কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ভাবুক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন সাপ্তাহিক ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’, ‘গণপ্রতিরক্ষা’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহেরীন আরাফাত।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এ দেশের মানুষ কার্যত গোটা রাষ্ট্রকেই খারিজ করেছে―আপনি নিজেও তা বলেছেন। কিন্তু এক দোর্দ-প্রতাপশালী ফ্যাসিস্ট শাসকের পতনের পরও গণঅভিপ্রায় পূর্ণতা পায়নি। আপনার মতে এর প্রধান কারণ কী?

ফরহাদ মজহার: প্রথমত, পাঁচ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান হয়েছে এবং আট তারিখ একটা সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটেছে। সেটা তো আমরা শুরু থেকেই বারবার বলেছি। এতো বিশাল আত্মত্যাগের পরও কেন গণঅভিপ্রায় পূর্ণতা পায়নি তার কারণগুলো আমাদের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা বলছিও বটে। শুরুর দিকে যে অস্পষ্ট ছিল, তা নয়। আমরা ভেবেছি, বাধা কাটিয়ে ওঠা যাবে। গণঅভ্যুত্থানের যে শক্তি আমরা দেখেছিলাম, সেই শক্তি সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনার প্রমাণ হিশাবে হাজির ছিল। 

গণঅভ্যুত্থান লক্ষ্যে না পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে―এক.

সমাজের বুদ্ধিভিত্তিক পশ্চাতপদতা। যেমন আমাদের সমাজে রাষ্ট্র এবং সরকারের ধারণা অত্যন্ত দুর্বল; দুই. রাষ্ট্র গঠন আর সরকার নির্বাচন―এই দুটো যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য, এটাও অস্পষ্ট। এই অস্পষ্টতা অত্যন্ত গভীর; এখানে আমি সাধারণ জনগণের কথা বলছি না। এটা বলছি সমাজে যারা শিক্ষিতশ্রেণী, সমাজে যারা পড়াশোনা করে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা তথাকথিত বামপন্থীদের ব্যাপারে; বিশেষভাবে। ইসলামপন্থিদের কাছে আমরা তা আশা করিনি। কিন্তু যারা নিজেদের সেকুলার, শিক্ষিত এবং সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতন দাবি করে তাদের চিন্তার দৌড় এতো নি¤œমানের সেটা আগে বোঝা যায়নি। গণঅভ্যুত্থান, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিদেনপক্ষে তাদের যে ন্যূনতম ধারণা আছে বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম তার মারাত্মক অভাব আমরা দেখেছি। 

গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেলে কীভাবে নতুন রাষ্ট্র গড়তে হয় সেটা আমি ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’ এবং ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’ বইয়ে আলোচনা করেছি; কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা সমাজে যেমন অস্পষ্ট তেমনি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া জনগণের গাঠনিক ক্ষমতাকে কীভাবে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দিতে হয় সে সম্পর্কে আমাদের সমাজে ধারণা অত্যন্ত দুর্বল। 
বামপন্থীদের ইসলামবিদ্বেষী প্রতিক্রিয়াশীলতা বাদ দিলেও আশা করেছিলাম রাষ্ট্র সম্পর্কিত একটা কিছু অনুমান তাদের রয়েছে, কিছু রাষ্ট্রচিন্তা রয়েছে, কিছু রণকৌশলগত দিকও আছে লেনিনের রাষ্ট্রনীতিতে। তবে বাংলাদেশে তো আসলে ‘বামপন্থা’ নামে যা আছে, তা চরম প্রতিক্রিয়াশীল পেটিবুর্জোয়া বিকৃতি। এরা শূন্যে হাওয়ায় বাস করে। আজগুবি! ব্যবহারিক রাজনীতির কোনো খবর নাই। কারণ জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। তারা মৌলবাদী ইসলামি শক্তি আবার ক্ষমতায় এলো কিনা সেই ইসলামবিদ্বেষী সিজোফ্রেনিয়ায় কাতর। তত্ত্বগতভাবে এত দুর্বলতা...। অথচ নেতৃত্ব থাকুক বা না-থাকুক বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান অবশ্যই বামপন্থারই বিজয়। বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে তার ঝা-া বাংলাদেশের জনগণের হাতে পৌঁছে গেছে। গণঅভিপ্রায়, গাঠনিক ক্ষমতা, নতুন রাষ্ট্র গঠন করবার কর্তব্য―সবই তো গণপন্থী কর্মসূচি। তত্ত্ব ও ব্যবহারিক রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে সমাজের বুদ্ধিজীবীশ্রেণীর অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য তরুণদের বিভ্রান্ত করা অত্যন্ত সহজ হয়েছে।

কীভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে? ধরুন, একজন তরুণকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, সংবিধান ছাড়া রাষ্ট্র কী করে চলে?’ সে তো আসলে রাষ্ট্রতত্ত্বের বই সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতন না বা পড়াশোনা করে নাই। সে লড়েছে, বুক পেতে দিয়েছে বুলেটের সামনে। আপনি তার কাছে এর চেয়ে বৃহৎ আর কি চান? আর কী আশা করবেন? কিন্তু, একইসঙ্গে ভাবুন, তাকে যখন বোঝানো হয়েছে, ‘না, না, যারা এই নতুন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে, তারা বিপ্লবের কথা বলে, তারা সহিংসতার কথা বলে, তারা নৈরাজ্যের কথা বলে। আমাদের এখন দরকার ‘স্থিতিশীলতা’।’ এই ‘স্থিতিশীলতা’ শব্দটাই চরম গণঅভ্যুত্থানবিরোধী ও গণবিরোধী ধারণা ও লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীর মতাদর্শিক অস্ত্র। তাদের কাছে গণঅভ্যুত্থান হলো অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি― অতএব দরকার তাদের শ্রেণীর সাংবিধানিক শাসন ও নিয়ন্ত্রণ। আমাদের সমাজের লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীর এই মূল মতাদর্শিক বয়ানের বিপরীতে দাঁড়াবার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি জনগণের পক্ষে ছিল না। ফলে শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষা করে একটি সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছে। লুটেরা-মাফিয়া ও ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে এই সাময়িক পরাজয়ের পর আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা বা বুদ্ধিভিত্তিক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা সবার আগে জরুরি। 

দুই. লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণী স্থিতিশীলতার পক্ষে মতাদর্শিক বয়ান তৈরি করেছে আবার অন্যদিকে, আরেক স্বার্থান্বেষী পক্ষ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পক্ষে সংবিধান রক্ষা করে বিদ্যমান ব্যবস্থা যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখবার কথা বলে, তাদের দাবি শেখ হাসিনার সংবিধানকেই রাখতে হবে, অর্থাৎ শেখ হাসিনা না থাকলেও তার ভূত থাকবে; ক্ষমতার লড়াইয়ে এই পক্ষে একটা শক্তি সামনের কাতারে এসে গেল এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনে তা কার্যকর করতে পারল। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার জন্য উপদেষ্টারা শপথ নিচ্ছেন প্রেসিডেন্টের কাছে। তার মানে, পুরানা রাষ্ট্র ব্যবস্থা আপনি অক্ষতই রাখলেন। শুধু ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’ মার্কা রাজনীতিটাই বাস্তবায়ন করলেন। সামরিক শাসক এরশাদকে সরিয়ে ঠিক যেমন করেছি, সেই পুরানা জিনিসই বাস্তবায়ন করা হলো।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যেটা আমরা খুব কম আলোচনা করেছি, সেটা হলো শ্রেণী এবং শ্রেণী রাজনীতির প্রশ্ন। এই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের জায়গায় যারা ছিল, বা যারা মূলত নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারা পেটি-বুর্জোয়াশ্রেণী। তাদের প্রতিনিধি ছাত্ররা মূলত চেয়েছে সরকারি আমলা হতে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মানে কী? মুক্তিযোদ্ধার কোটা কমাও, আমাদের চাকরি নাই, আমাদের চাকরি দাও, আমাদের আমলা বানাও―এটাই ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের অর্থনৈতিক দাবির মূল কথা। 

