হাওরে প্রবেশ দ্বার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা। এই এলাকার খ্যাতি রয়েছে হাওরের তাজা মাছের জন্য। ধনু নদীর তীরে অবস্থিতি বলিখলা বাজারটিতে এক সময় কোটি টাকার দেশীয় প্রজাতির মাছ বিক্রি হতো। তবে, গত কয়েক বছর ধরে মাছ বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলছেন, প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে এই সংকটের জন্ম হয়েছে। হাওরে দেশীয় মাছের এমন সংকট ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি হতে পারে।

আরো পড়ুন:

সুনামগঞ্জের হাওরে নৌক ডুবে নিখোঁজ ২ 

আত্মীয়র জানাজায় যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে শিশুর মৃত্যু

ভোরের আলো ফোটার আগেই নৌকা ভিড়ত ঘাটে। হাঁকডাকে মুখর হতো বালিখলা মাছ বাজার। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত পলি জমা, অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত স্থাপনা এবং নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের কারণে হাওরে মাছের বিচরণ, প্রজনন ও আবাসস্থল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাছ পাওয়া কমে যাওয়ায় বেচাবিক্রি কমেছে। ফলে জেলেদের চোখে শুধুই হতাশা।

জেলেরা জানান, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ ধরায় ভেঙে যাচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন চক্র। তাই একসময় হাওরে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া গেলেও, এখন সেখানে টিকে আছে ৩০ থেকে ৪০ প্রজাতির মাছ। হাওরে মাছের সঠিক প্রজননের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। 

বালিখলা বাজারে পাওয়া যায়- দেশীয় মিঠা পানির বোয়াল, চিতল, রুই, কাতলা, বাইম ও মৃগেলসহ ছোট মাছ। আরো পাওয়া যায়, বিলুপ্ত প্রায় রানিমাছ, কাজরী, লালচান্দা, নামাবিল, কাশিখয়ারাসহ অনেক প্রজাতির মাছ। 

হাওরে পাওয়া যাওয়া দেশীয় প্রজাতির মাছ

স্থানীয় জেলে লালমোহন বর্মন বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে হাওরে রাইত থেইক্যা (থেকে) ভোর পর্যন্ত জাল ফাইলাইয়া (ফেলে) তেমন মাছ পাই না আমরা। যে মাছ পাই হেইড্যা (সেটা) দিয়া নৌকার তলানিও ভরে না। অহন কইন (বলেন) কেমনে আমরা চলবাম, আর কয়দিনই বা চলবাম।”

ইটনা থেকে আসা জেলে মনির উদ্দিন বলেন, ‍“রাতভর জাল ফেলে যে পরিমাণে মাছ পাই, তা দিয়ে খরচই ওঠে না। পাবদা, চাপিলাসহ আগে যেসব মাছ হরহামেশা পাওয়া যেত, এখন সেগুলো চোখেই পড়ে না।”

জেলে মতিউর মিয়া বলেন, “নৌকা বোঝাই করে মাছ আনতাম একসময়। এখন নৌকার তলায় প‌ড়ে থা‌কে মাছ। সংসার চালাতে হিমশিম খা‌চ্ছি আমরা। অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছেন। অনেকে শহরে যাচ্ছেন, কেউ দিনমজুরি করছেন।”

জেলে ইলিয়াস মিয়া, শামছুদ্দিন, ধীমান বর্মন জানান, কয়েক বছর আগেও এতো ঘাটতি ছিল না মাছের। অনেকেই অসাধু উপায়ে অবৈধ জালে পোনাসহ সব ধরনের মাছ ধরে নেওয়ার কারণে হয়তো এমন হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

বালিখলা বাজারের প্রবীণ আড়তদার নিপেন্দ্র বর্মণ বলেন, “এ বাজারে ৬৫টি আড়ত আছে। আগে প্রতিটি আড়তে দিনে গড়ে ৬-৭ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হতো। এখন অনেকটাই কমে গেছে। ছোট আড়তদাররা বেশি সংকটে আছেন।”

বালিখলা মাছ বাজারের সাধারণ সম্পাদক মো.

সালাউদ্দিন বলেন, “কিশোরগঞ্জসহ সুনামগঞ্জ, খালিয়াঝুড়ি, মোহনগঞ্জ, মদন, নেত্রকোণা ও এর আশেপাশের বিভিন্ন হাওর থেকে বালিখলা বাজারে মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে আসতেন জেলেরা। কোটি টাকার ওপরে মাছ বিক্রি হতো। গত কয়েক বছরে মাছ আসার পরিমাণ এতটাই কমেছে যে, বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে।”

তিনি বলেন, “কমেছে মাছের বিভিন্ন প্রজাতি। অনেক মাছেই এখন আর এই বাজারে চোখে পড়ে না। এটিও সংকট সৃষ্টির একটি কারণ। হাওরে মাছের প্রজনন নিশ্চিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।” 

কিশোরগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, “হাওর নিয়ে আমরা যতটুকু পর্যোলোচনা করেছি, তাতে জানতে পেরেছি; মানব ও প্রকৃতসৃষ্ট কারণই বর্তমান মাছ সংকটের মূল কারণ। সংকট নিরসনে সবাইকে সচেতন হতে হবে। হাওরে মাছের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয় এমন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নদীতে পলি জমে মাছের বিচরণ ও আবাসস্থল যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।” 

তিনি বলেন, “মাছের প্রজাতি রক্ষায় আমরাও অভিযান চালাচ্ছি। অবৈধ জাল জব্দ করছি। মাছের উৎপাদন যাতে বাড়ানো যায় সেজন্য চালানো হচ্ছে নানা কর্মকাণ্ড। শুধু প্রশাসনের পক্ষে এটা সম্ভব নয়, স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে।”

২০২২-২৩ অর্থবছরে কিশোরগঞ্জ জেলায় মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে হাওর থেকে এসেছে ২৮ হাজার ০২০ টন, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ জেলার বার্ষিক মাছের চাহিদা ৭০ হাজার ৫৩০ টন।

উৎপাদনের সংখ্যাটি এখনও সন্তোষজনক মনে হলেও হাওরভিত্তিক মাছের সরবরাহ প্রতিবছর কমছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে চাহিদা পূরণে হাওরের ওপর নির্ভর করা কঠিন হয়ে পড়বে। হাওরেই লাখো জেলের জীবিকা-স্বপ্ন সবটাই জড়িয়ে আছে মাছের সঙ্গে। হাওর বাঁচলে, মাছ বাঁচবে। আর মাছ বাঁচলে, বাঁচবে হাওরের ঐতিহ্য। জেলেরা চান এ জন্য সরকারি সহায়তা।

ঢাকা/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হ ওর ক শ রগঞ জ প রজনন

এছাড়াও পড়ুন:

বরিশালে মা ইলিশ নিধন ঠেকাতে পাহারায় থাকবে ড্রোন

ইলিশের প্রজনন মৌসুম নির্বিঘ্ন রাখতে এবং মা ইলিশ সুরক্ষায় দেশের সবচেয়ে বড় ইলিশের অভয়াশ্রম বরিশালের মেঘনাসহ সন্নিহিত নদ-নদীতে ড্রোন দিয়ে নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে মৎস্য বিভাগ।

এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার মধ্যরাত থেকে ইলিশের প্রজনন মৌসুমকে ঘিরে দেশের সব নদ-নদী ও সাগরে শুরু হয়েছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। তা বলবৎ থাকবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ে ইলিশ ধরা, বিপণন, পরিবহন ও মজুত দণ্ডনীয় অপরাধ।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে বরিশালের হিজলা, মুলাদী, মেহেন্দীগঞ্জ, চাঁদপুরের হাইমচর থেকে শুরু করে ভোলার তেঁতুলিয়া পর্যন্ত নদ-নদী, মেঘনা অববাহিকা ও শাখানদীগুলোয় ছোট ছোট নৌকা নিয়ে প্রতিবছর ইলিশ শিকার করেন স্থানীয় কয়েক হাজার জেলে। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয় মৌসুমি জেলেরাও।

মৎস বিভাগ সূত্র জানায়, এবার এই তৎপরতা রোধে মৎস্য বিভাগ প্রথম প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে মাঠে নামবে। মাছ ধরা ঠেকাতে বরিশালের মেঘনা নদীর ৮২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে আকাশে নজরদারির জন্য ড্রোন ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া জেলার নদ–নদীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে যৌথ বাহিনীর তৎপরতা থাকবে কঠোরভাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব পয়েন্টে অবস্থান নেবেন। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকেও অভিযানে যুক্ত করা হবে। সঙ্গে থাকবেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক। নিষিদ্ধ সময়ে কেউ মাছ ধরলে তাঁকে দণ্ড দেওয়া হবে।

এ তথ্য নিশ্চিত করে হিজলা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম জানান, এই অভিযান কেবল নদীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, হাটবাজার, লঞ্চ ও বাস টার্মিনালগুলোতেও তল্লাশি ও নজরদারি চলবে।

মোহাম্মদ আলম বলেন, অভিযান পরিচালনার জন্য মাঠে থাকবেন ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। যৌথ বাহিনীতে কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা থাকবেন। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক স্পিডবোট নিয়ে টহলও চলবে।

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওমর সানি বলেন, ‘মা ইলিশ রক্ষায় আমরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম করেছি। এবার সর্বশক্তি দিয়ে অভিযান পরিচালিত হবে।’

মা ইলিশ সংরক্ষণে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম বাস্তবায়ন উপলক্ষে কীর্তনখোলা নদীতে নৌ শোভাযাত্রার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন ও জেলা মৎস্য দপ্তর। শনিবার সকালে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নৌবাহিনী
  • বরিশালে মা ইলিশ নিধন ঠেকাতে পাহারায় থাকবে ড্রোন
  • মা ইলিশ রক্ষায় বরিশালে অভিযান শুরু
  • পাশ্ববর্তী দেশের জেলেদের আগ্রাসন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি