংক্রিট বিষয়ে পিএইচডি করে ফিরে এসেছেন, আমাদেরও কংক্রিটের ক্লাস নেবেন। প্রথম দিন ক্লাসে এসে বললেন, রংপুরের কে কে আছ। আমরা চার–পাঁচজন দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, সবাই দেখে রাখো, রংপুরের ছেলেরা হয় সবচেয়ে ভালো। আর মেয়েরা ভালো হয় বরিশালের। কারণ, স্যার বিয়ে করেছিলেন বরিশালে।
স্ত্রী বিদায় নিয়েছেন, অকালে মারা গেছেন তাঁর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। গ্রিন কার্ড ছিল তাঁর, ফেলে দিয়েছেন। এখন তাঁর ছেলে থাকেন তাঁর সঙ্গে। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা এখনো মুগ্ধ হয়ে দেখেন। ইঞ্জিনিয়ারিং, পড়ানো, বক্তৃতা আর বুয়েটে শুক্রবারে দুবার যাওয়া—৮১ বছরের তরুণ বলেন, দেশের চেয়ে ভালো জায়গা আর কী আছে!বাংলাদেশের একজন শীর্ষ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, ৮১ বছর বয়সেও তরুণদের মতো যাঁর উদ্যম ও প্রাণখোলা হাসি, সেই ড. এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’ শীর্ষক ভিডিও সাক্ষাৎকারগুচ্ছের অংশ হিসেবে, লালমাটিয়ায় স্যারের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে।
১৯৪৩ সালের নভেম্বরে নীলফামারীতে জন্ম বসুনিয়ার। পৈতৃক ভিটা রংপুরের সীমান্তবর্তী পাটগ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। মাধ্যমিক শিক্ষা বরিশাল জেলা স্কুলে। সেখান থেকে ঢাকা কলেজে, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, যা পরে বুয়েটে রূপান্তরিত হয়।
বসুনিয়া স্যারের বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, এসডিও, আরও বড় প্রশাসনিক কর্মকর্তা। একদিন ছেলেকে বলেছিলেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি আ টিচার, ইউ উইল বি আ গুড টিচার।’ সেই ভবিষ্যদ্বাণীই যেন সত্যি হলো। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করে সামান্য সময়ের জন্য একটি মার্কিন কোম্পানিতে কাজ করলেও শিগগিরই ফিরে এলেন শিক্ষকতায়। পরে স্কটল্যান্ডের স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করে বুয়েটে যোগ দিলেন পূর্ণকালীন অধ্যাপক হিসেবে।
শুধু শিক্ষক নন, তিনি একজন স্বনামধন্য কাঠামো প্রকৌশলী। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় ইনডোর স্টেডিয়ামের ডিজাইন তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। ৩৭০ ফুট স্প্যানের এই স্থাপনা তখনকার পটভূমিতে ছিল এক বিস্ময়। আবার সাভারে পরমাণু শক্তি কমিশনের রিঅ্যাক্টর চেম্বারের জন্য বিশেষ কংক্রিট তৈরি করাও ছিল তাঁর হাতের কাজ।
যত বড় প্রকল্পেই যুক্ত হোন না কেন, বসুনিয়া স্যারের কাছে শিক্ষকতা সব সময় আনন্দের। ২৫ বছর ধরে তিনি এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে ক্লাস নেন বিনা বেতনে। তিনি বলেন, তখনকার ভিসি জামিলুর রেজা চৌধুরী তাঁকে বললেন এশিয়া প্যাসিফিকে যোগ দিতে। জবাবে তিনি বললেন, যোগ দিতে পারি, একটা শর্তে, পয়সা নেব না। তাঁর মতে, ‘শিক্ষক হতে হলে দরকার সাহস আর দৃঢ় কণ্ঠস্বর। বিষয়ের গভীরতা পরে আসবে।’
বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১১৬ টাকা খরচ করে, যখন সোনার ভরি ছিল ১১৬ টাকা। আড্ডা, তাস আর বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে ভরা তাঁর দৈনন্দিন জীবন তাঁকে করে তোলে সহজ-সরল।
বসুনিয়া স্যারের বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, এসডিও, আরও বড় প্রশাসনিক কর্মকর্তা। একদিন ছেলেকে বলেছিলেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি আ টিচার, ইউ উইল বি আ গুড টিচার।’ সেই ভবিষ্যদ্বাণীই যেন সত্যি হলো। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করে সামান্য সময়ের জন্য একটি মার্কিন কোম্পানিতে কাজ করলেও শিগগিরই ফিরে এলেন শিক্ষকতায়।বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর অবদান বিরাট। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল কিংবা নতুন এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্পে তিনি বিশেষজ্ঞ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অথচ এসব কাজের জন্য তিনি নেন না কোনো ফি। দেশপ্রেমই তাঁর সবচেয়ে বড় প্রেরণা।
অধ্যাপক বসুনিয়ার চোখে শিক্ষকতা কেবল পেশা নয়, দায়বদ্ধতা। তিনি বিশ্বাস করেন, বুয়েটের এক ব্যাচেলর ডিগ্রিই তাঁর জীবনের সব দুয়ার খুলে দিয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পড়াতে চান, আড্ডা দিতে চান, দেশের জন্য কাজ করতে চান।
বাংলাদেশে যদি বড় কোনো ভূমিকম্প হয়—এ আশঙ্কায় তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন। তাঁর মতে, আমাদের ভবনগুলোর অনেকটাই দুর্বল, বড় বিপর্যয় ঘটলে টিকে থাকা কঠিন হবে। তাই তিনি সর্বত্র জোর দিয়ে বলেন—ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে এখনই। মাটি পরীক্ষা ছাড়া কেউ কোনো স্থাপনা করবে না, এ-ই তাঁর আহ্বান।
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর অবদান বিরাট। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল কিংবা নতুন এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্পে তিনি বিশেষজ্ঞ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অথচ এসব কাজের জন্য তিনি নেন না কোনো ফি। দেশপ্রেমই তাঁর সবচেয়ে বড় প্রেরণা।সততা আর লোভহীনতা স্যারের শক্তি। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে দেশ ও পৃথিবীর মানুষের জন্য দোয়া করেন। আর মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা রাজার চিঠির প্রতীক্ষায় বইয়ে রবীন্দ্রনাথের চিঠির উক্তি নিয়ে উদ্বেল হন। রবীন্দ্রনাথ এই দেশে আরেকবার জন্মাতে চাননি কেন, তিনি ভাবেন। মানুষের মধ্যে তিনি শুধু ভালোটাই দেখতে চান, বিশ্বাস করতে চান।
স্ত্রী বিদায় নিয়েছেন, অকালে মারা গেছেন তাঁর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। গ্রিন কার্ড ছিল তাঁর, ফেলে দিয়েছেন। এখন তাঁর ছেলে থাকেন তাঁর সঙ্গে। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা এখনো মুগ্ধ হয়ে দেখেন। ইঞ্জিনিয়ারিং, পড়ানো, বক্তৃতা আর বুয়েটে শুক্রবারে দুবার যাওয়া—৮১ বছরের তরুণ বলেন, দেশের চেয়ে ভালো জায়গা আর কী আছে!