এটা বাস্তবতাও বটে। বেকারত্বের জন্য তরুণদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের চোখের সামনে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না, ফলে কোনো কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না, প্রযুক্তির প্রতি অতিনির্ভরতা কর্মসংস্থান থেকে মানুষজন বিতাড়িত করছে। অর্থনৈতিক প্রশ্নটা পেটি-বুর্জোয়াশ্রেণীর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচ্ছন্ন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে আমাদের বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কাছাখোলা অবাধ বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। পেটি-বুর্জোয়াশ্রেণী সেই লড়াই করতে রাজি না। সে স্যুট-টাই পরে বহুজাতিক কর্পোরেশনের গোলাম হতে রাজি। নইলে তারা চায় রাষ্ট্রের চাকরি, কারণ আমলার চাকরি ঘুষ-দুর্নীতির জন্য লোভনীয়। তাই তাদের দাবি কোটা ব্যবস্থা দ্বারা হাসিনা যেভাবে তার বশংবদ সুবিধাভোগীশ্রেণী তৈরি করছে সেই কোটাব্যবস্থা বাদ দাও। আমাদের নাও। আমরা রাষ্ট্রের চাকরি করব, মানে আমরা আমলা হব, আমলাদের চাকরি করব। আমলারা শুধু ক্ষমতাবানই না, তারা একইসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ টাকা লুট করতে পারে বিভিন্ন প্রকার রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের দ্বারা। এখন আমলা না হলে এমনকি কেউ মেয়েও বিয়ে দিতে চায় না। আপনি যদি যথেষ্ট ভালো প্রেমিকও হন, আপনাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করতে পারে যদি আপনি আমলা হতে না পারেন। এই হলো পেটি-বুর্জোয়া রোমান্টিকতারও পরিণতি। পেটি-বুর্জোয়া আকাক্সক্ষার সীমা অতটুকুই। তাদের অর্জনও আছে। তারা উপদেষ্টা হয়েছে, এখন নির্বাচনবাদী রাজনীতি করছে, লুটপাটতন্ত্রের রাজনীতির ময়দানে তারা জায়গা করে নিচ্ছে। 
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পেছনে পেটি-বুর্জোয়া চেতনা ছিল, গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-তরুণদের বিপুল অবদান থাকলেও সেটা অস্বীকার করতে পারবেন না; তার শক্তি ও সম্ভাবনাকেও অস্বীকার করা যাবে না। ৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর এই প্রতিবিপ্লবী, পেটি-বুর্জোয়া চেতনাটাই প্রতিবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে আরও শক্তিশালী হয়েছে। এটা শ্রেণীগত কারণেই ঘটেছে, শ্রেণীর প্রশ্নটা বুঝলে গণঅভিপ্রায় কেন পূর্ণতা পায়নি তার কারণ আমরা খুঁজে পাব।

কিন্তু শ্রেণী প্রশ্নের আরেকটা দিক আছে। এই গণঅভ্যুত্থানে সত্যি সত্যি অনেক গরিব মানুষ যুক্ত ছিল। অনেক গরিব মানুষ, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে একেবারে রাস্তার গরিব মানুষ যুক্ত ছিল। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্বটা ছিল পেটি-বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতে। অন্যদিকে আন্দোলনে শ্রমিক এবং কৃষক অনুপস্থিত বা অদৃশ্য। শ্রমিকশ্রেণী নাই, কৃষকেরা নাই। ফলে পেটি-বুর্জোয়াশ্রেণীর অভ্যুত্থান হবার কারণে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, এই গণঅভ্যুত্থানটা রাষ্ট্র গঠনের কর্তব্য বাদ দিয়ে সহজে একটি সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন এবং নির্বাচনবাদী রাজনীতির ধারায় চলে গিয়েছে। 

তবে একটা কথা আমি খুব পরিষ্কার বলতে চাই, ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার বই ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’; গণঅভ্যুত্থান সফল না হলেও গণঅভ্যুত্থান ও গঠনের চিন্তাটা আমাদের সমাজে এসে গিয়েছে। আমাদের সমাজ এখন এই গঠনের চিন্তা বা গাঠনিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে নাই এবং এই চিন্তা ছড়াচ্ছে। আমরা গ্রামে যাচ্ছি, বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছি। মানুষের বক্তব্যে তার প্রকাশ ঘটে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুটো ধারায় বিভক্ত। এই বিভক্তি ক্রমশ আরও স্পষ্ট হবে। একটি ধারার নাম হলো― গঠনের রাজনীতি, যাকে সহজ ভাষায় ব্যবহারিক রাজনীতির ভাষায় আমরা বলতে পারি গণরাজনৈতিক ধারা; আরেকটি ধারা লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীর নির্বাচনবাদী ধারা। এই দুই ধারার সংঘাত, এই দুই ধারার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। এটা আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। ফলে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান হতে পারে। তার সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রস্তুত। জনগণ যদি তাদের অভিপ্রায়কে মূর্ত না দেখে, বাস্তবায়িত হতে না দেখে, তারা অবশ্যই থেমে থাকবে না। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা জনগণ অবশ্যই তাদের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের ভিন্ন রাজনৈতিক পথ খুঁজবে। এটাই তো স্বাভাবিক। 

অভ্যুত্থানের সময় জনগণের মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, কিছুদিনের মধ্যেই সেটি ভেঙে পড়ে। তারপর শুরু হয় মাজার, খানকা, আখড়া ইত্যাদি জায়গায় হামলা। এসব হামলার বিরুদ্ধে আপনি প্রথম থেকেই সরব ছিলেন। সরকার কেন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো বলে মনে করেন? রাজনৈতিক দলগুলোও সেভাবে পদক্ষেপ নেয়নি, এর কারণ কী?

ফরহাদ মজহার: মাজার ভাঙার প্রসঙ্গে আমি বলব যে, সেকুলার ফ্যাসিস্ট, যাকে আমরা ‘বাঙালি জাতিবাদী ধারা’ বলি, তারাই এতকাল মাজারগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। মাজারকে ইসলামপন্থিদের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। সেকুলার ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনের পর স্বভাবতই একটা প্রতিক্রিয়া ছিল অনিবার্য। এর বিপরীতে ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ছিল অনিবার্য। মাজার ভাঙচুরকে সেই আলোকে দেখতে হবে। জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনের পর ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির হাজির হওয়াটা ছিল অনিবার্য। এটা রাজনীতির মধ্যে নিহিত ছিল। এই ধারা আধুনিক জাতিবাদ থেকে আলাদা কিছু না। একই মূদ্রার অপর পৃষ্ঠা। সেকুলার জাতিবাদের বিপরীতে আমরা এই ধারাকে বলি ধর্মীয় জাতিবাদ। এই প্রতিক্রিয়া ঘটবে এটা সরকারের জানার কথা। সরকারের উচিত ছিল যথাযথ প্রস্তুতি রাখা। কিন্তু আমরা জানি, পুলিশ বাহিনীকে দাঁড় করাতে পারেনি সরকার। পুলিশ সংস্কার যে ড. ইউনূস করেননি তার কোনো যুক্তি নাই। কেন আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থাকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে সেটা অত্যন্ত সন্দেহজনক। নতুন পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি তো জানেন, পুলিশ মাত্রই পুরনো রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করেছে এবং জনতার বুকে গুলি চালিয়েছে। 

এর একটা যুক্তি আমি এভাবে দেখি―ড. ইউনূস একটা কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে। এই বহুজাতিক কর্পোরেট স্বার্থের দাপট বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না। না মেনে নেওয়ার ফলে স্বভাবতই আরেকটা সংঘাত তৈরি হবে। হয় তার আমলে অথবা তিনি চলে যাওয়ার পরে যে সরকারই আসুক না কেন, সেটা ঘটবেই। সে ক্ষেত্রে স্বভাবতই কোনো না কোনো পরাশক্তির একটা পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে যে পুলিশকে তারা ব্যবহার করবে। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা দেখছি, তা আমাদের আশ্বস্ত করছে না যে, তারা সত্যিকার অর্থে পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে চান বা রাখছেন। ফলে মাজার ভাঙার পেছনেও এই পুলিশি দুর্বলতা কাজ করেছে।

