বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়ই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থীকে রেখে খারাপ প্রার্থীকে নেওয়ার ভূরি ভূরি নমুনা হাজির করা যাবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। একই সঙ্গে নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ থাকা জরুরি।

আমাদের দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রার্থীকে বাছাই করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো নম্বর দেওয়ার বিধান নেই। সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বোর্ডে থাকা সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বোর্ডের কোনো কোনো সদস্য নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নেওয়ার জন্য ওকালতি করেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অধিকতর ভালো প্রার্থী বাদ পড়ে যান।

কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখন সাক্ষাৎকারের আগে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এই পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারেও মতভিন্নতা আছে। কারও কারও মতে, আবেদনকারী প্রার্থী শিক্ষাজীবনে যা অর্জন করেছে, সেটিকে ঘণ্টাখানেকের বা কমবেশি সময়ের লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক নয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার পরে প্রার্থীকে ডেমনস্ট্রেশন বা নমুনা ক্লাস নিতে বলা হয়। এই নমুনা ক্লাসেও নিয়োগকর্তারা নানাভাবে প্রভাবিত হন কিংবা প্রভাব বিস্তার করেন।

আরও পড়ুনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ‘সহজ তরিকা’০৪ জুন ২০২৫

প্রথম কথা, নিয়োগকর্তারা নিয়োগের ক্ষেত্রে সৎ থাকলে কোনো প্রক্রিয়াতেই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবকিছু নিয়োগকর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর রাখা ঠিক হবে না। ভালো শিক্ষক নির্বাচন বা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এমন হবে, যাতে অন্য কারও ব্যক্তিগত আগ্রহ-অনাগ্রহ কোনো প্রার্থীকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কিংবা বাড়তি সুবিধা না দেয়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়ার একটি ধরন উল্লেখ করা যায়।

শিক্ষক নিয়োগের বিদ্যমান আবেদনপত্রের কাঠামোতেও বদল আনা দরকার। দু-এক পাতার কাগজের ফরমের বদলে অনলাইনে পূরণ করা যায়—এমন বিস্তারিত আবেদনপত্র তৈরি করতে হবে।

তখন পাস করে যাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন অধ্যাপকের অধীন টিচার্স অ্যাসিস্ট্যান্ট বা টিএ হিসেবে সংযুক্ত থাকতেন। পরে তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়ার ভালো দিক হলো, নিয়োগ পাওয়ার আগেই একজন প্রার্থী শিক্ষকতা পেশার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পেয়ে যেতেন। কারণ, তাঁকে গবেষণাকাজে যুক্ত থাকতে হতো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্লাস নেওয়া ও খাতা দেখার কাজ করতে হতো। এই পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।

আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ: ‘রিকমেন্ডেশন’ লেটার কেন ‘তদবির’ হয়ে ওঠে০৬ আগস্ট ২০২৫

মানতে হবে, শিক্ষক হিসেবে তাঁরাই নিয়োগের জন্য অগ্রগণ্য হতে পারেন, যাঁরা শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে ভালোফল করেছেন। কিন্তু ইদানীং ভালো শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ কমেছে। এর প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, এই পেশায় বাড়তি অর্থ আয়ের সুযোগ সীমিত। দ্বিতীয়ত, ভালো ফল করলেই শিক্ষক হওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বিপরীতে বিসিএস দিয়ে ক্যাডারভিত্তিক চাকরিতে অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি—সবকিছু লাভেরই সুযোগ থাকে। তাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ এখন বিসিএসের দিকে ঝুঁকেছেন।

শিক্ষকতায় মেধাবীদের আগ্রহী করে তোলার জন্য এই খাতে বেতন ও সুবিধা বাড়াতেই হবে। একই সঙ্গে নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ নতুন জ্ঞান উৎপাদন। এটিকে মাথায় রেখে শিক্ষক নিয়োগের প্রাথমিক শর্ত নির্ধারণ করা দরকার। সে ক্ষেত্রে একজন প্রার্থীর গবেষণাকর্ম সবচেয়ে প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ একজন প্রার্থীর যেমন ভালো ফল থাকতে হবে, তেমনি তাঁকে গবেষণাকাজেও সফলতা দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে কোনো অধ্যাপকের অধীন টিচার্স অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্ত করা যায়। এ ছাড়া প্রার্থীকে অন্তত দুটি গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার শর্ত দিতে হবে।

আরও পড়ুনএকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন কত হওয়া দরকার২৩ আগস্ট ২০২৫

ডেমনস্ট্রেশন ক্লাস বা নমুনা ক্লাস আসলে কোনো তাৎপর্য বহন করে না। কারণ, কোন প্রার্থী কতখানি চটকদার ক্লাস নিতে পারেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভালো শিক্ষকের মানদণ্ড হতে পারে না। সাধারণ সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়েই প্রার্থীর জ্ঞান ও বাচনভঙ্গির প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। নমুনা ক্লাসের সুযোগ রাখলে নিয়োগকর্তারা বরং বিভ্রান্ত হতে পারেন।

নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। বরং চার থেকে পাঁচ বছরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার বিস্তারিত নম্বরপত্র জমা দেওয়ার বিধান রাখা যায়। সেই নম্বরপত্র দেখে বোঝা যাবে, একজন প্রার্থী কোন কোর্সে কেমন সফলতা দেখিয়েছেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সর্বমোট নম্বর বা সিজিপিএ এবং গবেষণাকর্ম প্রাধান্য পাবে। আবেদনকারী প্রার্থীর সংখ্যা কমাতেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় লিখিত পরীক্ষা নিয়ে থাকে। প্রার্থী কমানোর জন্য বাড়তি পরীক্ষা না নিয়ে বরং এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম জিপিএ বাড়িয়ে ৪.

