Samakal:
2025-05-02@18:11:07 GMT

পাখির নেই কোনো সীমানা

Published: 17th, January 2025 GMT

পাখির নেই কোনো সীমানা

দুটি দেশ যেখানে মিলিত হয়, সেখানে থাকে আন্তঃদেশীয় সীমানা। গবেষণা বলে, এই আন্তঃদেশীয় সীমানাগুলো বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্র্যর ৫৭ শতাংশের খোঁজ মেলে এ এলাকাগুলোতে। মানুষের চলাচল কিংবা মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কম থাকায় এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এ পরিবেশের গুণগত মান জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল হিসেবে খুবই অনুকূল। এ কারণে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা তূলনামূলক বেশি।  ইন্দো-চায়না এবং ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের মিলনস্থলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে রয়েছে বন্যপ্রাণীর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার; যার মধ্যে রয়েছে সাত শতাধিক প্রজাতির পাখি। এ পাখির মধ্যে ৩৩৭টি প্রজাতি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি, ২০৮টি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২টি গ্রীষ্ম পরিযায়ী, ১৪টি পান্থ পরিযায়ী এবং ১১৯টি প্রজাতি ভবঘুরে।

বাংলাদেশের স্থল সীমান্তরেখার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৯৪ শতাংশ ভারতের সঙ্গে এবং বাকি ৬ শতাংশ মিয়ানমারের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরায় রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত এলাকা। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমানাই পাহাড়ি বনে আচ্ছাদিত; যার ফলে বন্যপ্রাণীরা এ এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে বিচরণ করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতেও। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের এলাকা, হিমালয়কন্যা তেঁতুলিয়া তিন দিক থেকে ভারতীয় সীমানা দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এখানে রয়েছে অসংখ্য পাখির সমাহার।
সম্প্রতি তেঁতুলিয়ায় পাখির ওপর করা আমাদের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘স্প্রিঙ্গার’ নামক একটি জার্নালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড.

মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি হয়। গবেষক হিসেবে ছিলাম আফসানা ইমরোজ আর আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক মো. মাহাবুব আলম ও মো. ফজলে রাব্বি ছিলেন সহ-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চালানো গবেষণায় রেকর্ড করা হয়েছে ১৭৪ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে ১২২টি প্রজাতি স্থানীয়। বাকি ৫২টি শীতকালে অতিথি হয়ে উড়ে আসে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে। এলাকাটিতে সবচেয়ে বেশি দেখা সাত ভাই ছাতারে, বনছাতারে বা ক্যাচক্যাচিয়া। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে আছে– ঘুঘু, ফিঙে, কোকিল, মুনিয়া, খঞ্জন, ছাতিঘুরানি, শ্বেতাক্ষী, কাঠঠোকরা, প্যাঁচা, পানকৌড়ি,  ঈগল, বাজ, গাংচিল,  মাছরাঙা ইত্যাদি। এখানে আমরা বনভূমিকেন্দ্রিক পাখিদেরই তূলনামূলক বেশি দেখা পাই। এ ছাড়া চা বাগানের পরিমাণ বেশি থাকায় এখানে দেখা মেলে বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্যময় পাখির। যেমন হলদে চোখ ছাতারে, চুকটি, দামা, শ্যামা, কোয়েল, কাঠঠোকরা।
পুরো বছরকে আমরা তিনটি মৌসুমে ভাগ করে সরাসরি মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করি। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। শীতে এই এলাকা অতিথি পাখির আনাগোনায় পরিণত হয় পাখির স্বর্গে। চাতক, বউকাও, নীললেজ সুইচোর এখানকার গ্রীষ্ম পরিযায়ী পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির বুনোহাঁস, সৈকত পাখি, ঘাসবনের পাখি, আশটে দামা, পরিযায়ী গায়ক পাখি এখানকার উল্লেখযোগ্য পরিযায়ী পাখি। এখানে আরও দেখা মেলে লাল ঘার কাস্তেচরার।