আরেকটা বড় কারণ হিন্দুত্ববাদী শক্তি এবং ইজরায়েলি জায়নবাদী শক্তি বাংলাদেশে অত্যন্ত সক্রিয়। এই শক্তি দুটো পর্যায়ে কাজ করে। একটা পর্যায়ে হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদ ইসলামপন্থীদের দ্বারা ইসলামকে এমনভাবে হাজির করতে চায় যাতে এটা প্রমাণ করা যায়―ইসলাম একটা পশ্চাতপদ, অসভ্য, নারী নির্যাতনকারী বর্বরদের ধর্ম। ইসলাম স্বাধীন চিন্তা, বিবেক ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, ইসলাম কোনো সংস্কৃতি তৈরি করতে অক্ষম এবং ইসলাম মানে হচ্ছে, গান গাওয়া হারাম; সাংস্কৃতিক কর্মকা- হারাম। ধর্মনির্বিশেষে, আস্তিকতা-নাস্তিকতা নির্বিশেষে স্বাভাবিক সামাজিকভাবে নারীপুরুষ মেলামেশা করা হারাম। গণমাধ্যমে ইউটিউবে দেখবেন ইসলামকে যেভাবে ইসলামপন্থিরাই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছেন সেটা ইসলাম সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদী বা জায়নবাদী প্রচারেরই প্রতিধ্বনি।

গণপরিসর হিশাবে মাজার, দরগা, আখড়া, আশ্রম ইত্যাদিকে দেখুন। এরা মন্দির, মসজিদ, মঠ না। এখানে আপনি আস্তিক হতে পারেন, নাস্তিক হতে পারেন, মুসলমান হতে পারেন, হিন্দু হতে পারেন, বৌদ্ধ হতে পারেন, খ্রিস্টান হতে পারেন, কিন্তু মাজার সকলের জন্য উন্মুক্ত। মসজিদ তো সকলের জন্য না; মন্দিরও না। মঠ তো সকলের জন্য না। ফলে মাজার, দরগা, আখড়া, আশ্রমের যে চরিত্র তা ধর্মস্থান নয়, কিন্তু আবার ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব থেকে আলাদাও নয়। পাশ্চাত্যে ধর্ম বনাম সেকুলারিজমের যে বিভক্তি আমরা দেখি, আমাদের সমাজে ধর্ম থেকে নিজেদের বিযুক্ত করবার কোনো ঐতিহাসিক কারণ ছিল না। কারণ পাশ্চাত্যে চার্চ বা গির্জা যেভাবে সার্বভৌম ক্ষমতা ও জমি-জিরাতের মালিক ছিল আমাদের মসজিদ, মন্দির তো গির্জা ছিল না। পাশ্চাত্যে ধর্ম থেকে দর্শন আলাদা হয়েছে, বিজ্ঞান আলাদা হয়েছে। আমাদের ইতিহাস ভিন্ন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে ভাববার ব্যাপার আছে।

যে দিকটার প্রতি আমি বিশেষভাবে জোর দেব সেটা হলো― মাজারের যে রাজনৈতিক চরিত্র, সেটা গণতান্ত্রিক। মাজার ধর্ম বা বিশ্বাস নির্বিশেষে সকলকেই ধারণ করে। গণতন্ত্রের যে রূপ আমরা মাজারে দেখি তা নস্যাৎ করাটা মূলত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করার সামিল। কারণ মাজার মাইক্রোসম বা ছোট রূপে, নিজের পরিসরে সামাজিক গণপরিসর নির্মাণের প্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্রের শক্তিশালী ভিত্তি। ফলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অত্যন্ত মূর্তরূপ হলো মাজার, যেখানে ধর্ম, বিশ্বাস, মতাদর্শ নির্বিশেষে যে কেউ যেতে পারেন। মাজার আমাদের গণতান্ত্রিক সামাজিকতার অত্যন্ত শক্তিশালী গণপরিসর।

আপনার মনের যে আকুতি, মানুষ হিসেবে আমাদের সার্বজনীন যে সকল বিষয়, যাকে ইংরেজিতে মেটাফিজিকস, বাংলায় আধ্যাত্মতত্ত্ব বা দর্শন বলে, মাজার সেই দিক থেকে দর্শন বা ভাবচর্চার জায়গা। যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ভাবি―আল্লাহ কী? আমরা কোথা থেকে এসেছি? পৃথিবী কেন একদিন শেষ হবে? আখিরাত আছে কিনা? এই জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব খোঁজার যে স্বাভাবিক আকুতি মাজার তা ধারণ করে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে মাজারের দ্বন্দ্ব অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আমাদের নীতি, নৈতিকতা এবং দর্শনের প্রশ্ন―এটা মাজারে তোলা হয়। ধর্মতত্ত্ব যে জিজ্ঞাসাকে দাবিয়ে রাখে, মাজার সেই জিজ্ঞাসাকে মোকাবিলা করে এবং উত্তর দেবার চেষ্টা করে। সেই প্রশ্নগুলো তো আমাদের একাডেমিক মহল মেটাতে পারছে না। আমাদের দেশে কোনো দর্শনচর্চা নাই। ভাবচর্চার শক্তিশালী কোনো ধারা নাই। ধারা না থাকার কারণে ভাবচর্চার একমাত্র শক্তিশালী ধারা হিশাবে হাজির থাকছে মাজার। এখানেই ভাবচর্চা হয়। পশ্চিমে কিন্তু ভাবচর্চা এবং দর্শনচর্চার স্বাধীন ধারা আছে। এটাকে তারা বলে দর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। একাডেমিক ডিগ্রি দেওয়া হয়। যেহেতু ওদের দেশে একটা স্বাধীন ধারা আছে, তাই পাশ্চাত্যে কোনো মাজার নাই। এই বিষয়টা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপরীতে আমাদের এখানে দর্শন বা ভাবচর্চার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে মাজার। কারণ একাডেমিক ক্ষেত্রে কোনো ভাবচর্চা গড়ে উঠে নাই। তত্ত্বচর্চার কোনো ক্ষেত্র নাই। ফলে মাজার একমাত্র তত্ত্বচর্চার ক্ষেত্র।

কেমন? জালাল উদ্দীন খাঁর একটা গান― ‘এ সুরত দোজখে যাবে যে বলে সে গোনাগার’। এটা কিন্তু গভীর ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন। একটা দার্শনিক প্রশ্ন। এটা খ্রিস্টীয়-ইহুদি ভাবনা, ঠিক ইসলামে এভাবে আল্লাহ নিজের সুরতে আদম পয়দা করেছেন সেই দাবি নাই, তবে আমাদের এই রূপ তাঁরই সৃষ্টি। জালাল প্রশ্ন তুলছেন, আল্লাহ যদি নিজের সুরতে মানুষকে পয়দা করে থাকে, তাহলে তিনি সেই মানুষকে আবার দোজখে পাঠাবেন? এটা অসম্ভব। এটা কি করে হতে পারে? তার মানে, তিনি নিজেকে নিজে পোড়াবেন? এটা কি হয়? না, এটা তিনি করবেন। সেজন্য জালালউদ্দিন খাঁ তাঁর গানে বলেছেন, ‘এই সুরত দোজখে যাবে যে বলে সে গোনাগার’। তাহলে এই যে যুক্তি, দর্শনের প্রশ্ন হাজির করা, ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নকে দর্শনের প্রশ্নে রূপান্তরিত করার অসামান্য হিম্মত, প্রতিভা―এটা বাংলার সাধকশ্রেণী করে আসছেন। ফকির লালন শাহ, রাধারমণ, অথবা জালালউদ্দিন খাঁ, তাদের মধ্যে এই ভাবের ধারাই আমরা জীবিত দেখি। ফলে মাজার মানুষের মনের আকুতি, মনের গভীরতার প্রশ্নগুলো, জীবনের গভীর প্রশ্ন সামনে আনে। যে সকল প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যাই, দাবিয়ে রাখি, বাংলার সাধকেরা সেই প্রশ্ন তোলেন। প্র্রশ্ন তুললে তার উত্তর মাজার দিতে পারে। না দিতে পারলে প্রশ্নের আকুতি জারি থাকে। 