৫০ করা যায়।

আরও পড়ুনঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে কেমন বিশ্ববিদ্যালয় পেলাম০৭ আগস্ট ২০২৫

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে সাধারণ রাজনীতিবিদ, এমনকি ছাত্রসংগঠনের নেতাদেরও সুপারিশ করতে দেখা যায়। এ ধরনের যোগাযোগ বা সুপারিশ ওই প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে ধরতে হবে এবং শুরুতেই তাঁকে বাদ দিতে হবে। বরং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুজন অধ্যাপকের মূল্যায়ন-প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করা যায়। এই মূল্যায়নপত্রে দুজন অধ্যাপক আবেদনকারী প্রার্থীর গবেষণাকর্মের ধরন ও বিশেষত্ব উল্লেখ করবেন।

শিক্ষক নিয়োগের বিদ্যমান আবেদনপত্রের কাঠামোতেও বদল আনা দরকার। দু-এক পাতার কাগজের ফরমের বদলে অনলাইনে পূরণ করা যায়—এমন বিস্তারিত আবেদনপত্র তৈরি করতে হবে। প্রার্থী সরাসরি কোনো কাগজ কিংবা সার্টিফিকেট ও নম্বরপত্র জমা দেবেন না। তিনি অনলাইনেই আবেদন করবেন এবং সেখানে সব ডকুমেন্টের সফট কপি আপলোড করবেন।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

[১৪ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি কী হতে পারে—শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: একজন প র র থ ল খ ত পর ক ষ ন য় গকর ত র প রক র য় র জন য দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রীপুরে কথা–কাটাকাটির জেরে ৫ সহপাঠীকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কিশোর পলাতক

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কথা-কাটাকাটির জেরে একটি মাদ্রাসার পাঁচ শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে আহত করার অভিযোগ উঠেছে আরেক কিশোর শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে উপজেলার গাড়ারণ গ্রামের গাড়ারণ খলিলিয়া বহুমুখী ফাজিল মাদ্রাসায় এ ঘটনা ঘটে।

আহত শিক্ষার্থীরা হলেন মো. রিফাত, নাদিম মাহমুদ, মুহিন মিয়া, রিফাত আহমেদ ও মো. রাশিদুল। তাঁরা সবাই শ্রীপুরের গাড়ারণ খলিলিয়া বহুমুখী ফাজিল মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী। অন্যদিকে অভিযুক্ত কিশোর একই উপজেলার বাসিন্দা ও ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

মাদ্রাসাটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, ছুরিকাঘাতে আহত পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্য দুজনকে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ওই মাদ্রাসায় পরীক্ষা চলার সময় অভিযুক্ত কিশোর বেঞ্চে বসে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিল। এ সময় সহপাঠীদের দু-একজন তাঁকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। পরে শিক্ষকদের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষকে মিলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আজ বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের হচ্ছিল। ওই সময় অভিযুক্ত কিশোর ছুরি নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এতে ওই পাঁচ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়।

আরেক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাদ্রাসার রান্নাঘরের পাশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছুরি নিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে ওই কিশোর। এ সময় রাস্তার ওপর একটি অটোরিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। হামলার পর খুব দ্রুত সেটিতে ওঠে সে পালিয়ে গেছে।

খবর পেয়ে শ্রীপুর থানা-পুলিশ সেখানে এসেছিলেন বলে জানান মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, ঘটনা ঘটিয়ে ওই শিক্ষার্থী পালিয়ে গেছে।

এ বিষয়ে তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহম্মদ আবদুল বারিক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গোপালগঞ্জ শহরে হোটেল থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার
  • কুমিল্লায় বাসের ধাক্কায় দুজনের মৃত্যু
  • মণিপুরে আসাম রাইফেলসের চৌকিতে হামলা, ৪ জওয়ান আহত
  • দাউদকান্দিতে বাসের ধাক্কায় ট্রলির দুই আরোহী নিহত
  • স্বল্প আয়: কমছে নৈশপ্রহরীর পেশায় আগ্রহ, সংকটে নিরাপত্তা
  • আলতাফ চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাল জেলা বিএনপি
  • ব্যাট–প্যাড কিনতে পেছাচ্ছে বিপিএল
  • বরগুনায় স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণর দায়ে একজনের মৃত্যুদণ্ড
  • শ্রীপুরে কথা–কাটাকাটির জেরে ৫ সহপাঠীকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কিশোর পলাতক
  • সহকারী শিক্ষক নিয়োগে আবেদন সাড়ে ৭ লাখ, প্রতি পদে ৭৩ প্রার্থী, পরীক্ষা কবে