শীতের পড়ন্ত বিকেলে বান্দরবানের থানচি উপজেলায় সাঙ্গু নদের পাড়ে এক প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁবু গেড়েছিলাম। এক জনমানবহীন বনপথ। কেবল নদের পানির চলার শব্দ ও বুনো প্রাণীদের ডাকাডাকি। এমন নির্জন রাত শেষে কুয়াশাময় শীতের সকালে ডিমভাজি ও খিচুড়ি খেয়ে আমাদের আবার পথচলা।
বনের নদীর পথে কত-না প্রাণবৈচিত্র্য! অচেনা অনেক গাছপালার সমাহার। বুনো ফুলের ঘ্রাণ, পাখির গান, নদীর জলে ভাসা অচেনা বুনো ফুলের রং দেখে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের জগতে আছি বলে মনে হলো। এখানে হারিয়ে গেলে আমাদের খুঁজে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গভীর বন।
সেদিন সকালে কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পরে নদীর তীরে দেখা হলো এক শুভ্র রঙের জাম ফুলের সঙ্গে। একটা মায়াবী টান তার রঙে ও গাছের পাতায়। মনে হলো এ কোন মায়াভরা বুনো জামের বনে এলাম। ফুলগুলো দেখতে আমাদের চিরচেনা জামরুল ফুলের মতো। কিন্তু এটি বৃক্ষ নয়, পাতাও জামরুলের মতো চ্যাপটা ও বড় নয়। তবে ভেবেছি, কোনো বুনো জাম হবে। আমাদের পাহাড়ি বনে অনেক প্রজাতির জাম আছে। এ গাছের পাতা দেখে মনে হয়েছিল, সিলেটের জাফলংয়ে ডাউকি নদীর তীরে একবার দেখেছি।
সাঙ্গু নদের দুই তীরে লম্বা সারিতে গাছগুলো। প্রাকৃতিকভাবেই তারা সারি বেঁধে জন্মেছে। অনেকটা ঝোপালো গুল্ম। প্রতিটি উদ্ভিদেই ফুল। ফুল সুগন্ধী। ফুলে মৌমাছি আসছে। ফুলের ও গাছের ছবি তুলি। ঢাকায় গিয়ে বইপত্র ঘেঁটে বৈজ্ঞানিক পরিচিত জানতে চেষ্টা করি। পরে একটি জার্নালে আর্টিকেল পড়ে উদ্ভিদটি সম্পর্কে জানাতে পারি। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium polypetalum। খুব কম পরিচিত লিথোফাইটিক ও রিপারিয়ান (পাথুরে ও নদীর তীরের পরিবেশে জন্মে) বিরল উদ্ভিদ। এটি ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা; বাংলাদেশের বান্দরবান, সিলেট এবং মিয়ানমারের নদীতীরের শিলাময় পরিবেশে পাওয়া যায় কেবল। প্রধানত নদীর তীর বরাবর শিলার ফাটলের মধ্যে জন্মে। ফুল ফোটে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। ফল ধরে মে মাস থেকে।
দোলা জামের ফুল.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হবে আশা করা যায়। নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে দুই পক্ষই নীতিগতভাবে একমত হয়েছে যে ২০২৬ সালের রোজার আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি–দলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনের শপথ ইস্যু সেই বিরোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে।
কিন্তু ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে।
এমনই একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৈঠকের ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে এলেও দুই পক্ষের আলোচনা কেবল এর মধ্যে সীমিত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারের ধারাবাহিকতার ওপরও জোর দেন তঁারা।
বৈঠকের ফলাফলকে প্রায় সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণার ধরন নিয়ে আপত্তি জানালেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা কেউ করেনি। আমরাও মনে করি, কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ যারা সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারকাজ দৃশ্যমান করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি ত্বরান্বিত করা জরুরি। আবার অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায়, সে জন্য জুলাই-আগস্টের হত্যার বিচারও অপরিহার্য। কিন্তু এই দুটি বিষয়কে কোনোভাবে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না।
যেসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধানের বিষয়টি জড়িত নয়, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা যায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন বাধা আসার কথা নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অর্থ এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে সরকার একা কাজটি করতে পারবে না।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় সংঘাতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে না চললে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আমরা আশা করি, দিন-তারিখের বিষয়ে সমঝোতার পর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। রাজনীতিতে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে একে অপরকে ‘শত্রুজ্ঞান’ করার পুরোনো সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।