ফলে গণপরিসরের এই শক্তিশালী ক্ষেত্রগুলো নষ্ট করার মানে, আপনি একটা পশ্চিমা সমর্থিত ইসলামপন্থা, জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদ সমর্থিত একটা ইসলামপন্থাকে বাংলাদেশে প্রবল করতে চাচ্ছেন। এই ইসলামপন্থাকে আমাদের দেশে অনেকে ‘ওয়াহাবি’ বলে। আমি এটাকে ‘ওয়াহাবি’ বলতে চাই না। এটা আসলে একান্তই হিন্দুত্ববাদী-জায়নবাদী একটা শক্তিশালী ধারা, যার বিরুদ্ধে লড়াই না চালালে আমরা ইসলামের মহিমা কায়েম করতে পারব না। 

আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, ইসলামের ইহলোকে কিছুই করার নাই―সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, দর্শনের ক্ষেত্রে, ভাবের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে― কোথাও ইসলাম কোনো অবদান রাখতে পারবে না। ইসলামের একমাত্র কাজ হতে পারে পরকাল। অতএব ইহকালে কিছু পাবার আশা ত্যাগ করো। শুধু আখেরাত নিয়ে ভাবো, ওখানে তুমি জান্নাতে যাবে, ওখানে ৭০ হাজার হুর নিয়ে তুমি থাকবে; ইহলোকে অনাহারি থাকো কিন্তু পরকালে সব সুস্বাদু খাবার পাবে। অর্থাৎ তুমি গরিব, তুমি সর্বহারা; ইহলোকে তোমার কিছু পাওয়ার নাই। তো ইহলোকে কিছু পাওয়ার আশা করো না। তাই বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে কোনো লাভ নাই। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই বা জিহাদ ন্যায়সঙ্গত―এই ইসলামি নীতিকে নস্যাৎ করার জন্যই ইসলামকে এভাবে হাজির করা হয়। সেটা করা হয় আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক জাহেলিয়াত কায়েম রাখার জন্যই। 

ইহলোকে কারা পাবে? দুর্নীতিবাজ, লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণী। ফলে ইসলামের এই পরকালবাদী তত্ত্ব লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীরই একটা তত্ত্ব। তারা প্রচার করে যে, ইসলামের কোনো ইহলৌকিক কর্তব্য নাই। ইহলোকে ইসলামের কাছ থেকে কিছু পাবারও নাই। তুমি মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রোজা-বন্দেগি করবে; কিন্তু জালিমের বিরুদ্ধে তুমি কোনোদিন রাস্তায় নামবে না। মসজিদে গিয়ে বলবে, ‘এইখানে কোনো দুনিয়াবি কথাবার্তা বলা যাবে না।’ মানে জালিমের বিরুদ্ধে তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না। জালিমের বিরুদ্ধে যদি কথাই বলতে না পারে, তাহলে তো আপনি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবীর উম্মত হওয়ার যোগ্যতা আপনি হারিয়েছেন। তিনি তো জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইসলাম কায়েম করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি মক্কা বিজয় করে বলেছেন, ‘সত্য এসেছে, মিথ্যা পলায়ন করেছে।’ কেন? যারা অহংকারী, তাদের যে দর্প; কোরাইশদের দর্প তিনি সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাই ইসলামের চেয়ে ইহলৌকিক ধর্ম, ইসলামের চেয়ে বিপ্লবী ধর্ম দুনিয়ায় নাই।

কিন্তু ইসলাম অবশ্যই আখেরাতের কথাও বলে। কিন্তু সেটা ইহুদি ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব থেকে আলাদা। সেটা পরকালবাদ না। কী জন্য? মানুষ আত্মিকভাবে যেন আখিরাতকে মনের মধ্যে রাখে। অন্যায় করা থেকে বিরত থাকে, ভীতি থাকে। ভালো কাজ করার প্রতি আগ্রহী হয়, কারণ ভালো কাজে পুরস্কার আছে। সে যেন ভয়ও করে, আবার পুরস্কারের লোভেও ভালো কাজ করে। এটার জন্য আখিরাতের প্রশ্নটা ইসলামে আছে। এটাকে বলে এথিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন বা নৈতিক-আইনগত শিক্ষা। 

এই ব্যাপারগুলো আমরা জনগণকে বোঝাতে পারি নাই। জনগণকে তা বোঝাতে হবে। ভুল প্রচার থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক শিক্ষা দরকার, রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার। আর ইসলাম সম্পর্কে রাজনৈতিক সচেতনতা যখনই গড়ে উঠবে, তখনই আমরা দেখব এই মাজার যারা ভাঙছে, তাদের চিনব। তাদের আমরা সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করতে পারব। 

এই মুহূর্তে মাজার ভাঙার জন্য আমি শতভাগ ড. ইউনূসকে দায়ী করি। আমি প্রথম দিন থেকে তাকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে বলছিলাম। তিনি এটা করেননি। দ্বিতীয়ত, আমি দায়ী করি আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আজ পর্যন্ত যত মাজার ভাঙা হয়েছে, সেই অপরাধীদের সকলকে গ্রেফতার করা হয়নি। এসব হামলায় মামলা হয়েছে, আমরা জানি। অবশ্যই তাদের মামলার যাবতীয় দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সেই সঙ্গে যেসব মাজার ভাঙা হয়েছে, সেই মাজার গড়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও এই সরকারকে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে কোনোরকম ছাড় নাই। এই ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে না। তারা তো নির্বাচনবাদী। ফলে তারা মনে করে, এই ক্ষেত্রে কোনো বক্তব্য দিলে তাদের ভোট কমবে। তাদের হিশাবটা খুব সহজ। ফলে এই ক্ষেত্রে তাদের তো কোনো নীতিগত অবস্থান নাই। তারা লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। ফলে আমি তাদের রাজনৈতিক দল বলতে চাই না। আপনি লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীর প্রতিনিধিকে রাজনৈতিক দল কী করে বলবেন? তারা ভোটের জন্য কথা বলে, এর বাইরে নীতিগত অবস্থান নেয় না। যদি তারা সত্যিকার অর্থে সমাজে কিছু অবদান রাখত, তারা ভয় পেত না। আর এ ক্ষেত্রে আপনার উচিত হবে সেই দলগুলোকে জিজ্ঞাসা করা যে, তারা কেন কোনো বক্তব্য দেয়নি। দেয় না।

রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। এই সনদে আপনি কি জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন দেখতে পান?

ফরহাদ মজহার: না। জুলাই সনদ করেছেন ড. ইউনূস। এই সরকার প্রথমত একটা অবৈধ সরকার। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তিনি কেন জুলাই সনদ করছেন? যারা গণঅভ্যুত্থান করেছে, এটা তারা করবে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, এটা তাদেরই ধারণ করবার কথা। তারাই সনদ দিবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কেউ সনদ চায় না। জনগণের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, একটা নতুন রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায় ছিল, তাকে নস্যাৎ করার জন্যই এই তথাকথিত জাতীয় সনদ, তথাকথিত জাতীয় ঐকমত্য ইত্যাদি করা হয়েছে। এগুলো হলো জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এই বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে জনগণের সঙ্গে এবং এর মূল্য বাংলাদেশকে দিতে হবে।
আমরা এখন বুঝে গেছি, শুধু পুরানা রাষ্ট্রব্যবস্থা না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিকব্যবস্থা ও শৃংখলের মধ্যে আমরা যেভাবে আটকে পড়েছি সেই শিকল ড. ইউনূস আরও শক্ত করবেন। ড. ইউনূস ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে টাকা চেয়েছেন, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে টাকা চেয়েছেন; তিনি ঋণ নিচ্ছেন। আর এই ঋণ কিন্তু এই দেশের গরিব জনগণকে শোধ করতে হবে। আমরা এমনিতেই ঋণের ভারে জর্জরিত। আমরা কয়দিন পরে খেতে পাব না। ইতোমধ্যে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে। লিকুইড গ্যাসের অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তথাকথিত যে সকল কোম্পানির বিদ্যুৎ দেবার কথা, চুক্তি অনুযায়ী তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সর্বস্বান্ত হবার প্রক্রিয়া থেকে বের হতে পারবে না। পারছে না। সেই চেষ্টা ড. ইউনূসের মধ্যে আমরা দেখছি না।

