টাইমলাইনে চড়ে পেছনে ফিরে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুখস্মৃতি শুধু ভেসে আসবে। যেখানে শুধু পারফরমেন্স ছিল না, প্রতিপক্ষকে নাড়িয়ে দেওয়া, বলে কয়ে হারানো, চোয়ালবদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় মাঠে নেমে বড় শক্তিকেও সহজে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
বলা হয় ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট সেরা সময় কাটিয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেট তো বটেই টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতেও বাংলাদেশ ছিল সময়ের অন্যতম সেরা৷ সেই সুদিন ফেরানোর লড়াইয়ে লিটন, তাসকিন, মোস্তাফিজ, সাইফরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তেমনই এক লড়াইয়ে আজ দুবাইয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে বাংলাদেশকে। যেখানে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। অঘোষিত সেমিফাইনালে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান৷ যারা জিতবে তারা যাবে ফাইনালে৷ যেখানে আগে থেকেই আছে ভারত।
বাংলাদেশকে বড় আশা দেখাচ্ছে ২০১৬ ও ২০১৮ এশিয়া কাপ। দুইবারই বাংলাদেশ ডু অর ডাই ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে যাওয়ার টিকিট পায়। শিরোপা জিততে পারেনি শেষ পর্যন্ত কিন্তু দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার আগেই নিজেদের সেরা ক্রিকেট খেলে পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। আজ মাঠে নামার আগে সেই দুই স্মৃতি বারবার ফিরে আসছে টাইমলাইনে।
মহাদেশীয় এই প্রতিযোগিতা ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ঘরের মাঠে সেবার ছিল হট ফেভারিট। শ্রীলংকা পাকিস্তানকে পাত্তা না দিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে খেলেছিল ফাইনাল।
ফাইনালে ঠিক আগের লড়াই ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। পাক বাধা টপকাতে পারলেই বাংলাদেশ যাবে ফাইনালে এমন সমীকরণ ছিল৷ মাশরাফি বিন মুর্তজার দল সেই সমীকরণ মিলিয়ে ফেলেন রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ জয়ে। ৫ উইকেটের জয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার খেলে এশিয়া কাপের ফাইনাল। ফাইনালেও বাংলাদেশকে ঘিরে বাজি ধরার লোকের অভাব ছিল না৷ কিন্তু বৃষ্টি বিঘ্নিত ফাইনাল ম্যাচটি বাংলাদেশের ভাগ্যের লেখা ছিল না।
২০১৮ সালের ফরম্যাট বদলে এশিয়া কাপ হয় ৫০ ওভারের ক্রিকেটে৷ মাশরাফির নেতৃত্বে দল তখন নিয়মিতই ভালো করছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ধারাবাহিকতা ছিল এশিয়া কাপের মঞ্চেও। শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ ফাইনালের আশা বাঁচিয়ে রাখে। এরপর পাকিস্তানকে রুখে দিতে পারলেই শিরোপার পথে এক পা চলে যাবে বাংলাদেশ। আবুধাবিতে বিরুদ্ধে কন্ডিশনে, জয়ের তীব্র নেশা ও শিরোপা উঁচিয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশ পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে। ৩৭ রানের জয়ে বাংলাদেশ চলে যায় এশিয়া কাপের আরেকটি ফাইনালে।
সেবারও বাংলাদেশ শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারেনি। লিটনের অসাধারণ শতকের পরেও বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করে। ভারতের সঙ্গে পেরে উঠতে ওই রান পর্যাপ্ত ছিল না।