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ক ষকত বস ন য র জন য বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
দিনমজুর বাদশা মিয়াকে আমাদের সাধুবাদ
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের দিনমজুর বাদশা মিয়া তাঁর এলাকায় ‘গাছের বন্ধু বাদশা’ নামে পরিচিত। এই পরিচয় কোনো সরকারি পদক বা ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি থেকে আসেনি; এসেছে বিগত ২০ বছর ধরে ৩০ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়ে। তাঁর এ কাজ প্রমাণ করে, পরিবেশপ্রেম ও নিঃস্বার্থ সামাজিক দায়বদ্ধতা কোনো অর্থ বা ক্ষমতার মুখাপেক্ষী নয়, এটি গভীর মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
৭২ বছর বয়সী বাদশা মিয়ার স্লোগান—এক মুঠো ভাত নয়, এক মুঠো অক্সিজেন চাই। আজকের পরিবেশ সংকটের যুগে এক শক্তিশালী দার্শনিক বার্তা। বাদশা মিয়ার গাছ লাগানোর গল্পটি কেবল সবুজায়নের নয়, এটি এক পিতার গভীর আবেগের গল্প। ২০০৪ সালের এক বিকেলে, টাকার অভাবে সন্তানদের আমের আবদার মেটাতে না পারার কষ্ট থেকে তিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর মতো গরিব প্রতিবেশীর সন্তানেরাও ফল কিনতে পারে না। সেই ব্যক্তিগত বেদনা থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—তিনি এমন কিছু করবেন, যা তাঁর নিজের ও দরিদ্র প্রতিবেশীদের সন্তানদের জন্য ফলের অধিকার নিশ্চিত করবে।
এই স্বপ্ন পূরণে বাদশা মিয়ার ত্যাগ ছিল হিমালয়সম। প্রাথমিক পুঁজি জোগাতে তিনি মেয়ের কানের সোনার রিং বিক্রি করে গাছের গোড়ায় খুঁটি দেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন, দিনমজুরি করে যা আয় করবেন, তার চার ভাগের এক ভাগ ব্যয় করবেন চারা লাগানো এবং পরিচর্যার পেছনে। একজন ভূমিহীন দিনমজুরের কাছে আয়ের এক-চতুর্থাংশ মানে জীবনধারণের সঙ্গে সরাসরি আপস করা। এই আত্মত্যাগই প্রমাণ করে, তাঁর কাছে এই গাছগুলো নিছক চারা নয়—গভীর মমতায় লালন করা এগুলো যেন তাঁর সন্তানের মতোই।
বাদশা মিয়ার কাজকে সমাজ প্রথম দিকে মোটেই সহজভাবে নেয়নি। উল্টো গ্রামের কিছু মানুষ তাঁকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করেছে। গাছের চারা লাগাতে গিয়ে তিনি মানুষের বাধা পেয়েছেন, তাঁর লাগানো গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং একপর্যায়ে তাঁকে মারধরও করা হয়েছে। কিন্তু সেই সমাজের মানুষই এখন বাদশা মিয়ার দীর্ঘ ত্যাগ ও পরিশ্রমের সুফল ভোগ করছে।
বাদশা মিয়ার এই উদ্যোগ কেবল একটি স্থানীয় গল্প নয়, এটি সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি শিক্ষা। কোটি কোটি টাকার বন সৃজন প্রকল্প যেখানে অনেক সময় লোকদেখানো বা অপচয়ের শিকার হয়, সেখানে একজন দিনমজুর দেখিয়ে দিলেন, ভালোবাসা ও সদিচ্ছা থাকলে সামান্য সম্পদ দিয়েই পরিবেশবিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
উপজেলা প্রশাসন বাদশা মিয়াকে পুরস্কৃত করেছে, যা প্রশংসনীয়। আমরা আশা করব, স্থানীয় বন বিভাগ ও কৃষি বিভাগ বাদশাকে গাছ লাগানোর কাজে স্থায়ীভাবে সহযোগিতা করবে। বাদশা মিয়ারা আমাদের অনুপ্রেরণা। তাঁর প্রতি আমাদের অভিবাদন।