আমরা তো গণঅভ্যুত্থান করেছি একটা অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য, অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য। সরকার সেটা করছে না। সেটা করবার অঙ্গীকার বা প্রস্তুতি কিছুই এই সরকারের নাই। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গা ইস্যুকে মানবিক ইস্যু বানাচ্ছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু মানবিক ইস্যু নয়, এটা রাজনৈতিক ইস্যু। আর ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে যদি বাংলাদেশ সত্যিকার কোনো অবস্থান পেতে চায়, কিছু অর্জন করতে চায়, তাহলে প্রথম কাজ হচ্ছে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা। রোহিঙ্গা রাজনৈতিক ইস্যু অবশ্যই; কিন্তু একই সঙ্গে সামরিক ইস্যুও বটে। সামরিক ইস্যুর প্রতি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। এটা আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। সামরিক ইস্যু মানে এই নয় যে, আপনি কাল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। আপনি যে যুদ্ধ করতে সক্ষম, যাকে বলে ডিটারেন্ট―তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেনাবাহিনীর কাছে যেতে হবে। সৈনিকতার মর্যাদা দিতে হবে। শত্রুকে সামরিকভাবে মোকাবিলার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আপনাকে কয়েক লক্ষ তরুণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আপনাকে একটা গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রেও ড. ইউনূস কোনো কাজ করছেন না। পাল্টা সামরিক-রাজনৈতিক ইস্যুকে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক ইস্যুতে পর্যবসিত করছেন। যা শেষাবধি বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। সকলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। 

ড. ইউনূস জাতিসংঘে গিয়েছেন কতগুলো লোক নিয়ে। এত টাকা খরচের দরকার তো নাই। যেটা দরকার, যাদের দরকার, তাদের তিনি নিয়ে যাবেন। আর এখান থেকে তিনি কী অর্জন করবেন? বিনিয়োগকারীদের নিয়ে তিনি হাহাকার করছেন। বারবার বলা হচ্ছে, বিনিয়োগ হবে বাংলাদেশে, যদি একই ছাদের তলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একজন বিনিয়োগকারীর যা যা দরকার, সেটা সে পেয়ে যায়। এই কাজই তিনি করছেন না। একজনকে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে বিনিয়োগ বোর্ডের একটা বিরাট পদ দিয়ে বসিয়েছেন, যার হয়তো বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। বাংলাদেশের অবকাঠামো সম্পর্কে, বাংলাদেশের অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। আর সে চাইলেই অনেক কিছু করতে পারবে না। এটা তো লুটতরাজের দেশ। লুট পার্টির বিরুদ্ধে সে কী করবে?

প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক চর্চায় মনোযোগী। গণঅভ্যুত্থান বা উপদেষ্টা সরকারের বিধান না থাকলেও বিশেষ পরিস্থিতির কথা বলে সংবিধান বজায় রেখে কিছু সংস্কারের পর নির্বাচনের আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে কি সংকট কাটবে? নাকি তা আরও গভীর হবে?

ফরহাদ মজহার: প্রথমত, এটা অসাংবিধানিক বা সাংবিধানিক তর্কের বিষয় না। এটা একটা অবৈধ সরকার। দ্বিতীয়ত, আপনি বলছেন, ১০৬ ধারায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে নির্বাচন করবেন। মতামত কারা দিয়েছেন, কিসের ভিত্তিতে দিয়েছেন, আমরা কিছুই জানি না। ১০৬ ধারায় যদি মতামতও দেন, এর ভিত্তিতে একটা উপদেষ্টা সরকার গঠিত হতে পারে না। সংবিধানে এমন কোনো নিয়ম নাই। 

আচ্ছা, এখন আপনি ১০৬-এর অধীনে সরকার বানালেন এবং আপনি সংবিধান মানবেন বলছেন। সংবিধান মানলে আপনি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কী করে দেন? আপনি তো দিতে পারেন না। দুই হাজার চব্বিশে তো নির্বাচন হয়ে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী এরপর নির্বাচন হবে ২০২৯ সালে, পাঁচ বছর পর। ড. ইউনূস তো সেই নির্বাচনকে এখনো বাতিল করেননি। তাহলে আপনি কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন দিবেন? পাঁচ বছর পর নির্বাচন হবে। সংবিধান মেনে চলার কথা বললে, মেনে চলার শপথ নিলে সংবিধান মেনে চলতে হবে। আপনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন, সংবিধান মেনে চলেন। আর সংবিধান মেনে চললে তো আপনি নিজেই জেলে যাবেন। কারণ আপনি সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। এইসব স্ববিরোধিতা নিয়ে আমরা কিছুতেই এভাবে রাষ্ট্র চালাতে পারি না। রাষ্ট্র তামাশা করার বিষয় না। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, নেপালে, ইন্দোনেশিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার যে একই ঘটনা ঘটবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নাই। কারণ এভাবে অবৈধভাবে রাষ্ট্র চালানো যায় না। ড.ইউনূস নিজেকে বৈধ করবেন, যারা এভাবে অবৈধ সরকার মানবার পরামর্শ দিয়েছেন, তাদের অবিলম্বে সরকার থেকে বের করে দিতে হবে। এর মাঝখানে যদি কোনো জোড়াতালি দিয়ে রাষ্ট্র চালানো হয় বাংলাদেশ ভয়ানক বিপদের দিকে ধেয়ে যাবে। অথচ ক্রমশ তিনি তা-ই করছেন এবং এটা আমার মতো আরও অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দেশের তৎপরতা বাড়ছে, পাশাপাশি বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনও চোখে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে কী ধরনের সংকটে পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সংকটে আছে। বাংলাদেশের সংকটের চরিত্র রাজনৈতিক না। এই সংকটের চরিত্র অর্থনৈতিক। এই দিকটার ওপর আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই। বাংলাদেশ চাইলেও অর্থনৈতিকভাবে বিকশিত হতে পারবে না, যদি না এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা সে উৎখাত করে একটা কৃচ্ছ্রসাধনমূলক অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশ করে এবং এমন একটা অর্থনীতি সে প্রবর্তনের চেষ্টা করে, যার মডেল কিছুটা চীনা মডেলের মতো হতে পারে―ইকোনমিক ডেমোক্রেসি বা অর্থনৈতিক গণতন্ত্র; কিন্তু জনগণের সার্বভৌমত্ব সহকারে। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা বা গাঠনিক ক্ষমতার বলে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে অর্থনীতির যে বিকাশ চীন করেছে, অর্থাৎ একটা পরিকল্পিত বিকাশের মধ্য দিয়ে চীনে যে দ্রুতবেগে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে, সেই বিকাশের পথে আমাদের যেতে হবে। তার জন্য আমাদের দরকার জনগণের সার্বভৌমত্ব। এই ক্ষমতার ভিত্তিতে আমাদের কাজ হবে অবিলম্বে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে গঠন করা এবং এমনভাবে গঠন করা যে, আমরা একটা বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। আমাদের প্রত্যেকটা জেলা যেন স্বাধীনভাবে তাদের বিকাশ নিজেরা করতে পারে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় বড় পরিকল্পনা জাতীয় ভিত্তিতে করলেও তার সুফল যেন প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌঁছায়। এই ধরনের একটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আমাদের কায়েম করতে হবে। এই নতুন ধরনের সরকার হবে জনগণের সরকার। 

ক্ষমতার দিক থেকে গণতন্ত্র মানে কী, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। সেটা হলো ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাবিরোধী জনগণের গণতন্ত্র। জনগণ মানে সবাই অন্তর্ভূক্ত নয়। তথাকথিত অন্তর্ভূক্তিমূলক গণতন্ত্র মোটেও তা নয়, যা আসলে ফ্যাসিস্ট শক্তি পুনর্বাসন ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মতাদর্শ ও রাজনীতি। এর বিপরীতে জনগণের গণতন্ত্র মানে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের শক্তি, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে দমন করবার সামষ্টিক ক্ষমতা এবং দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ও এই লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা, তাদের বিচার করবার ক্ষমতা, ইত্যাদি। গণআদালতে যেন তাদের বিচার হয়। বিচার করতে দীর্ঘ সময় যেন না লাগে। একইসঙ্গে পাচার করা অর্থ যেন আমরা দ্রুতবেগে ফিরিয়ে আনতে পারি। যদি আমরা এই ধরনের একটা সরকার গঠন করতে পারি, তাহলে যে কোনো দেশই আমাদের সমর্থন করবে। কোনো দেশই চাইবে না দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে; যারা এই লুটেরা-মাফিয়াদের প্রতিনিধি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। আমরা চেয়েছি, ড. ইউনূস আমাদের এই অভিপ্রায় ধারণ করবেন; দুঃখজনক, তিনি আমাদের জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় ধারণ করেন না।

আপনি সাক্ষাৎকারে ইতোমধ্যে একবার আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। অচিরেই আরেকটি গণঅভ্যুত্থান হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার প্রেক্ষাপট কেমন হতে পারে?