এবার কি হবে আগে থেকে ধারণা করা কঠিন। তবে অধরা শিরোপার খোঁজে থাকা দল হারার আগে হারতে নারাজ। এজন্য যেকোনো মূল্যে ফাইনাল খেলতে মরিয়া লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। ২০১৬ ও ২০১৮ সালের সুখস্মৃতি বাংলাদেশকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। আজ কেবল মাঠে আরেকটি ভালো দিন বাংলাদেশকে আবার উল্লাস ভাসাতে পারে।
ঢাকা/ ইয়াসিন
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষের নির্মমতার শিকার মহাবিপন্ন বনরুই
সাধারণ মানুষের কাছে বনরুই প্রায় অজানা এক প্রাণী। গভীর বনাঞ্চলের বাসিন্দা বিরল বনরুই মূলত রাতে বিচরণ করে। ফলে এই প্রাণী নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে আছে ভ্রান্ত ধারণা, বিশ্বাস এবং নানা আজগুবি গল্প। নিভৃতচারী হওয়ায় বিজ্ঞানীরাও বনরুই সম্পর্কে এখন পর্যন্ত খুব বেশি জানতে পারেননি। কয়েক দশক ধরে গোটা দুনিয়া থেকে এদের সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে।
বনরুইয়ের ইংরেজি নাম প্যাঙ্গোলিন; শব্দটি মালয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে প্রবেশ করেছে। এর অর্থ গড়িয়ে দেওয়া বা গড়াগড়ি দেওয়া। মানুষ, শিকারি প্রাণী বা অন্য কোনো বিপদ দেখলেই বনরুই তার মুখ, হাত-পা ও লেজ গুটিয়ে বলের মতো আকার ধারণ করে। এমনভাবে মাটিতে পড়ে থাকবে যেন কোনো জড় বস্তু, দেহে কোনো প্রাণ নেই। বিপদ থেকে বাঁচতে বনরুই এমন নিখুঁত অভিনয় করে। দেহ শক্ত বর্মসদৃশ আঁশে? ঢাকা থাকায় এই প্রক্রিয়ায় বনরুই শিকারি থেকে নিজেকে রক্ষা করে।
বাংলায় বনরুই নামটি কীভাবে এল, কেন রাখা হয়েছে—এর হদিস পাওয়া যায় না। সম্ভবত বনে বসবাস, মাছের মতো দৈহিক আকৃতি, সেই সঙ্গে দেহে রুই মাছের মতো আঁশ থাকায় বনরুই নাম দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এর অন্য নাম পিপীলিকাভুক, ইংরেজিতে অ্যান্ট ইটার। বনের পিঁপড়া, উইপোকা এদের প্রধান খাদ্য। বনে-বাদাড়ে পিপীলিকা ও উইপোকার বাসায় আক্রমণ করে খাবার শিকার করে। এমন খাদ্যাভ্যাস থেকে হয়তো পিপীলিকাভুক নাম রাখা হয়েছে।
পৃথিবীতে প্রাণীর আগমনের ধারা বিবেচনা করলে বনরুইকে বেশ প্রাচীন প্রাণীর তালিকায় রাখা যায়। মাংসাশী প্রাণী থেকে এদের উৎপত্তি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক জার্মানির প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পিট থেকে মধ্য ইওসিন সময়ের বনরুইয়ের একটি ফসিল খুঁজে পান। এই ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বনরুই আজ থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে।
বনরুইয়ের দেহে সরীসৃপের মতো আঁশ থাকলেও এরা সরীসৃপ নয়, বিশেষ ধরনের বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের দেহের আঁশের ফাঁকে ফাঁকে হালকা লোম থাকে। বনরুই বাচ্চা প্রসব করে, জন্মের পর বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে বড় করে তোলে মা বনরুই। এসব বৈশিষ্ট্য বনরুইকে স্তন্যপায়ীর দলভুক্ত করেছে।
পৃথিবীতে আট প্রজাতির বনরুই দেখা যায়। এর মধ্যে চার প্রজাতির বনরুই আছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে আছে দুই প্রজাতির বনরুই—ইন্ডিয়ান ও চায়নিজ। তবে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান বনরুইয়ের উপস্থিতির নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই। চায়নিজ বনরুই দেশের বেশ কিছু বনাঞ্চলে দেখা যায়। তবে খুবই বিরল। এরা একদিকে নিভৃতচারী, অন্যদিকে নিশাচর। দৈনন্দিন কাজ সবই সম্পন্ন হয় গভীর রাতের অন্ধকারে। ফলে মানুষের সঙ্গে এদের সাধারণত দেখা হয় না।
