‘বাণিজ‍্যে বসতে লক্ষ্মী’—বাংলার একটি প্রাচীন প্রবাদ। একসময় বাঙালি বণিক সম্প্রদায়ের লোকজন সমুদ্রপথে নৌকা করে দূরদেশে বাণিজ‍্য করতে যেতেন বলে এই প্রবাদের সূচনা। এরপর যুগে যুগে সামাজিক, রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক—বহু পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে এই শস‍্যশ‍্যামল বঙ্গদেশে। ফলে এই প্রবাদের মূল লক্ষ‍্যেও পরিবর্তন হয়েছে।

কারণ, কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রারও আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে গত দেড় শ বছরের ইতিহাসে। তবু এই প্রবাদের অন‍্যতম মূল সূত্র ‘লক্ষ্মী’র লক্ষ‍্যে আজও নতুন প্রজন্ম আশাবাদী। তাই আজও বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের প্রায় প্রতিটি ঘরেই লক্ষ্মীর আবাহন জারি রয়েছে।

লক্ষ্মী মূলত ধনসম্পদের দেবী। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে বঙ্গভূমিতে লক্ষ্মীপূজার ব‍্যাপক প্রচলন ছিল। তখন বাংলার ঘরে ঘরে শস‍্যকে লক্ষ্মীর প্রতীকরূপে কলার বেড়কে পূজা করা হতো।

যদিও বাংলার বিখ‍্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বস্তুত দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজগরী উৎসবের সহিত লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোন সম্পর্কই ছিল না।’ এ প্রসঙ্গে আরও জানা যায়, লক্ষ্মীর পৃথক প্রতিমাপূজা খুব প্রচলিত নয়। ‘এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি, শস‍্য-প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী ধান‍্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা।’

লক্ষ্মী আসলে শ্রী ও সুরুচির প্রতীক। বৈদিক যুগে মহাশক্তি রূপে পূজিত হলেও আজ তিনি সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী।

আরও পড়ুনশারদীয় দুর্গোৎসব শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়১৭ অক্টোবর ২০২৪

বাঙালি হিন্দুদের মধ‍্যে লক্ষ্মীর সমাদর সারা বছর চালু ছিল এবং আছেও। বছরের সব সময়ই এই দেবী পূজিত হন ঘরে ঘরে।

বাঙালি হিন্দু পরিবারের ঘরে উঁকি দিলেই দেখা যাবে লক্ষ্মীর সযত্ন আসনের, যেখানে থাকে একটি ঘট, সিঁদুরের কৌটা, কাঠ বা পিতলের প্যাঁচা, কড়ি, ধানের ছড়া ও দেবীর ছবি। প্রতি বৃহস্পতিবার গৃহস্থ পরিবারের গৃহবধূটি সুর করে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেন।

তবে নিত‍্যদিনের এই লক্ষ্মীবরণ ছাড়াও বছরের নানা সময়ে লক্ষ্মীকে বিশেষভাবে পূজা করা হয়। যেমন ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার হয় ভাদ্রলক্ষ্মী পূজা, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, কার্তিকের দীপান্বিতা অমাবস‍্যায় মহালক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।

আসলে গ্রামবাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার সম্পর্ক গভীর। কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

একইভাবে অঘ্রান, পৌষ ও মকরসংক্রান্তিতেও লক্ষ্মীপূজার আয়োজন হতে দেখা যায়। তবে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে আশ্বিনের শারদপূর্ণিমা তিথির কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার প্রচলন সর্বাধিক।

সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ এই পূজায় অংশগ্রহণ করেন। আসলে গ্রামবাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার সম্পর্ক গভীর। কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ফলে লক্ষ্মীপূজার আচার ও রীতি পালনে দেখা যায় ধানের গোলা পর্যন্ত দেওয়া আলপনায় ধানের ছড়া, ধানের শিষের প্রতীকী চিহ্ন, সঙ্গে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। সাধারণত সূর্যাস্তের পর পূর্ণিমা তিথিতেই পূজা করা হয়ে থাকে। একসময় লক্ষ্মীপূজা করা হতো সরা, কলার বেড় ও নবপত্রিকায়।