ফরহাদ মজহার: এবারকার প্রেক্ষাপট অনেক ম্যাচিউরড হবে। নিশ্চয়ই জনগণ বাস্তবতা বুঝতে পারছে। আমি তো আর দিন-ক্ষণ বলতে পারব না। আমি বলতে পারি, সমাজের যে সংকটগুলো বিদ্যমান, তা নিয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ড. ইউনূস আবারও সেই আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে, বিভিন্ন দেশের তথাকথিত বিনিয়োগকারীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। উনার কাছে বিনিয়োগকারী মানে হলো কর্পোরেট স্বার্থ। তারা দেশে আসবে। তাদের তিনি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড), বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) দিয়ে দিবেন। আর আমরা খালি সস্তা শ্রম সাপ্লাই করব। আর ওই ভূখ-ের উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। যেখানে শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করবার কোনো অধিকার থাকবে না। এই হলো তাঁর নীতি। এই নীতি দ্বারা তো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কোনো বিকাশ হবে না। এর তো কোনো ফায়দা আমরা পাই না। ইপিজেড-এ বহু পোশাক তৈরির কারখানা আছে। কী ফায়দা পেয়েছে আমাদের পোশাক তৈরির কারখানার শ্রমিক? তারা তো কিছুই পায়নি। তাদের প্রতি কোনো খেয়ালই নেই কারো। 

বিদেশীরা কেন বিনিয়োগ করতে আসবে? হয় তারা আপনার ভূখ- চুরি করতে আসবে অথবা সস্তা শ্রম নিতে আসবে। ড. ইউনূসকে এই ভুল পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। আর তিনি যে ভুল পথে যাচ্ছেন, এই কারণেই আরেকটি গণঅভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী। কারণ এই দেশের জনগণ এত বোকা নয়। 

দ্বিতীয়ত, আরেকটা কারণে গণঅভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী, যেটা আপনি ইঙ্গিত করেছেন― ভূরাজনৈতিক রূপান্তর। দিল্লি আজকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। ড. ইউনূসের জন্যও এটা ভূরাজনৈতিক বিপদ। ভূরাজনৈতিক যে কার্ড তিনি খেলছেন, সেই কার্ডে তিনি পরাজিত হবেন। কারণ নিঃসন্দেহ আমেরিকা ইতোমধ্যেই একটি ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তি। আভ্যন্তরীণভাবেও সে অত্যন্ত অস্থিতিশীল। ফলে এই রাষ্ট্রের উপর ভিত্তি করে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করা বোকামি। তিনি ঠকবেন। অতিরিক্ত মার্কিনপ্রীতি দেশের জন্য ভালো না। আমি আশা করব, আমরা এই অবস্থান থেকে ফিরে আসব। 

গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূস মহান হতে পারতেন। গণঅভ্যুত্থানের ফলে জনগণ তাকে এনেছে; কিন্তু তিনি যদি জনগণের কথা না শোনেন, তাহলে স্বভাবতই তাঁকে আজ হোক, কাল হোক জনগণের কাছেই জবাবদিহি করতে হবে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, এত সহজ ভাববেন না। ড. ইউনূসকে বলি, রাষ্ট্র মানে কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক, বা মাইক্রো ক্রেডিট পরিচালনা নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বিষয় ও ক্ষেত্র। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের প্রান্তিক একটি দেশ চালাতে হলে সেরকম প্রস্তুতি লাগবে। আমি তাঁকে বলব, তিনি তাঁর মার্কিন ও কর্পোরেটপ্রীতির পথ থেকে ফিরে আসুন। আমরা তাঁকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁকে অবশ্যই অর্থনৈতিক প্রশ্ন, গরিবের প্রশ্ন, এখানকার যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আছেন, তাদের বিকাশের প্রশ্ন ইত্যাদিকে সামনে আনতে হবে। আমদের একটা ইকোনমিক ডেমোক্রেসি বা অর্থনৈতিক গণতন্ত্র লাগবে। এখানে কোনো এন্টি-ট্রাস্ট আইন বা সিন্ডিকেট ভাঙার আইন নাই। এখানে যারা একচেটিয়া বাজার কায়েম করেছে, আড়তদার হয়ে যাচ্ছে, সিন্ডিকেট হয়ে যাচ্ছে তাদের একচেটিয়া ভাঙার কোনো আইন নাই। একটা বছর চলে গেলেও সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য একটা আইন বা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া শ্লথ। এখন ছাত্রলীগ সামনে চলে আসছে। মিছিল করছে। তাহলে এই সরকার কেন আছে?

গণঅভিপ্রায়ের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথটা কেমন হতে পারে? সম্ভাব্য গঠনতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে জানতে চাই।
ফরহাদ মজহার: এর একটা সহজ উত্তর হলো ‘গণসার্বভৌমত্ব’ কায়েম। এই উত্তর ইতোমধ্যে আমি বহুবার দিয়েছি। আমরা গণঅভ্যুত্থান সুরক্ষা মঞ্চ, চিন্তা পত্রিকা ও চিন্তা-ভাববৈঠকী পাঠচক্র থেকে একটা খসড়া জুলাই ঘোষণা দিয়েছি এ বছরের ২ আগস্ট। আমাদের তো জুলাই ঘোষণা দেওয়ার আইনগত এখতিয়ার নেই। আইনগত অধিকার গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ছিল গতবছরের ৫ আগস্ট। কিন্তু আমরা দিয়েছি। সেখানে নতুন রাষ্ট্র গঠনের তিনটা নীতিগত ভিত্তি আমরা প্রস্তাব করেছি। প্রথম ভিত্তি হলো― সকল প্রকার ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করা। বলেছি, রাষ্ট্র এমন কোনো আইন করতে পারে না যাতে ব্যক্তির অধিকার এবং ব্যক্তির মর্যাদা হরণ অথবা ক্ষুণœ হয়। দুই. প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ এবং প্রাণের বৈচিত্র্য যার মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অন্তর্গত; একে ধ্বংস করে, ক্ষতি করে এরকম কোনো আইন কিংবা নীতি রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না। তিন. জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে এমন কোনো আইন কিংবা নীতি রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারবে না। এই তিনটা নীতির ভিত্তিতে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছি। সেটা একটা গঠনতান্ত্রিক সভা বা রাষ্ট্রগঠন সভা বা যাকে ইংরেজিতে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বলে, সেই ধরনের একটা গণপরিষদ সভায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আলোচনা করতে পারে, রাষ্ট্রটা কেমন হবে। বাইরে থেকে অনেকে অনেক প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু একমাত্র নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্যরাই এই বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করবেন এবং এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

আমরা তো একটা রূপরেখা দিয়েছি। সেটা পরিষ্কার, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। এটা ধরেও আলোচনা এগোতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। 

আপনি গণঅভ্যুত্থানকেই গণতন্ত্র বলেছেন এবং গণসার্বভৌমত্বকে বর্তমান রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর ভিত্তিতে কি নতুন ধরনের রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ আছে?