এ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে এখানে। এর মধ্যে দেশি গুটি ঈগল, চারটি সংকটাপন্ন প্রজাতির হলদে চোখ ছাতারে, বড় গুটি ঈগল, শেখ ফরিদ, মদনটাক, কালা মাথা কাস্তেচরা অন্যতম। পাশাপাশি এখানে সম্প্রতি দেখা মিলেছে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সবুজ ময়ূরের। তাহলে বলাই চলে এ এলাকা জীববৈচিত্র্যের জন্য, বিশেষ করে পাখির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, আমরা পাখির পাশাপাশি জলাভূমির সুস্থতার নির্দেশক ফড়িং নিয়েও গবেষণা করি। আমরা মোট ৪৭ প্রজাতির ফড়িংয়ের সন্ধান পাই, যা দেশের মোট ফড়িং প্রজাতির অর্ধেক। পাওয়া যায় কিছু দুর্লভ প্রজাতির ফড়িং।

এ এলাকার বৈচিত্র্যে ঘেরা পাখিদের আবাসস্থল যেমন মানব বসতিকেন্দ্রিক বন, ঝোপঝাড়, নদী, ঝিরি, চা বাগান, জলাভূমি, প্লাবন ভূমি, ফসলের মাঠ, সবুজে ঘেরা অরণ্যের বৈচিত্র্যময়তার কারণে জীববৈচিত্র্য এতটা বেশি সমৃদ্ধ।
তেঁতুলিয়ার পাখিবৈচিত্র্য এবং আমাদের দীর্ঘমেয়াদি  এই গবেষণা এটাই প্রমাণ করে, আমাদের আন্তঃসীমানা এলাকাগুলো জীববৈচিত্র্যে ভীষণ সমৃদ্ধ।  সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এ এক পাখির স্বর্গ। তেঁতুলিয়াসহ আন্তঃদেশীয় সীমানায় অবস্থিত এলাকাগুলোতে আমাদের পাখি সংরক্ষণে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি। দরকার বিস্তৃত গবেষণা এবং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক সহযোগিতা। v

লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদ 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এল ক গ ল এ এল ক পর য য়

এছাড়াও পড়ুন:

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা: বৈশ্বিক হুমকি ও স্থানীয় সংস্কার

এ বছরের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘সাহসী নতুন দুনিয়ায় সাংবাদিকতা-সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব’।  অথচ বাস্তবতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ বছরেই প্রথম চার মাসে ১৫ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং বৈশ্বিক পরিসরে সাংবাদিকতা সবচেয়ে বিপজ্জনক হুমকির মুখে পড়েছে। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে।

এই ট্র্যাজেডির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, যেসব বিশ্বশক্তি নিজেদেরকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তারা ইসরায়েলের পরিকল্পিত ও নিশানা করে সাংবাদিক হত্যায় নীরবতা পালন করছে কার্যত এসব সাংবাদিকের ফিলিস্তিনি পরিচয়ের কারণে। শুধু সাংবাদিক নয়; এই নীরবতা বিস্তৃত তাদের পরিবার, নারী-শিশুসহ পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর।

এর চেয়েও উদ্বেগজনক, বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর পশ্চিমা দেশগুলোর সরবরাহ করা উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তার সামরিক ব্যবহারের প্রসঙ্গ উপেক্ষা করলে তা শুধু অসম্পূর্ণই থাকে না; অনৈতিকও বটে। ফিলিস্তিনি কণ্ঠস্বর– যাদের মাধ্যমে আমরা এই ভয়াবহ নৃশংসতার ব্যাপকতা ও মানবিক সংকটের গভীরতা জানতে পারি তা রুদ্ধ করা ছিল ইসরায়েলি অভিযানের প্রধান উপাদান। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মধ্যেও চরম নিষ্ঠুরতাকে আড়াল করার জোরালো ইঙ্গিত মেলে। তদুপরি প্রযুক্তি-দানব কোম্পানিগুলোর যারা এই হত্যাযজ্ঞে পরোক্ষভাবে জড়িত, তারা কোনো জবাবদিহি ছাড়াই পার পেয়ে যাচ্ছে।

আমরা যখন সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক যেমন উপাত্ত বিশ্লেষণের উন্নত ক্ষমতা ও দক্ষতা নিয়ে ভাবছি, তখন এর অন্ধকার দিকগুলোকে অস্বীকার করা যায় না, বিশেষ করে যখন তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবজীবনের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে সাংবাদিকতা যেখানে সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়েছে, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক তথাকথিত ‘মুক্ত বিশ্ব’ ও ‘সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা’র সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করেছে। প্রথম ১০০ দিনে ট্রাম্প প্রশাসন মতাদর্শগত কারণে ভয়েস অব আমেরিকা ও ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর মতো রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত সম্প্রচার মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে; হোয়াইট হাউসের তালিকা থেকে অপছন্দের সাংবাদিকদের বের করে দিয়েছে এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যম বাদ দিয়ে উগ্র ডানপন্থি মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) অনুগত প্রান্তিক গণমাধ্যমগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছে।

