পে-স্কেলের ১০ গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ নামে একটি কর্মসূচির ঘোষণা আসে, যা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে শেষ সময়ে কারো কাছ থেকে পরিষ্কার কিছু জানা যাচ্ছে না।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পক্ষে বিভিন্নভাবে এই কর্মসূচির ঘোষণা আসতে থাকে। বিশেষ করে ফেসবুকে কয়েকটি গ্রুপে এ বিষয়ে প্রচার চালাতে দেখা গেছে। সেখানে এই কর্মসূচি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মতবিরোধের বিষয়টিও কেউ কেউ তুলে ধরেছেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও চায় না শিক্ষকরা এভাবে রাস্তায় নামুক। লং মার্চে নিরুৎসাহিত করতে প্রাথমিকের শিক্ষকদের নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়েছে।  সেক্ষেত্রে তাদের যৌক্তিক দাবি পূরণের উপায় বাতলে দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষকরা লিখিত দাবিনামা বা স্মারকলিপি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দিতে পারেন।

যেহেতু কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো পক্ষ থেকে পরিষ্কার বার্তা পাওয়া যায়নি; আবার শিক্ষকদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; সেই জায়গা থেকে রাইজিংবিডি ডটকম কয়েকটি জেলায় প্রাথমিকের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছিদামহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই।

কামরুলের মত ওই উপজেলার মেকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়দরগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হলে প্রায় একই তথ্য উঠে আসে।

শুধু রংপুর নয়, আরো কয়েকটি জেলার কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মসূচির কথা তারা জানলেও এতে তারা অংশ নেবেন না। আবার কেউ কেউ পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় লং মার্চ টু ঢাকার বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হননি।

বিষয়টি নিয়ে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলেছে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুজ্জামান জনির সঙ্গে। তিনি বলেছেন, আগামীকাল (২৪ জানুয়ারি) প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের ঢাকাতে কর্মসূচি আছে কিনা সেটি আমাদের জানা নেই। আর জেলা বা বিভাগীয় অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।

অবশ্য এই শিক্ষা কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, ছুটির দিন ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মস্থল ত্যাগ করার বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে।

মিঠাপুকুরের শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের কাছ থেকে কর্মসূচির বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য না পাওয়া গেলেও রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজিজুর রহমান লং মার্চ টু ঢাকার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল।

রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা হলে আজিজুর রহমান বলেন, “শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আগামীকাল (শুক্রবার) লং মার্চ টু ঢাকার একটি কর্মসূচির কথা আমরা জেনেছি। তবে আমাদের ঊর্ধ্বতন অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা এসেছে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকরা যাতে তাদের কর্মস্থল ত্যাগ না করেন। সেই বার্তা আমরা স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।”

পে-স্কেল অনুযায়ী প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের চাকরির স্তর দশম গ্রেডে উন্নতি করার দাবির বিষয়ে আজিজুর রহমান একে ‘দীর্ঘদিনের দাবি’ বলে বর্ণনা করে তিনি বলেন, এই বিষয়ে স্মারকলিপি বা লিখিত আকারে যথাযথ অধিদপ্তরে শিক্ষকরা পাঠাতে পারেন।

দাবি আদায়ের জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করা বা আন্দোলন না করার পরামর্শ রংপুরের বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজিজুরের।

বগুড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে লং মার্চ টু ঢাকার ব্যাপারে তাদের জানাশোনা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশেরও বিষয়েও তারা অবহিত।

বগুড়া থেকে প্রাথমিকের অনেক শিক্ষক ঢাকায় আসতে চেয়েও তা বাতিল করেছেন বলে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ আসায় বিভাগীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয় কিনা, সেই বিবেচনায় এই শিক্ষকেরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম সদর উপলোর ডুবাতেঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান এই কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত। রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা হলে এই শিক্ষক বলেন, জেলা শিক্ষা অফিস থেকে জারি করা পরিপত্রের কারণে অনেক শিক্ষকই আর ঢাকায় যেতে চাইছেন না।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের এই কর্মসূচিকে ন্যায্য দাবি বর্ণনা করে মিজানুর রহমান বলেন, “আগামীকালকের (শুক্রবার) কর্মসূচি সফল করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি ছিল। প্রতিটি উপজেলা থেকে অন্তত দুটি করে বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেলা শিক্ষা অফিস থেকে আমাদের পরিপত্র দেওয়া হয়েছে। তাতে বিনা অনুমতিতে কর্মস্থল ত্যাগ না করতে বলা হয়েছে।”

