ট্রেনটি কেবল যাত্রী আর মালপত্রে ঠাসা ছিল না, ভরা ছিল উত্তেজনায়, আবেগে। এটি একটি পুরোনো ট্রেন, সেই সব ট্রেনের মতো যেগুলো সৈন্যদের বহন করে, আমরা যুদ্ধের সিনেমায় যেমন ট্রেনে দেখি।
‘যখন থেকে ট্রেনটা বানানো হয়েছে, তখন থেকে আমাদের নিয়ে ছুটছে,’ পাশে বসা পঞ্চাশোর্ধ্ব ডাক্তার প্রতিবেশী আমাকে বললেন। তার কথায় সন্দেহ করার কারণ ছিল না। ট্রেনে ওঠার আগের কিছুই আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। ট্রেনের গর্জনের মধ্যে আমার জাগরণ, তার ঝংকারের মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। ছুটছে অবশ্য দ্রুতই, সময় যেন আমাদের পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
আমার পাশের সঙ্গীর সঙ্গে আমি খুব কমই কথা বলতাম। চামড়ার সিটে পাশাপাশি বসে আমরা কেবল তীব্র ঝাঁকুনির সময় দৃষ্টি বিনিময় করতাম। চারপাশের হট্টগোল, কথার গুঞ্জন আমার কথা বলার ইচ্ছাকে গ্রাস করে নিত। বেশ কয়েকবার বলতে গিয়েও দেখেছি আমার মুখ খোলার আগেই আলো নিভে যায়। অন্ধকারে কথা বলতে পারতাম, নিশ্চয়ই। জোরে কথা বললে তিনি শুনতেনও। কিন্তু অন্ধকারে কথার প্রভাব আলোর মতো হয় না। হঠাৎ অন্ধকার নেমে এলে আমার চিন্তা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তা ছাড়া এমন সময়ে কে বলতে পারে, কেউ কোনো অপরাধ ঘটাবে না?
সামনের দুই প্রতিবেশী—একজন খাটো মোটা, আরেকজন লম্বা টাকওয়ালা—তারা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। লাভ-ক্ষতি, ব্যবসার নীতি, হাতছাড়া না হওয়া সুযোগ, কী করা উচিত, কী উচিত নয়—এসব নিয়ে তাদের কথা থামে না। উচ্চৈঃস্বরে, উত্তপ্ত নিশ্বাসে তারা কথা বলে; পরস্পরের সমঝোতা দৃশ্যমান। তাদের কথায় ছেদ পড়ে না—না হঠাৎ অন্ধকারে, না হট্টগোলে।
তবু আমাকে কথা বলতে হতো। পাশের সঙ্গী ছিলেন সাধারণ ধরনের মানুষ, আমার নীরবতার জবাবে নীরবতা, কথার জবাবে কথা।
‘টানেল,’ তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘টানেলে ঢোকার সময় আলো নিভে যায়। এগুলো এত দীর্ঘ যে.
‘আমি কি এমন সময়ই কথা বলার জন্য বেছে নিলাম?’ আমি বললাম।
‘না, তুমি বেছে নাওনি। এটাই ঘটে।’
প্রতিবার টানেলের কাছাকাছি এলে আমার কথা বলার তাগিদ বেড়ে যায়, যদিও জানতাম না আমরা টানেলের কাছে কি না। যদিও এগুলো টানেলমাত্র, যাত্রীরা তবু এটাকে সহজভাবে নিত না। প্রথমে গুঞ্জন, তারপর চিৎকার, তারপর আলো নিভে যাওয়ার প্রতিবাদ। আমিও সাহস পেয়ে কথা বলতাম। আর তেমনই চলতে লাগল।
ট্রেনটি ছিল বিশাল, একটি শহরের মানুষ ধরার মতো। দৃষ্টিসীমা যত দূর যায়, তত বড়। গ্রামের শীতের রাতের চেয়েও দীর্ঘ। বগি অসংখ্য। প্রতিটা বগি একটা আস্ত ট্রেনের মতো ভারী। যাত্রীরা একে অপরকে চিনত, আর যারা চিনত না—যেমন আমি আর ডাক্তার—তারাও এই যাত্রায় পরিচিত হয়েছে। এ এক কঠিন, দীর্ঘ যাত্রা, আমাদের কল্পনার চেয়েও দীর্ঘ। কখন পৌঁছাব, তা আমরা জানতাম না। শুধু জানতাম, আমাদের ট্রেন তার পথে চলছে। যতক্ষণ চলছে, ততক্ষণ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
মাহমুদ রিমাভিউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
আমার জীবনটা ট্র্যাজেডিতে ভরা
ছবি: দীপু মালাকার