প্রথম মেয়াদে সাংবাদিকদের ‘গণশত্রু’ হিসেবে অভিহিত করা ট্রাম্প তাঁর সাংবাদিকতাবিরোধী অভিযান এবার আরও জোরদার করেছেন। এটি আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বৈশ্বিক স্বৈরাচারী প্রবণতারই অংশ। তাঁর পদক্ষেপ অন্য স্বৈরশাসকদের উৎসাহ দিচ্ছে, যা গণমাধ্যমের দমন-পীড়নের যৌক্তিকতা তৈরি করছে।
ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা যদি এখনও বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকতেন, তবে নিশ্চিতভাবেই তিনি ট্রাম্পের এই নীতিকে ভিন্নমত দমন ও সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নজির হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তি দাঁড় করাতেন।

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য আমাদের দায়িত্ব দিয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। আমাদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগের সরকার সুপরিকল্পিতভাবে সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছিল রাজনৈতিক পরিচয় ও আনুগত্যের ভিত্তিতে; সাংবাদিকতা বা সম্প্রচারে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নয়।
এ ছাড়া বিনিয়োগ বৈধ উৎস থেকে এসেছে কিনা, তা জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই কালো টাকা ব্যবহৃত হয়েছে। পরিণতিতে সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠেছে একেকটি গোষ্ঠীর হাতিয়ার, যার মাধ্যমে তারা তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে প্রশ্নের বাইরে রাখতে বা সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।

কমিশন অংশীজন নিয়ে যেসব পরামর্শ সভা করেছে, সেখানে উচ্চপদস্থ আমলারা স্বীকার করেছেন, অবৈধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত সংবাদ মালিকদের চাপ ঠেকাতে তারা ব্যর্থ। তারা মিডিয়া লাইসেন্সিংয়ের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ চেয়েছেন। মালিকদের স্বার্থ প্রকাশ করার কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেক মালিক সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন প্রতিদ্বন্দ্বীদের চরিত্র হনন, ভুল প্রচার এবং নিজেদের স্বার্থে সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে। তারা একাধিক গণমাধ্যমের মালিকানা রাখছেন বিভিন্ন নামে; একই কনটেন্ট বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রচার করে বাজারকে প্রভাবিত করে চলেছেন।
বিশ্বব্যাপী ‘গণমাধ্যমের মালিক কারা’– এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং অনেক দেশে ক্রস ওনারশিপ নামে পরিচিত একই সঙ্গে একাধিক মাধ্যমের মালিকানার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এই নীতিতে একজন টিভি চ্যানেলের মালিক একই সঙ্গে পত্রিকার মালিক হতে পারেন না কিংবা একজন পত্রিকার মালিক একই সঙ্গে টিভি চ্যানেলের মালিক হতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ইউরোপের অনেক দেশে এ ধরনের নিয়ম আছে, যা গণমাধ্যমে বৈচিত্র্য বজায় রাখতে বা বহুমতের অবস্থান নিশ্চিত করতে জরুরি।

কিছু সমালোচক এ বিষয়ে ভারতের উদাহরণ টানলেও, মুক্ত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচকে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সবার নিচে। সেখানে সংবাদমাধ্যমের ‘গদি মিডিয়া’ নামকরণ থেকেই বোঝা যায় গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান। মূলধারার প্রায় সব গণমাধ্যমই হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নীতি-আদর্শের প্রসারে নিয়োজিত। তবে ভারতেও ক্রস ওনারশিপ নিষিদ্ধের একটি বিল এখনও সংসদে বিবেচনাধীন।

অনেকে বলছেন, সংবাদমাধ্যমকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের যে প্রস্তাব কমিশন করেছে, তা অবাস্তব। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম লাভ করতে পারছে না বা রুগ্‌ণ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব গণমাধ্যম কোম্পানির মধ্যে যাদের হিসাব রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের দপ্তর থেকে পাওয়া গেছে, তার নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেড় ডজনের বেশি সংবাদমাধ্যম লাভজনক, যা প্রমাণ করে, এ ধরনের রূপান্তর মোটেও অযৌক্তিক নয় এবং তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