প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের বিধিনিষেধ অমান্যের পরিণতি সম্পর্কে এই শিক্ষকের ধারণা রয়েছে। ঢাকায় যাওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “তাদের (শিক্ষা অফিস) কাছে কর্মসূচির জন্য অনুমতি চাইলে তারা কি দেবে?”

“শিক্ষা অফিসের পরিপত্র অমান্য করে গেলে তো সমস্যা হবে। চাকরির ভয় তো সবারই আছে; তাই যাদের যাওয়ার কথা ছিল, তাদের অধিকাংশই মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন।”

তাহলে বগুড়া থেকে আপনাদের লং মার্চ কি স্থগিত করলেন- এমন প্রশ্নে শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, “স্থগিত করা হয়নি। তবে যে পরিমাণ শিক্ষকের যাওয়ার কথা, তেমনটি যাচ্ছেন না।”

লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো.

মঈনুল ইসলামের সই করা একটি পরিপত্র বা আদেশের কপি রাইজিংবিডি ডটকমের হাতে এসেছে।  তাতে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো শিক্ষক কর্মস্থলের বাইরে যেতে পারবেন না। এই নির্দেশ ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে দেশের শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের তরফে দীর্ঘদিন কথা হচ্ছে। প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়ে দীর্ঘদিন কথা বলে আসছেন চিন্তাবিদ, লেখক ও গণবুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।

বগুড়ার শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে রয়েছি। আমরা চাই পদোন্নতিসহ আমাদের দশম গ্রেডে উন্নীত করা হোক।”

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোমলমতী শিশুদের শিক্ষার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসেন, জ্ঞানের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। অথচ তারা তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবী; বেতন-ভাতাও কম।

এই বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, “বর্তমানে আমরা ১৩তম গ্রেডের তৃতীয় শ্রেণির প্রথম ধাপের মর্যাদায় রয়েছি। দশম গ্রেডে উন্নীত করলে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা পাব।”

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার নন্দগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের বগুড়া জেলার সাভাপতি রাসেল কবির অবশ্য ভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। শুক্রবারের ঢাকার কর্মসূচি নিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকদের মধ্যে মতপার্থক্যের বিষয়টি সামনে আসে তার কথায়।

রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা বলে রাসেল কবির বলেন, পুরো বাংলাদেশে আমাদের রেজিস্ট্রেশনভূক্ত সংগঠন ছয়টি। তারা আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে অবস্থান কর্মসূচি ডেকেছিল। কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের মাহবুবু রহমান চঞ্চল নামের একজন শিক্ষক ও লিপি নামের এক ম্যাডাম আমাদের টেক্কা দিতে নতুন কিছু শিক্ষক যারা চাকরির নিয়মই এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, তাদের নিয়ে ২৪ তারিখে লং মার্চের ডাক দিয়েছেন।

“আমাদের যে ছয়টি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সংগঠন রয়েছে, এর কোনো নেতৃবৃন্দ বা শিক্ষক এর সঙ্গে (লং মার্চ) জড়িত নন,” দাবি করেন রাসেল কবির।

শিক্ষার গুণগত মান ঠিক করার জন্য আগে পরিমাণগত দিকটি ঠিক করার পক্ষে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কেন আন্দোলন হয় না; সেই বিষয়েও মানুষকে সজাগ করার কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি।

বিভিন্ন সময় দেওয়া বক্তব্যে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ প্রশ্ন রেখেছেন, “আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কত বেতন পান? যারা ১১ গ্রেড, ১২ গ্রেড, ১৩ গ্রেডে চাকরি করেন, তাদের বেতন ১১ হাজার, ১২ হাজর, ১৩ হাজার; এই রকম। সেই বেতন দিয়ে তাদের কাছ থেকে আমরা যে বেতন আশা করব, সেটি খুব উন্নত মানের হতে পারে না।”

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অধ্যাক সলিমুল্লাহ সরকারি কলেজে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে কেন প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য তেমন কিছু হচ্ছে না; তা নিয়ে আক্ষেপ করেন।

তিনি বলেন, “প্রাথমিকের শিক্ষকদের জন্য আপনারা আন্দোলন করছেন না কেন?”

প্রাথমিক শিক্ষকরা কয়েক বছর ধরে বেতন বৈষম্য দূরীকরণ ও দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের জন্য আন্দোলন করে আসছে। ২০২৪ সালজুড়ে ঢাকায় অনেক কর্মসূচি দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ছিল তেমন একটি কর্মসূচি। সেদিনই তারা দাবি পূরণের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল হাকিমের কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন।   

 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন রংপুর প্রতিনিধি আমিরুল ইসলাম ও বগুড়া প্রতিনিধি এনাম আহমেদ।)

ঢাকা/হাসান/রাসেল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ ক ষকদ র ক দশম গ র ড এই শ ক ষ আজ জ র র পর ষ ক র শ ক ষকর র জন য দ র কর কর র ন উপজ ল সরক র ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

“সারা দিন খাবারের রাজ্যে থাকি। কিন্তু ক্ষুধা লাগলে সময় মতো খাবার খাওয়ার সুযোগ হয় না প্রায়ই। আমরা এই ঢাকার অভিজাত শ্রেণির মানুষের কাছে সুস্বাদু, দামি খাবার কাছে পৌঁছে দেই ঠিকই কিন্তু মন চাইলেও তা খেতে পারি না টাকার জন্য।”

কথাগুলো একজন ফুড ‘ডেলিভারি ম্যান’ আরিফ হাসানের।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বাসা-বাড়িতে গিয়ে খাবার সরবরাহের নতুন ব্যবস্থায় অপরিহার্য কর্মী এই ডেলিভারি ম্যানরা। বাংলায় ‘খাবার সরবরাহকারী’ না বলে একটু অভিজাত ইংরেজিধাঁচে তাদের ডাক হয় ‘ফুড ডেলিভারি ম্যান’ নামে। পিঠে ঝোলানো বড় ব্যাগে খাবার নিয়ে দিনরাত সাইকেলে ছুটতে দেখা যায় তাদের।

হাতেগোনা কয়েক বছর হলো চাকরি বা পেশা হিসেবে ‘ফুড ডেলিভারি ম্যান’ নামে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। অথচ নতুন এই পেশায় শুরু থেকেই জুড়ে গেছে কষ্ট আর অতৃপ্তির গল্প।

যেমনটি বলছিলেন আরিফ হাসান। তারা ভাষায়, চোখের সামনে এত এত লোভনীয় খাবার দেখে মাঝেমধ্যে খেতে মন চাইলেও চড়া দামের কারণে তা হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ ফুড ডেলিভারি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে এই ধরনের দামি খাবার কেনার ধাক্কা কুলিয়ে উঠতে পারেন না তিনি।

রাজধানীর শ্রমব্যবস্থায় পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকলেও প্রয়োজনের তাড়ায় অনেককে পছন্দ না হলেও কিছু না কিছু করে টিকে থাকতে হয়। আরিফ হাসানও তাদের মতো একজন; তবে হার না-মানা এক তরুণ।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলে ফুড ডেলিভারি দিচ্ছিলেন আরিফ হাসান। সেখানে তার সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডি ডটকমের।

আরিফ হাসান একটি বেসরকারি কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। তার বাবা একজন কৃষক। ঢাকায় পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার খরচ নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হয়; বাড়িতে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠাতে হয় তাকে। তাই পড়াশোনা চালিয়ে কিছু একটা কাজ করে রোজগারের ইচ্ছাশক্তি থেকেই ফুড ডেলিভারিকে বেছে নেন তিনি।

রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরিফ হাসানের চোখের কোণা ছলছল করে উঠতে দেখা যায়। পড়াশোনা, কাজ ও গ্রামে থাকা আপনজনদের নিয়ে তার একটি ছোট্ট জগতে এখন পদে পদে লড়াই। তার জীবনে টাকাটা এখন খুব জরুরি।

আরিফ হাসানের মনে হয়েছে, এই পৃথিবীতে সবার জীবন সমান নয়। এই ঢাকা শহরে যাদের টাকা আছে, তারা প্রয়োজন ছাড়া হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে থাকেন।

“তবে আমার মতো যারা আছেন, তারা সামান্য দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে আমাদের মতো যারা অসহায়, তাদের দেখার কেউ নেই। তাদের কষ্ট শোনারও কেউ নেই,” বলেন তিনি।

আরিফ হাসান রাজধানীর আজিমপুরে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে একটি মেসে থাকেন। সকাল সকাল তিনি বেরিয়ে পড়েন জীবিকার সন্ধানে। ফুড ডেলিভারির অ্যাপ খুলে অপেক্ষা করেন অর্ডারের জন্য।

অর্ডার আসে, সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে তিনি ছুটে যান ডেলিভারি দিতে। দিনে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয় তাকে, যে কারণে দিন শেষে ক্লান্তি তাকে পেয়ে বসে।

ফুড ডেলিভারি দিতে নিজের সাইকেল দরকার হয়; বলতে গেলে এই পেশায় এটি একটি বিনিয়োগ। আরিফ হাসানও সাইকেল নিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন। তবে তার সেই প্রথম সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। তার রোজগারের অবলম্বনটি কেউ চুরি করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি।

আরিফ হাসান চুরির ঘটনার সেই বর্ণনা শোনালেন। একদিন তাড়াহুড়ায় সাইকেলে তালা না মেরে অর্ডার নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনই চোর তার সাইকেলটি নিয়ে চম্পট দেয়। চোর তো জানত না যে, সেদিনই তার পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের তারিখ ছিল! জানলেও হয়তো চোর চুরিই করত।

নতুন সাইকেল কিনে সব খরচ জোগাড়ের চাপ ছিল আরিফ হাসানের। তাই পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে পারেননি সেবার। শিক্ষাজীবন তার পিছিয়ে যায় এক বছর। কষ্টের দিনে যোগ হয় আরো কষ্ট! তাকে কাজ দেওয়া প্রতিষ্ঠানও শুনিয়ে দেয় কটূ কথা; অবহেলার জন্য দায় দেয় তার ঘাড়েই।

সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে আরিফ হাসান বলেন, “সেদিনের কথা কখনো ভুলব না।”

ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো দায় নেয় না। আরেকবারের ঘটনা মনে পড়ে যায় তার। তিনি বলেন, একবার ডেলিভারি দিতে যাওয়ায় সময় বাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মক আহত হয়েছিলাম; অনেক দিন কাজ যেতে পারেননি।

কাজে থাকলে দুপুরে খাবারের কী ব্যবস্থা হয়, জানতে চাইলে আফসোস নিয়ে আরিফ হাসান বলেন, “আমি দুপুরে সেইভাবে খাই না। রাস্তার পাশের দোকান থেকে কলা-রুটি সিঙ্গাড়া খেয়ে নেই। তা ছাড়া খাওয়ার সময়ও হয়ে ওঠে না; অর্ডারের চাপ থাকে বেশি। ডেলিভারি করতে করতে সময় চলে যায়। রাতে মেসে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে ভাত খাই। মেসের খাবার কেমন, তা তো জানেনই ভাই।”

হোম ডেলিভারির খাবার নিয়ে অনেক অভিযোগের খবর রয়েছে। একটা চাইলে আরেকটা প্যাকেট করে পাঠিয়ে দেওয়া, মান ঠিক না থাকা, পচা-বাসি খাবার পাঠানো, দেরিতে পাঠানো- এমন অনেক অভিযোগ শোনা যায়। অভিযোগের ক্ষেত্রগুলোতে ডেলিভারিম্যানদের দায় না থাকলেও বাসার দরজায় পেয়ে ভুল-ত্রুটির জন্য তাদেরই কথা শুনিয়ে দেয় গ্রাহকরা।