বুক ও পায়ের ভেতরের দিক ছাড়া বনরুইয়ের পুরো দেহ শক্ত আঁশে ঢাকা থাকে। লেজ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে। লম্বা লেজ দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে সহজেই। ফলে গাছে বিচরণ করতে বেশ পারদর্শী বনরুই। এদের ওজন হয় পাঁচ থেকে সাত কেজি। আঁশের ফাঁকে ফাঁকে পাতলা শক্ত লোম দেখা যায়। মাথা খাটো ও কোণাকৃতির। চোখও বেশ ছোট। কেঁচোর মতো সরু জিব ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাগুলো খাটো। পায়ের আঙুল পাঁচটি, প্রতিটিতে ধারালো নখর থাকে। পিঁপড়ার গর্ত খুঁড়তে বেশ কাজে লাগে নখরগুলো।
বনরুই একা বা জোড়ায় বাস করে। বছরে সাধারণত একটি বাচ্চা প্রসব করে। তবে দুই থেকে তিনটি পর্যন্ত বাচ্চা হতে পারে। বাচ্চারা মায়ের পিঠের ওপর চড়ে বিচরণ করে। জন্মের সময় বাচ্চার আঁশগুলো খুব নরম থাকে। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে। বুনো পরিবেশে বনরুই ঠিক কত বছর বাঁচে, এটি বিজ্ঞানীরা এখনো জানতে পারেননি। চিড়িয়াখানায় ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে।
অন্যান্য বুনো প্রাণীর মতো বনরুই নানা ধরনের জীবাণু ধারণ ও বহন করে। গবেষণা বলছে, বনরুই কয়েক ধরনের করোনাভাইরাস ও সার্স ভাইরাস বহন করে। ফলে বনরুইয়ের সংস্পর্শে এলে মানবদেহে এসব ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। তাই বনরুই ধরা বা মারা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বর্তমানে যেসব প্রাণীর চোরাকারবার চলে, তার মধ্যে এই বনরুই সবার ওপরে। চোরা শিকারিরা বনরুই হত্যা করে এর মাংস, আঁশ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে। প্রথাগত চীনা ওষুধ তৈরিতে এই বনরুইয়ের ব্যবহার বেশ পুরোনো। চীন, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে বনরুইয়ের প্রথাগত ব্যবহার বেশ।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বনরুই পাচার হয় বেশি। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। ২০১৬ সালে সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সাইটিস (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজার্ড স্পিসিজ) সভায় বনরুই–সম্পর্কিত সব ধরনের ব্যবসার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তদুপরি এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন চায়নিজ বনরুইকে মহাবিপন্ন প্রাণী ঘোষণা করে। চোরা শিকার ও বনাঞ্চল ধ্বংস বনরুইয়ের প্রধান হুমকি। আমাদের বনাঞ্চলগুলো থেকেও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বনরুই।
সম্প্রতি আইইউসিএন প্রকাশিত বনরুইয়ের পাচার ও অবৈধ চোরা শিকারের ওপর একটি গবেষণায় রোমহর্ষ তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনমতে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বনরুই চোরা শিকারিরা হত্যা করেছে। এর মধ্যে সাড়ে আট হাজারের মতো এশিয়ান চার প্রজাতির বনরুই। বাকিগুলো আফ্রিকান প্রজাতির। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, বনরুই বিলুপ্তির ঝুঁকির তালিকায় কেন ওপরের দিকে।
পুরোপুরি জানার আগেই হয়তো বিরল এই প্রাণী হারিয়ে যাবে মানুষের এই পৃথিবী থেকে। অপরাপর প্রাণী ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎকে ধীরে ধীরে বিপন্ন করে তুলছি।
এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়