দুটি দেশ যেখানে মিলিত হয়, সেখানে থাকে আন্তঃদেশীয় সীমানা। গবেষণা বলে, এই আন্তঃদেশীয় সীমানাগুলো বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্র্যর ৫৭ শতাংশের খোঁজ মেলে এ এলাকাগুলোতে। মানুষের চলাচল কিংবা মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কম থাকায় এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এ পরিবেশের গুণগত মান জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল হিসেবে খুবই অনুকূল। এ কারণে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা তূলনামূলক বেশি। ইন্দো-চায়না এবং ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের মিলনস্থলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে রয়েছে বন্যপ্রাণীর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার; যার মধ্যে রয়েছে সাত শতাধিক প্রজাতির পাখি। এ পাখির মধ্যে ৩৩৭টি প্রজাতি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি, ২০৮টি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২টি গ্রীষ্ম পরিযায়ী, ১৪টি পান্থ পরিযায়ী এবং ১১৯টি প্রজাতি ভবঘুরে।
বাংলাদেশের স্থল সীমান্তরেখার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৯৪ শতাংশ ভারতের সঙ্গে এবং বাকি ৬ শতাংশ মিয়ানমারের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরায় রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত এলাকা। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমানাই পাহাড়ি বনে আচ্ছাদিত; যার ফলে বন্যপ্রাণীরা এ এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে বিচরণ করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতেও। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের এলাকা, হিমালয়কন্যা তেঁতুলিয়া তিন দিক থেকে ভারতীয় সীমানা দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এখানে রয়েছে অসংখ্য পাখির সমাহার।
সম্প্রতি তেঁতুলিয়ায় পাখির ওপর করা আমাদের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘স্প্রিঙ্গার’ নামক একটি জার্নালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড.
পুরো বছরকে আমরা তিনটি মৌসুমে ভাগ করে সরাসরি মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করি। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। শীতে এই এলাকা অতিথি পাখির আনাগোনায় পরিণত হয় পাখির স্বর্গে। চাতক, বউকাও, নীললেজ সুইচোর এখানকার গ্রীষ্ম পরিযায়ী পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির বুনোহাঁস, সৈকত পাখি, ঘাসবনের পাখি, আশটে দামা, পরিযায়ী গায়ক পাখি এখানকার উল্লেখযোগ্য পরিযায়ী পাখি। এখানে আরও দেখা মেলে লাল ঘার কাস্তেচরার।
এ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে এখানে। এর মধ্যে দেশি গুটি ঈগল, চারটি সংকটাপন্ন প্রজাতির হলদে চোখ ছাতারে, বড় গুটি ঈগল, শেখ ফরিদ, মদনটাক, কালা মাথা কাস্তেচরা অন্যতম। পাশাপাশি এখানে সম্প্রতি দেখা মিলেছে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সবুজ ময়ূরের। তাহলে বলাই চলে এ এলাকা জীববৈচিত্র্যের জন্য, বিশেষ করে পাখির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, আমরা পাখির পাশাপাশি জলাভূমির সুস্থতার নির্দেশক ফড়িং নিয়েও গবেষণা করি। আমরা মোট ৪৭ প্রজাতির ফড়িংয়ের সন্ধান পাই, যা দেশের মোট ফড়িং প্রজাতির অর্ধেক। পাওয়া যায় কিছু দুর্লভ প্রজাতির ফড়িং।
এ এলাকার বৈচিত্র্যে ঘেরা পাখিদের আবাসস্থল যেমন মানব বসতিকেন্দ্রিক বন, ঝোপঝাড়, নদী, ঝিরি, চা বাগান, জলাভূমি, প্লাবন ভূমি, ফসলের মাঠ, সবুজে ঘেরা অরণ্যের বৈচিত্র্যময়তার কারণে জীববৈচিত্র্য এতটা বেশি সমৃদ্ধ।
তেঁতুলিয়ার পাখিবৈচিত্র্য এবং আমাদের দীর্ঘমেয়াদি এই গবেষণা এটাই প্রমাণ করে, আমাদের আন্তঃসীমানা এলাকাগুলো জীববৈচিত্র্যে ভীষণ সমৃদ্ধ। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এ এক পাখির স্বর্গ। তেঁতুলিয়াসহ আন্তঃদেশীয় সীমানায় অবস্থিত এলাকাগুলোতে আমাদের পাখি সংরক্ষণে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি। দরকার বিস্তৃত গবেষণা এবং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক সহযোগিতা। v
লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এল ক গ ল এ এল ক পর য য়
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।
সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।
ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’