আরও পড়ুনআলোর উৎসবের দিন দীপাবলি৩১ অক্টোবর ২০২৪

প্রতিমাপূজার চল আগে ছিল না। কলার বেড় তৈরি হতো ধান, হলুদ, মানকচু, তুলসী ও আখের ডগা দিয়ে। সেগুলোকে বেড় দিয়ে বেঁধে নতুন বস্ত্র পরিয়ে বেদিতে বসিয়ে পূজা করা হতো।

আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথির এই পূজাকে কেন ‘কোজাগরী’ বলা হয়, তার উত্তরে জানা যায়, কোজাগরী শব্দের ব্যুৎপত্তি ‘কো জাগতি’ থেকে। অর্থাৎ ‘কে জেগে আছ?’ এখানে দেখা যায়, যাঁর ধনসম্পত্তি কিছুই নেই, তিনি পাওয়ার আশায় জাগেন, আর যাঁর ধনসম্পত্তি আছে, তিনি হারানোর ভয়ে জেগে থাকেন। উভয়ের জন‍্যই রাত জাগা এখানে প্রাধান্য।

বাংলার প্রধান শস‍্য ধান। ধানের ছড়া তাই লক্ষ্মীর অন‍্যতম প্রতীক। ধান বা অন‍্যান‍্য শস‍্যজাত খাদ‍্যের অপচয় তিনি অপছন্দ করেন।

শাস্ত্রে বলে, ধনসম্পত্তি ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী এই শারদপূর্ণিমার রাতে স্বর্গ থেকে মর্ত‍্যে নেমে আসেন বাংলার বুকে। তিনি যাঁদের বাড়ির দরজা খোলা পান, তাঁদের ওপর প্রীত হয়ে আশীর্বাদ করেন। বন্ধ দুয়ারের ঘরে তিনি প্রবেশ করেন না। দেবীর আসার অপেক্ষায় গৃহস্থরা রাত জেগে বসে থাকেন।

ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদের অপেক্ষায় থাকা বাঙালি হিন্দুরা তাই রাত জেগে আরাধনা সেরে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। অনেকে মনে করেন, দেবী লক্ষ্মী এই বসুন্ধরাকে ধনধান‍্যে ভরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ‍্যে পূজা গ্রহণ করতেই মর্ত‍্যে নেমে আসেন এই সময়ে।

শস‍্যসম্পদের দেবী যেহেতু লক্ষ্মী, তাই তাঁর বাহনরূপে প্যাঁচার ভূমিকাটির বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা মনে করেন। বাংলার প্রধান শস‍্য ধান। ধানের ছড়া তাই লক্ষ্মীর অন‍্যতম প্রতীক। ধান বা অন‍্যান‍্য শস‍্যজাত খাদ‍্যের অপচয় তিনি অপছন্দ করেন।

ধানের খেত বা গোলায় ইঁদুর এই শস‍্যের খুব ক্ষতি করে। এদিকে প্যাঁচার খাদ‍্য হলো ইঁদুর। প্যাঁচা তাই ইঁদুর বিনাশ করে খাদ‍্যশস‍্য রক্ষায় সহায়তা করে। লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে প্যাঁচার উপস্থিতি তাই তাৎপর্যপূর্ণ।

আরও পড়ুনধর্ম–সম্প্রদায়ের পরিচয় ছাপিয়ে আনন্দই যেখানে মুখ্য ০১ অক্টোবর ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: লক ষ ম প জ র ই লক ষ ম র লক ষ ম র প প রব দ

এছাড়াও পড়ুন:

আর্জেন্টিনার উৎসবের রাতে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ ব্রাজিল, ইতিহাসে প্রথম

জয় ছাড়া বিকল্প ছিল না। আর গোল ছাড়া জেতাও যায় না।

স্পেনের বিপক্ষে ‘বাঁচা-মরার’ ম্যাচে এই গোলটাই পেল না ব্রাজিল। উল্টো হজম করেছে। গতকাল রাতে চিলির সান্তিয়াগোয় ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে স্পেনের কাছে ১-০ গোলে হেরেছে ব্রাজিল।

এই হারে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-২০ দল। আসরের পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নিল এই প্রথম। একই রাতে গ্রুপসেরা হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দল।