মূল সমস্যা হলো, বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিসংখ্যক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যেনতেনভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। পাঠক বা শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে না পারলেও তারা টিকে থাকার চেষ্টায় বিজ্ঞাপনের দরে অস্বাভাবিক হারে ছাড় দিয়ে পুরো খাতের ক্ষতি করছে।
অন্য যে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি উঠেছে তা হলো, সাংবাদিকদের জন্য একটি জাতীয় ন্যূনতম বেতন স্কেল নির্ধারণ, যা সমতুল্য সরকারি চাকরির বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সমালোচকরা বলছেন, আর্থিক সংকটে থাকা খাতের জন্য এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং এটি মানা হলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ একটু নিবিড়ভাবে যাচাই করলে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ঘোষিত অষ্টম ওয়েজ বোর্ড যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হতো (নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট যোগ হলে), একজন রিপোর্টার বা সহসম্পাদকের বেতন এতদিনে ৯ম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীর স্তরে পৌঁছে যেত। যেসব সংবাদপত্র মালিক এই সংস্কারের বিরোধিতা করছেন, তারা মূলত সাংবাদিক-কর্মচারীদের ন্যায্য বেতন না দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের সুবিধা নিতেই বেশি উৎসুক।

আমাদের পরামর্শ সভায় দেখা গেছে, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম উভয়েই আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা তাদের আপস করতে বাধ্য করছে। ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিগত সহায়তা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে জরুরি। কমিশন দীর্ঘমেয়াদি গণমাধ্যম শিল্পের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য একাধিক কর রেয়াত ও প্রণোদনার সুপারিশ করেছে। এগুলো সরকার গ্রহণ করলে যেসব সংবাদপত্রের ক্রেতা  আছে, সেগুলো সরকারের নীতি সহায়তার কারণে আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং সাংবাদিক-কর্মচারীদের ন্যায্য বেতন-ভাতা পরিশোধে তাদের তেমন সমস্যা হবে না। তবে যারা শুধু সরকারি বিজ্ঞাপন হাতিয়ে নেওয়ার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করেন, সেগুলোর দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে। সরকারি মিডিয়া লিস্ট এবং হকার সমিতির বিক্রির হিসাব অনুযায়ী এ ধরনের পত্রিকার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
সংবাদমাধ্যমের সংস্কার নিয়ে যখন আলোচনা করছি, তখন স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য বর্তমানে বিদ্যমান বৈরী পরিবেশের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সাংবাদিকদের ওপর মৌখিক ও শারীরিক হামলা এখনও হচ্ছে, অনেকে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ কারাবন্দিও হয়েছেন। তবে তা মূলত তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। তারা একই সঙ্গে সাংবাদিক আবার রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু সাবেক স্বৈরশাসকের অনুসারী হিসেবে তারা যেসব কর্মকাণ্ড করেছেন, সেসবের কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বদলে সাংবাদিক পরিচয়ই সামনে উঠে আসছে। বিষয়টা কিছু সমস্যাপূর্ণ। আবার গণমাধ্যমের সেলফ সেন্সরশিপ ও সাংবাদিকদের ওপর বেশির ভাগ হামলার পেছনে এখন কাজ করছে সামাজিক মাধ্যমে হুমকি এবং কথিত মব ভায়োলেন্স। সরকারের এগুলো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও তা দেখা যাচ্ছে না। 

অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, তারা কোনো সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু শুধু এ বক্তব্য সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। সম্প্রতি একজন উপদেষ্টাকে বিতর্কিত প্রশ্ন করা নিয়ে একই দিনে তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের তিনজন সাংবাদিককে বরখাস্ত করা হয়েছে। কোনো ধরনের আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই এ ধরনের চাকরিচ্যুতিকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন এবং কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন–সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে এটি কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ ছিল কিনা।
এই বরখাস্তের ঘটনা অনলাইনে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার তদন্ত বা প্রতিকার করার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনও নেই। প্রস্তাবিত সাংবাদিক সুরক্ষা অধ্যাদেশ এবং একটি স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠন করলে এ ধরনের ঘটনা তদন্ত ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় তা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি দ্রুত এসব সংস্কার বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারে, তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অধরাই থেকে যাবে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