ফরহাদ মজহার: হতে পারে। নিশ্চয়ই এর ভিত্তিতে একটা রাজনৈতিক দল গঠন হতে পারে। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি, ছাত্র-তরুণদের মধ্যে একটা অংশ নির্বাচনবাদী; আবার একইসঙ্গে বড় একটা অংশ গাঠনিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারাই তো চায় যে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হোক। তারা যে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাইছে, সেটাই হলো গাঠনিক রাজনীতি। ফলে সেই গাঠনিক রাজনীতির রণকৌশল এবং রণনীতি আমি আশা করি তারা ঠিক করবে। কী করে গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের ধারণা কাজে লাগাতে হয়, রণকৌশল ঠিক করতে হবে, রণনীতি ঠিক করতে হয় সেটা তারা রপ্ত করবে। অবশ্যই একটা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠবে তার ভিত্তিতে। কিম্বা বিদ্যমান দলের মধ্যেই রূপান্তর ঘটবে। আবার না-ও হতে পারে, হয়তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিলে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ হতে পারে। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল পরিবর্তিত হতে পারে। ধরুন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে যে নির্বাচনবাদী ধারা আছে, তারা পরাজিত হতে পারে। সেখানে নেতৃত্বে আসতে পারে যারা সত্যিকার অর্থে একটা গণরাজনৈতিক ধারা বিকশিত করে জনগণকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা ধারণ করে। তাহলে প্রধান কাজ হচ্ছে সমাজের চিন্তা পরিচ্ছন্ন করা। আমার কাজটা সমাজের রাজনৈতিক চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন করা। সেই কাজই আমি করে যাচ্ছি।

আপনি বলেছেন, মতবাদী রাজনীতির যুগ শেষ, কিন্তু একইসঙ্গে মতবাদী তাত্ত্বিকদের পর্যালোচনার গুরুত্বও উল্লেখ করেছেন। তাহলে কি বর্তমান সময়কে আপনি পোস্ট-ইডিওলজিক্যাল বা মতবাদোত্তর অবস্থা বলবেন? মতবাদী রাজনীতি আর গণসার্বভৌমত্বের রাজনীতি দুটোই তো আদর্শ। এর মৌলিক তফাৎ কোথায়?

ফরহাদ মজহার: মতবাদী রাজনীতি মানে হচ্ছে আপনার মাথার মধ্যে একটা মতবাদ আছে। আপনার মতবাদের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নাই। তাহলে আপনি বাস্তবতা দেখে আপনার মত বদলাবেন। তা না করে আপনি বাস্তবকে আপনার মতবাদের মধ্যে ফিট করতে চাচ্ছেন। এই যে বিভ্রান্তি, যেটা বামপন্থীদের মধ্যে প্রবল, ইসলামপন্থিদের মধ্যেও প্রবল―এই মতবাদী বিভ্রান্তি বা অন্ধত্ব কাটিয়ে উঠার জন্য কথাটা বলি, মতবাদী রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে। তার মানে কি পৃথিবীতে কোনো মতাদর্শ থাকবে না? হ্যাঁ, থাকবে। সেই ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হচ্ছে বিদ্যমান প্রতিটি মতাদর্শকে ক্রিটিক করা। এটা হলো কার্ল মার্ক্সের কথা। আমি মার্ক্সের ছাত্র। আর আমি মনে করি আগামী দিনের রাজনীতি অবশ্যই মার্ক্সের চিন্তা দ্বারা ভীষণ অনুপ্রাণিত, সমৃদ্ধ হবে। সেটাই সত্যিকার অর্থে বিপ্লবী রাজনীতি। মার্ক্সবাদ বলতে যার চর্চা হয়েছে, সেটা হলো এঙ্গেলস তাঁকে যেভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনীতি। আমি মনে করি, পুরানা মার্ক্সবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই। কিন্তু মার্ক্স এখনও সজীব ও জীবন্ত। আমার যে তরুণ কমরেডরা ইসলাম প্রশ্নে, ধর্মের প্রশ্নে বিভ্রান্ত; সেই বিভ্রান্তির কারণে তারা টুপি-দাঁড়ির মধ্যে ঝুলে আছে। তারা সমাজ বদলের আসল প্রশ্ন সামনে আনতে পারেন না― সেটা অর্থনৈতিক প্রশ্ন। মতবাদী জায়গা থেকে তারা মনে করেন, তাদের কাজ বুঝি হুজুরদের পিছে লাগা। এই যে একটা বিভ্রান্তি, এ থেকে তাদের বের হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ধর্মতত্ত্বের যুগও শেষ হয়ে গেছে। এখনকার যুগ দর্শনের যুগ, পর্যালোচনার যুগ, ভাবের যুগ। ফলে দর্শনের যুগ, ভাবের যুগ, পর্যালোচনার যুগে আমাদের প্রবেশ করতেই হবে। ধর্মতত্ত্ব হচ্ছে উপলব্ধির স্তর; কিন্তু মানুষের আরও বহু বৃত্তি আছে। বুদ্ধি যেমন। তাহলে ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধির সত্যকে যুক্তির দ্বারা বোঝা এবং মানবেতিহাসের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারার ওপর আগামী দিকে আমরা কোথায় কীভাবে টিকে থাকব, নাকি থাকব না, সেটা নির্ধারিত হবে। মতবাদের যুগ শেষ মানে, সত্যিকারের বাস্তব জগতটা কী, সেটা বোঝার জন্য মাথার মধ্যে যে জঞ্জালের বোঝা আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি সেই বোঝাটা ফেলে দিতে হবে। ফেলে দিন। মানুষের সঙ্গে মিশেন। মানুষ কী কথা বলে এগুলো শোনেন। মানুষের সত্যিকারের সমস্যাটার দিকে তাকান। তাকালে আপনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবেন। মতবাদের যুগ শেষ, এসেছে পর্যালোচনার যুগ। 

আবার একইসঙ্গে এসেছে গরিব মানুষের রাজনৈতিক, বা গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের যুগ। গরিব, বঞ্চিত, মজলুম তাদের রাজনৈতিক ধারা বিকশিত হবে। এখানে গণরাজনৈতিক ধারা বিকশিত করবার পথ হচ্ছে তথাকথিত মতবাদী রাজনীতি থেকে মুক্ত হওয়া এবং গণমানুষের সঙ্গে মিশে, তাদের চিন্তা-চেতনা, তাদের দুঃখ-কষ্ট, তাদের ভাষা তাদের মতো করে বলা শিখতে হবে।

আমি নিজেকে দুর্বল মনে করি, আমি তাদের মতো করে বলতে পারি না―এই বিনয়টুকু আমাদের থাকতে হবে। আমাদের সাধারণ মানুষের ভাষা ধীরে ধীরে রপ্ত করতে হবে। মানুষের কাছে ছুটে যাই। আবার ছুটে গেলে কাজ হচ্ছে না। কারণ আমরা যদি তাদের ভাষা না বুঝি, তাদের ভাষায় কথা না বলি, তাদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক মিলন ঘটবে না। আমরা গণশক্তি হয়ে উঠতে পারব না। এই দুর্বৃত্ত, লুটেরা-মাফিয়াশ্রেণী কিন্তু তখন আবার আমাদের কথাও শুনবে না। কিন্তু আমরা তো তাত্ত্বিকও বটে। তাই গণমানুষের অভিপ্রায় একাডেমিক ভাষায় ব্যক্ত ও প্রচার করতে হবে। আমি গণমানুষের রাজনীতি করি। গণরাজনীতির যে ধারা, তাকে শক্তিশালী করার জন্যই আমি বলি, মতবাদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। 

বলতে পারেন মতবাদ নয়, মতাদর্শের দিন এসেছে? মতাদর্শের, যুগ মানে সত্যিকারের বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তার পর্যালোচনামূলক অবদানের যুগ। আর আমি আরও বলি, জাতিবাদের যুগ শেষ। তার মানে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের গঠনের যুগ হাজির। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের গঠন করার মধ্য দিয়ে গণমানুষের অভিপ্রায়―গরিব মানুষ, মেহনতি মানুষ, শ্রমিকের অভিপ্রায়কে গণমানুষের সামষ্টিক ও সার্বজনীন অভিপ্রায় হিশাবে হাজির করবার যুগ আমরা বাংলাদেশে বাস্তবায়িত করব।

পরিশেষে, তরুণ প্রজন্মকে আপনি কী বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চান, যেখানে তারাই হয়তো ভবিষ্যতের বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে?
ফরহাদ মজহার: আমার সমস্ত কাজ তরুণদের গড়ে ওঠার জন্য। কারণ আমি ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। আগামীকে আমি বর্তমানের মধ্যেই আবিষ্কার ও গঠনে বিশ্বাসী। বর্তমানের মধ্যে আমরা যতটুকু চিন্তা ও কল্পনা করতে সক্ষম ততটুকুই আমরা আগামীতে বাস্তবায়িত করতে পারব। তাই আমার সকল কাজ তরুণদের কথা ভেবেই, তাদের লক্ষ্য করেই আমি বলি, ভাবি। 