চিলির ন্যাশিওনাল জুলিও মার্তিনেজ স্টেডিয়ামে ব্রাজিল ‘সি’ গ্রুপের শেষ ম্যাচটি খেলতে নেমেছিল দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায়। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর সঙ্গে ২-২ ড্র আর মরক্কোর কাছে ২-১ ব্যবধানের হারে হাতে ছিল মাত্র এক পয়েন্ট। স্পেনও এক ড্র এক হারে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছিল। দুই দলের জন্যই ছিল ‘ডু অর ডাই ম্যাচ’।

খেলায় দুই দলই ছিল আক্রমণাত্মক। ব্রাজিল ১৪টি এবং স্পেন মোট ১৩টি শট নিয়েছে। তবে ব্রাজিলের (৩) তুলনায় স্পেনের শট লক্ষ্যে ছিল বেশি (৬)। ৪৭তম মিনিটে তেমনই এক শটে স্পেন এগিয়ে যায় ইকার ব্রাভোর গোলে। শেষ পর্যন্ত এই গোল সম্বল করেই ম্যাচ জিতেছে স্পেন।

ম্যাচ জিতেও অবশ্য স্পেনের পরের পর্বে ওঠা নিশ্চিত হয়নি। ‘সি’ গ্রুপ থেকে ৬ ও ৫ পয়েন্ট নিয়ে শেষ ষোলোয় উঠেছে মরক্কো ও মেক্সিকো। ২৪ দলের টুর্নামেন্টে ৬ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপের সঙ্গে পরের পর্বে খেলবে সেরা চার তৃতীয় স্থানধারী। স্পেন আপাতত সেই তালিকায় থেকে অপেক্ষায় থাকল।

ব্রাজিলের সবচেয়ে বাজে

ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিচ্ছে তিন ম্যাচে দুই হার এক ড্রয়ের হতাশাকে সঙ্গী করে। ১৯৭৭ সালে ফিফা যুব চ্যাম্পিয়নশিপ হিসেবে চালু হওয়া অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে এবার নিয়ে ২০তম বার খেলল ব্রাজিল। আগের ১৯ অংশগ্রহণে ৫ বার চ্যাম্পিয়ন এবং চারবার রানার্সআপ হয়েছে দলটি। সবচেয়ে বাজে ফল ছিল ২০০৭ আসরে—দ্বিতীয় রাউন্ড। এবার তা ছাপিয়ে গ্রুপ পর্বে চতুর্থ হয়ে বিদায়।

আর্জেন্টিনা গ্রুপসেরা

‘ডি’ গ্রুপে থাকা আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দল প্রথম ম্যাচে কিউবাকে ৩-১ আর দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে আগেই শেষ ষোলোর পথে এগিয়েছিল।

গতকাল রাতে ইতালিকে ১-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপসেরা হয়েছে দলটি। ৭৪ মিনিটে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন গোরোসিতো।

‘ডি’ গ্রুপে আর্জেন্টিনার পয়েন্ট ৯, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইতালির ৪। অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ৬ বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা সর্বশেষ দুই আসরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল। দলটি সর্বশেষ শিরোপা জিতেছে ২০০৭ সালে।

এ ছাড়া ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের শেষ ষোলো নিশ্চিত করেছে ‘এ’ গ্রুপ থেকে জাপান ও চিলি এবং ‘বি’ গ্রুপ থেকে ইউক্রেন ও প্যারাগুয়ে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রবারণার আমেজ নেই রামেসু এলাকায়
  • পটুয়াখালীতে চলছে প্রবারণা উৎসব
  • প্রবারণা পূর্ণিমা আজ
  • কানাডা যাচ্ছে নাঈম–আইশার শেকড়ের গল্প
  • সিডনিতে নুহাশের ‘ওয়াক্ত’
  • ‘ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে’ উদযাপনে প্রস্তুত বান্দরবান 
  • সহজ হোক কিংবা কঠিন, হামাসকে নিরস্ত্র হতেই হবে: নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি
  • আর্জেন্টিনার উৎসবের রাতে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ ব্রাজিল, ইতিহাসে প্রথম
  • কয়েক দিনের মধ্যেই জিম্মিদের মুক্তির প্রত্যাশা নেতানিয়াহুর, আলোচনার জন্য কায়রোর পথে প্রতিনিধিরা