আরিফ হাসান বলেন, “সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে তখন, যখন কাস্টমাররা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এমন অনেক কাস্টমার আছেন, সামান্য দেরি হলে বাজেভাবে অপমান করেন। অথচ কাস্টমারের খাবারটা তার লোকেশনে তার বিল্ডিংয়ের নিচে নিয়ে গেলে বলেন, পাঁচ তলায় আসেন, সাত তলায় আসেন, আট তলায় আসেন।”

“সাইকেল চালাতে চালাতে পায়ের বারোটা বেজে যায়; তখন সাত তলায়, আট তলায় ওঠাটা শরীরে কুলায় না। যদি বলি, অনেক টায়ার্ড আছি; আপনি একটু কাউকে পাঠান। তখন অনেক কাস্টমার তাদের সময় থাকলেও আমাদের কষ্ট দিয়ে তারা আনন্দ পায়। এসময় নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হয়,” যোগ করেন আরিফ হাসান।

ডেলিভারিম্যানদের ক্যালরি খরচ নিয়ে ব্রিটিশ স্পোর্টস সায়েন্স ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞ জেন ওয়েক
২০১৯ সালে ব্রিটেনের অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানি ডেলিভারুর সাইকেল রাইডারদের ওপর একটি সমীক্ষা চালান।

সমীক্ষায় জেন ওয়েক দেখতে পান, ৭০ কেজি ওজনের একজন ফুড ডেলিভারির সাইকেল রাইডারকে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০ ক্যালরি খরচ করতে হয়, যেটি অন্যান্য পেশার চেয়ে অনেক বেশি। এমন কী একই ওজনের অগ্নিনির্বাপণ-কর্মীদের ঘণ্টায় ব্যয় হয় ৮৪৫ ক্যালরি।

২০১৯ সালে ফোর্বস সাময়িকীতে সমীক্ষাটির ফলাফল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। জেন ওয়েকের সেই ৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তির ক্যালরি খরচকে ৬০ কেজির ব্যক্তির বেলায় রূপান্তর করলে সেটি হয় ঘণ্টায় ৯২৬ ক্যালরি।

ওই সমীক্ষায় ক্যালরি খরচের হিসাবে শুধু তাদের সাইকেল চালানোকেই ধরা হয়নি; জেন ওয়েক সেই সঙ্গে ফুড ডেলিভারির রাইডারকে যা যা করতে, তার প্রতিটি শারীরিক কর্মকাণ্ডকেই আমলে নেন।

ডেলিভারিম্যানদের সম্পর্কে জানতে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলে রাজধানীর ‘পিজ্জা অন টাইম’ নামে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ইন চিফ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “সাধারণত অ্যাপের মাধ্যমে আমাদের এখানে বিক্রি হয়ে থাকে। যে ডেলিভারম্যানরা কাজের জন্য আসেন, তারা বেশিরভাগই তরুণ। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী বেশি। তাদের দেখলে মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে; তবে কিছু করার নেই আমাদের। তারা দুপুরের খাবারেরও সময় পায় না মাঝে মাঝে। তারা কঠোর পরিশ্রম করেন। আমরাও চাই, মানুষ তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্যটা দিক।”

ডেলিভারিম্যানদের অধিকার সুরক্ষা বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী আহমেদ স্বপন রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমাদের দেশের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং তারা তা করছে কিনা, সেটি সরকারকে তদারকি করতে হবে।”

“বাংলাদেশে বর্তমানে যে সব অনলাইন-ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর বেশিরভাগ শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দেয় না। আবার শ্রমিকরাও আইনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার ইচ্ছা দেখান না নানা ঝামেলার কারণে। তারা যদি আইনের পথে হাঁটতেন, তাহলে ভবিষ্যতে শ্রমিকদের জন্য ভালো হতো,” যোগ করেন আহমেদ স্বপন।

(আরিফ হাসান অনুমতি না দেওয়ায় তার ছবি প্রকাশ করেনি রাইজিংবিডি ডটকম।)

ঢাকা/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
  • প্রযুক্তির দুনিয়ায় পা রাখলেন আরেক ‘গেটস’, বাবার মতো কি সফল হতে পারবেন