তরুণদের কতটা তৈরি করতে পেরেছি, সেটা গণঅভ্যুত্থানই সাক্ষী। তা ছাড়া দুটো প্রমাণ তো আছে একটা চিন্তা-ভাববৈঠকী পাঠচক্র আর সাপ্তাহিক চিন্তা পত্রিকা। প্রতিসপ্তাহে পাঠচক্র হচ্ছে; প্রতি সপ্তাহে পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। যারা পরিচালনা করছেন, তারা সকলেই প্রায় তরুণ-যুবা। রাজনীতির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ ভীষণ জরুরি। আমরা মনে করি, বিভিন্ন জেলায় জেলায় চিন্তা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চিন্তা পাঠচক্র গড়ে উঠবে। এর মধ্য দিয়ে তরুণদের একটা বুদ্ধিভিত্তিক রূপান্তর আর বুদ্ধিভিত্তিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক চেতনা, নতুন রণকৌশল, রণনীতি, গণরাজনীতির ধারার রাজনীতি ইত্যাদি বিকশিত হবে। এটাই হবে আগামী গণঅভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি। এটা আমি দেখে যেতে পারব কিনা, জানি না। কিন্তু আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি, এটাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

ঢাকা/তারা

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন ও গঠন গণঅভ য ত থ ন অবশ ব যবস থ র ব র দ ধ গণঅভ য ত থ ন র ইসল মপন থ দ র ফরহ দ মজহ র দ র র জন ত ক স ব ধ ন রক ষ র জন ত ক ধ র ত ক র প ন তর হ ন দ ত বব দ গণত ন ত র ক ন র ব চনব দ গণঅভ প র য় ন র জন ত ক র জন ত ক চ ভ র জন ত ক এই ক ষ ত র র প রক র য় র ক র জন ত র গঠন র ক র ব যবস থ ব যবহ র ক ভ বচর চ র গণম ন ষ র এই সরক র র গঠন কর গণতন ত র জনগণ র গ একইসঙ গ হ জ র কর ক য় ম কর আম দ র ক আম দ র প র জন ত র এক ড ম ক ত র জন য দ শ র জন ধ ব স কর প রস ত ত আম দ র স পর ষ ক র র ব পর ত ব মপন থ উপদ ষ ট সমর থ ত ইসল ম র ই ইসল ম সরক র র করব র ক র ক ষমত প ঠচক র আপন র ম ব স তবত মতব দ র অবস থ ন ক ষমত র একম ত র জ য়নব দ র জনগণ র চ কর বল ছ ন ক জ কর ন কর ছ ত ক কর রক র র ব র পর দ র এক তত ত ব প রক শ অর থ ৎ কর ছ ন ব শ বব চর ত র র অন য প রব ন ক র কর চ র কর দ র বল ন র পর কল প র ই একট সকল র র করত মসজ দ আগস ট ত করব প রথম ই সনদ করব ন আপন ক র একট পরক ল র বলত ণ করত অবদ ন ইউন স করছ ন দরক র ধরন র ন করব ত করত র গণত

এছাড়াও পড়ুন:

নিজেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মনে করেন না তারেক রহমান

২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। লন্ডনে থাকলেও আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। সেই ভূমিকার জন্য গত এক বছরে কেউ কেউ তারেক রহমানকে এই আন্দোলনের ‘একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তারেক রহমান জানিয়েছেন, তিনি নিজেকে জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে দেখেন না।

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বিবিসি বাংলাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের উত্তরে তারেক রহমান বলেছেন, ‘কোনো দল বা ব্যক্তি নন, জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।’

আরও পড়ুনখালেদা জিয়া, পরিবারের কেউ নির্বাচনে ভূমিকায় থাকবেন কি না, জানালেন তারেক রহমান১ ঘণ্টা আগে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে বিএনপির কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা তারেক রহমানকে এই আন্দোলনের ‘একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন। বিষয়টি উল্লেখ করে তারেক রহমানের কাছে বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল, তিনি নিজেকে এই আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে দেখেন কি না?

উত্তরে তারেক রহমান বলেছেন, ‘না, আমি অবশ্যই এই জুলাই আন্দোলনে আমাকে কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই আন্দোলন সফল হয়েছে জুলাই মাসে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু বহু বছর আগে থেকে। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে। আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে (২০২৪ সাল) এসে জনগণ সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে।’

আরও পড়ুন১৭ বছর পর সাক্ষাৎকার: কবে ফিরবেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না, কী বললেন তারেক রহমান৩ ঘণ্টা আগে

শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নন, আরও নানা পর্যায়ের মানুষ জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা, তাঁরা ছিলেন এই আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি, গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টসকর্মী—তাঁরা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এই আন্দোলনে। এমন অনেক সাংবাদিক, যাঁরা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না, খাটো করে দেখতে চাই না।’

তারেক রহমান বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন দৃঢ়ভাবে, সমাজের দল–মতনির্বিশেষে, শ্রেণিবিন্যাস–নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের এই আন্দোলনে অবদান আছে। এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন। যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।

আরও পড়ুনগুপ্ত স্বৈরাচার থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে: তারেক রহমান২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল, বিবিসি বাংলা এই প্রশ্ন করে। উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে। এবং সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার। আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এই যোগাযোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদের করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।’

জুলাই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের দাবি বা সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের যে চেষ্টা, সেখানে বিএনপির কোনো দায় আছে কি না, তা তারেক রহমানের কাছে জানতে চায় বিবিসি বাংলা। জবাবে তিনি বলেন, ‘দেখুন, ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই আন্দোলন, মানুষের এই আত্মত্যাগ, সাধারণত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিশু হত্যা হয় না, শিশু শহীদ হয় না, শিশু মৃত্যুবরণ করে না। কিন্তু আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনে...যতটুকু আমার মনে আছে, প্রায় ৬৩ জন শিশু শহীদ হয়েছে, মারা গিয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে, এই আন্দোলনের ক্রেডিট দল–মতনির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়। অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, ডিমান্ড করতে পারেন, সেটি তাদের অবস্থান।’

আরও পড়ুনআগামী দিনে গুপ্ত স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটতে পারে : তারেক রহমান ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী, তা বলতে গিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আমি বা আমার দলের অবস্থান হচ্ছে, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনে জনগণ সফলতা লাভ করেছেন। আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ আছে। একটি পক্ষ হচ্ছে মানুষ শহীদ হয়েছে। দুই হাজারের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনে। আবার আরেকটি পক্ষ হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজারের মতো মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। আমার মনে হয়, আমাদের উচিত হবে, এখন আমাদের সকলের উচিত হবে, রাষ্ট্রসহ, সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর যার যতটুকু সম্ভব, সেই পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যতটুকু সহযোগিতা তাদের করা যায়, যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো।’

বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাদির কল্লোল তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব আজ সোমবার সকালে প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। এর দৈর্ঘ্য ৪৪ মিনিটের বেশি। সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হবে আগামীকাল মঙ্গলবার।

আরও পড়ুনস্বৈরাচার পালিয়েছে, অদৃশ্য শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে: তারেক রহমান২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনগণের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ এলে অপরাধ কমে আসবে 
  • জনগণের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ এলে অপরাধ আরও কমে আসবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • জাতীয় নির্বাচনের দিনই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট চায় বিএনপি
  • বিবিসির সাক্ষাৎকারে ‘নতুন’ তারেক রহমান
  • বাংলাদেশে নির্বাচনে যে সরকার আসবে, তাদের সঙ্গে কাজ করবে ভারত: বিক্রম মিশ্রি
  • গণভোট ও পিআরের দাবি জাতিকে বিভক্ত করছ: সালাহউদ্দিন
  • বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এখনো কোনো জোটে যায়নি: মামুনুল হক
  • নিজেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মনে করেন না তারেক রহমান
  • ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে আবার অভ্যুত্থান অনিবার্য’