গ্রিনল্যান্ডে নিরাপত্তা জোরদার করতে যাচ্ছে ডেনমার্ক
Published: 29th, January 2025 GMT
আর্কটিক ও উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জোরদারের পরিকল্পনা করছে ডেনমার্ক। ওই অঞ্চলে নিরাপত্তা বাড়াতে সোমবার অতিরিক্ত ২০৫ কোটি ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে কোপেনহেগেন। গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবির প্রেক্ষাপটে ইউরোপের দেশটি এ নিরাপত্তা জোরদার করতে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড ট্রাম্পের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। ডেনমার্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ট্রোয়েলস লুন্ড পৌলসেন এক বিবৃতিতে বলেন, আর্কটিক ও উত্তর আটলান্টিকের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
আলজাজিরা জানায়, গ্রিনল্যান্ড ইস্যুতে ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী মেটা ফ্রেডেরিকসন ইউরোপীয় ঐক্য চাচ্ছেন। এর ভিত্তিতে চলতি সপ্তাহে তিনি ফ্রান্স, জার্মানিসহ সামরিক জোট ন্যাটোর অন্য শরিকদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ গুরুতর পরিস্থিতির মুখোমুখি রয়েছে। মহাদেশটিতে যুদ্ধ চলছে। সেই সঙ্গে পাল্টে গেছে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। এ ধরনের মুহূর্তে সবার ঐকবদ্ধ থাকাটা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘ডেনমার্ক একটি ছোট দেশ। তার শক্তিশালী মিত্র রয়েছে। সেইসঙ্গে এটি সুদৃঢ় ইউরোপীয় সম্প্রদায়ভুক্ত, যার মাধ্যমে আমরা একত্রভাবে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারি।’
খনিজ সম্পদে পূর্ণ গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। বরফ আচ্ছাদিত বিশ্বের বৃহত্তম এ দ্বীপ কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিনল্যান্ডের পাশ দিয়েই জাহাজ চলাচলের একটি পথ রয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেওয়ার পর ট্রাম্প দ্বীপটি দখলের সুর জোরালো করেন। এ নিয়ে গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের সঙ্গে আমেরিকার চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য গ্রিনল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ। ডেনমার্ককে অবশ্যই গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে। কার্যত দ্বীপটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পিটুফিক মহাকাশ ঘাঁটি রয়েছে। এ সিস্টেম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আগাম সতর্কতা দিয়ে থাকে। ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে পৌঁছানোর সহজ পথও এ গ্রিনল্যান্ড। মাত্র ৫৭ হাজার বাসিন্দার দ্বীপটির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে আছে ডেনমার্ক। প্রয়োজনের তুলনায় সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই।
সূত্র জানায়, নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে গ্রিনল্যান্ডের পাশে আর্কটিক অঞ্চলে তিনটি নতুন জাহাজ মোতায়েন করবে ডেনমার্ক। সেইসঙ্গে আরও বেশি দূরপাল্লার ড্রোন মোতায়েন করা হবে; বাড়ানো হবে স্যাটেলাইট সক্ষমতাও। ফ্রান্সের চারগুণ বড় অঞ্চলটির নিরাপত্তায় বর্তমানে ডেনমার্ক চারটি পুরাতন জাহাজ, একটি বিমান দিয়ে নজরদারি কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন দেশকে চাপে ফেলতে শুল্ক আরোপের পদ্ধতি নিয়েছেন ট্রাম্প। গতকাল দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ওভাল অফিসে প্রবেশের প্রথম সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের প্রবেশ, ফেরত পাঠানো অভিবাসন প্রত্যাশীদের গ্রহণ করানো, যুদ্ধ বন্ধ অথবা কোনো অঞ্চলের দখল নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ভ্রু কুচকানি দেখিয়েছেন। দাবি না মানলে এ সব ক্ষেত্রে তিনি একটি সাধারণ হুমকিকে ব্যবহার করেছেন–শুল্কারোপ। সাধারণত বাণিজ্যের বিষয়ে জটিলতায় ট্রাম্প শুল্ক আরোপের প্রসঙ্গে তুলতেন। এবার তিনি এমন অনেক বিষয়ে এটিকে ব্যবহার করছেন, যেখানে বাণিজ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এটি এমন এক পদ্ধতি যা অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে খুব কম দেখা গেছে। এরইমধ্যে নথিপত্রহীন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ফিরিয়ে নিতে তিনি মেক্সিকোকে শুল্কের হুমকি দিয়েছেন। কলম্বিয়া সামরিক বিমানে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রহণ করছিল না। ট্রাম্প শুল্ক আরোপের হুমকি দিলে তারা নমনীয় হতে বাধ্য হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।