স্মৃতি জাগানিয়া নাগরপুর জমিদার বাড়ি
Published: 18th, January 2025 GMT
জমিদার সুরেশ চন্দ্রের স্মৃতি ও কীর্তি বহনকারী নাগরপুর আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিতে অম্লান এক শহর। নাগরপুরের পূর্বে ধলেশ্বরী নদী আর পশ্চিমে বয়ে গেছে যমুনা নদী। নদীপথে নাগরপুরের সাথে সরাসরি কলকাতার দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কাজে যোগাযোগ ছিল। জানা যায় এই জমিদার বংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন যদুনাথ চৌধুরী। তিনি প্রায় ৫৪ একর জমির উপর জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। যদুনাথ চৌধুরীর তিন ছেলে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী, জগদীন্দ্র মোহন চৌধুরী ও শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী। বৃটিশ সরকারের শাসনামলে এই তিন ছেলের মধ্যে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরী সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্যে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে আলোচিত হন এবং এর পুরস্কার ও স্বীকৃতি স্বরূপ বৃটিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করে। এই উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর ছোট ছেলে সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন অপেক্ষাকৃত পাশ্চাত্য সংস্কৃতিঘেষা, সৌখিন প্রকৃতির মানুষ এবং ভীষণ ক্রীড়ামোদী। তিনি ছিলেন উপ-মহাদেশের বিখ্যাত ফুটবল দল ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। তার হাত ধরেই নাগরপুর জমিদার বাড়ি আরও পরিপূর্ণতা পায়।
১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর তৎকালীন সরকার চৌধুরী বাড়ির সব সম্পদ অধিগ্রহণ করে। পরে পুরো পরিবার চলে যায় কলকাতায়। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশ্চত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত জমিদার বাড়ির বৈঠকখানা, নহবতখানা, ঝুলন দালান, ঘোড়ার দালান, রংমহল আরও কত কি! বর্তমানে জমিদার বাড়ির মূল ভবনটি নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরো জমিদার বাড়িটি সুদৃশ্য শ্বেত পাথরের কারুকাজ খচিত। প্রাচীন ভারতের শিল্প কর্মে সজ্জিত চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠান হত ঝুলন দালানে।
শৈশবকাল থেকে প্রায় ২০ বছর নাগরপুরে অবস্থান করার কারণে এই ঐতিহাসিক জায়গা আমাকে আজও বিষ্মিত করে। মানুষের খাবার পানির পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করার জন্য ‘উপেন্দ্র সরোবর’ খনন করেন। সরোবরের চারিদিকে ঘুরলে প্রায় এক কিলোমিটার হয়। পুকুরের পারগুলো অনেক চওড়া করে বাঁধানো। পুকুরে ১২টি ঘাট রয়েছে। সরোবরের ভেতরে ৬টি বড় বড় কূপ খনন করা আছে। যাতে কখনো না শুকায়। সত্যিই তাই হয়েছে। এই সরোবর খনন করার প্রায় দেড়শো বছর অতিক্রম করেছে। এই সময়ের মধ্যে পুকুরের পানি কখনো শুকায়নি। ছোট ছোট আরও দুইটি পুকুর রয়েছে একটি বাইরের মানুষের ব্যবহারের জন্য খনন করা হয়েছিলো আরেকটি বাড়ির নারীর জন্য খনন করা হয়েছিল। নারীদের জন্য খনন করা পুকুরের ঘাট ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা।
স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল সবই আছে এই ছোট্ট নাগরপুরে। উপেন্দ্র সরোবরের পাশে ‘যদুনাথ পাইলট হাই স্কুল’। আমি ওই স্কুলেরই শিক্ষার্থী। আমার বাবা ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুল সংলগ্ন বিশাল মাঠে অনেক খেলেছি। মাঠে ঘাসে ও ধূলায় মিশে রয়েছে কত শত দিনের স্মৃতি। এই মাঠের পাশেই ‘পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয়’। জানা যায়, পুন্ডরীকাক্ষ ছিলেন রায় বাহাদুর সতীশ চন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পিতা সতীশ চন্দ্র তার চিকিৎসায় অনেক অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু পুন্ডরীকাক্ষকে বাঁচাতে পারেননি। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে সতীশ চন্দ্র চৌধুরীর মনে বৈরাগ্য সৃষ্টি হয়। সন্তানের অকাল মৃত্যুতে তিনি জনদরদী হয়ে ওঠেন। স্থানীয়দের চিকিৎসার জন্য ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয়। এই হাসপাতালে তিনি বিদেশি ট্রেনিং প্রাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ দেন। আজও চিকিৎসা নিতে আসে অনেক মানুষ।
শুনেছি এই বাড়ির নহবত খানা থেকে প্রতি ভোরে বেজে উঠতো সানাই-এর ভৈরবী ধ্বনি। সেই ধ্বনি পড়ার পরপরই পুরো এলাকার মানুষ জেগে উঠতো। দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেই ধ্বনি কিন্তু স্থাপনা আর সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও মানুষের উপকারে আসে। পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এই বাড়ির নিবিড় সৌন্দর্য।
দুঃখের বিষয় এই বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। নাগরপুর জমিদার বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণে করার সময় এসেছে। সংশ্লিষ্টরা এই বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবেন বলেই বিশ্বাস করি।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের
সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিশ্বের সব দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা বন্ধের আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে তিনি এ আহ্বান জানান। বিশ্বব্যাপী ২ নভেম্বর দিবসটি পালিত হয়।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মহাসচিবের বিবৃতিতে বলা হয়, সত্যের সন্ধানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা ক্রমবর্ধমান বিপদের মুখে পড়ছেন। এর মধ্যে রয়েছে মৌখিক নিপীড়ন, আইনি হুমকি, শারীরিক আক্রমণ, কারাবাস ও নির্যাতন। এমনকি অনেককে জীবনও দিতে হচ্ছে।
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা বন্ধের এই আন্তর্জাতিক দিবসে আমরা ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক হত্যার প্রায় ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টির বিচারই এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।’
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমানে যেকোনো সংঘাতের মধ্যে (ফিলিস্তিনের) গাজা সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ জায়গায় পরিণত হয়েছে। আমি আবারও এই ঘটনাগুলোর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি।’
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘যেকোনো জায়গায় বিচারহীনতা শুধু ভুক্তভোগী এবং তাঁদের পরিবারের প্রতিই অন্যায় নয়, বরং এটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, আরও সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার শামিল এবং গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি।’ তিনি বলেন, সব সরকারের উচিত প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা, প্রত্যেক অপরাধীর বিচার করা এবং সাংবাদিকেরা যাতে সর্বত্র স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা।’
জাতিসংঘ মহাসচিব আরও বলেন, ‘নারী সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে অনলাইনে উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকা হয়রানিমূলক আচরণ অবশ্যই আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এ ধরনের অপরাধের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাজা হয় না এবং এটি প্রায়শই বাস্তব জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাঁরা সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জন্য ডিজিটাল দুনিয়াকে নিরাপদ রাখতে হবে।’
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘যখন সাংবাদিকদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, তখন আমরা সবাই আমাদের কণ্ঠস্বর হারাই। আসুন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায়, জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবিতে এবং যাঁরা ক্ষমতার বিপরীতে সত্য তুলে ধরেন, তাঁরা যেন ভয় ছাড়াই তা করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে আমরা সম্মিলিত অবস্থান নিই।’