সাইফুল-সাজ্জাদে তটস্থ চট্টগ্রামের ৫ থানার পুলিশ
Published: 31st, January 2025 GMT
চট্টগ্রামের পাঁচ থানার পুলিশ তটস্থ দুই চিহ্নিত সন্ত্রাসীর কাছে। তাদের নিজস্ব বাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে দিশেহারা বায়েজিদ বোস্তামী, পাঁচলাইশ, খুলশী, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী থানার অন্তত ২০ লাখ মানুষ। সবার কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক সাইফুল ইসলাম ওরফে বার্মা সাইফুল (৩৪) ও সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ (২৫)। খুন, অপহরণ, ছিনতাই, জমি দখল– এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করেন না। কিন্তু পুলিশ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। ফেসবুক লাইভে গত মঙ্গলবার সাজ্জাদ হত্যার হুমকি দিলে জিডি করেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার। সিএমপির বিজ্ঞপ্তিতে সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারে তথ্যদাতা ও সহায়তাকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
নগর ছাত্রদলের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক সাইফুল বায়েজিদ বোস্তামী থানার বার্মা কলোনির নুরুল আমিনের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত ২৯টি মামলা রয়েছে। সাইফুলের দুই ভাই– সবুজ ওরফে বার্মা সবুজ ও মো.
স্থানীয় সূত্র জানায়, নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, পাঁচলাইশ, খুলশী থানা ও আশপাশের এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ সবকিছুরই নিয়ন্ত্রণ করে তিন ভাই। গত ১১ অক্টোবর বায়েজিদ থানার শান্তিনগর এলাকায় দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন মোহাম্মদ ইমন (২৮)।
ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাইফুল ও সবুজকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এর পর গত ২৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন সবুজ।
২০১০ সালে চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধে হাতেখড়ি সাইফুলের। এর পর নানা অপরাধে কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু প্রতিবার জামিনে বেরিয়ে আরও বেপরোয়া হয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সক্রিয় হন সাইফুল। নগরের ষোলশহর এলাকায় জুয়ার আসর ও মাদকের ডেরা খোলেন। স্থানীয়দের সহায়তায় মাদকের আখড়া ও জুয়ার আসর বন্ধ করে পুলিশ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সাইফুল ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা গত ১২ জানুয়ারি দিন-দুপুরে লোকজনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিনসহ অন্তত পাঁচজন আহত হন। নাসির উদ্দিন জানান, এলাকায় জুয়া, মাদকসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে কমিটি করা হয়। কমিটির তথ্যে অভিযান চালিয়ে পুলিশ আখড়া বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বার্মা সাইফুলের নেতৃত্বে স্থানীয়দের ওপর হামলা চালানো হয়।
গত ২৫ জানুয়ারি নগরের পাঁচলাইশ থানার হিলভিউ আবাসিক এলাকা থেকে মন্দিরের পুরোহিতসহ তিনজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে বার্মা সাইফুলের বাহিনী। পরে পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের একজন বাছির আহম্মদ ওরফে রানা। গত ১১ অক্টোবর বাছিরকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে সাইফুল বাহিনীর হামলার শিকার হয় পুলিশ।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বায়েজিদ থানা পুলিশের সঙ্গে সাইফুলের সখ্য রয়েছে। এ জন্য অন্যান্য থানা এলাকায় অপরাধ করেও তিনি নিরাপদ আছেন নিজের এলাকায়। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেও সাইফুলের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত ২৬ জানুয়ারি রাতে তিনি ফেসবুক পোস্টে লেখেন– তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী কি আওয়ামী দোসরদের তৈরি করা তালিকা? সেদিন ওসি ফোন করে বললেন, কয়েকজন স্থানীয় ছেলেকে রাতে পুলিশের টহল টিমকে সহযোগিতার জন্য পাঠাতে। তখন তালিকা কি পকেটে থাকে?
এ বিষয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, ‘একজন সন্ত্রাসীর কাছে কেন সহযোগিতা চাইতে যাব? সন্ত্রাসীরা নিজেকে রক্ষায় অনেক কিছুই বলে। সাইফুল ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সে থাকতে পারে– এমন সম্ভাব্য সব জায়গায় হানা দেওয়া হচ্ছে। তার সহযোগীদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
তিন খুনের পরও অধরা সাজ্জাদ
বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই ফোন আসে সাজ্জাদের। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলে শিষ্যদের দিয়ে হামলা করান। নয়তো প্রকাশ্যে চালান গুলি। বিদেশে পলাতক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের শিষ্য হিসেবে ছোট সাজ্জাদের অপরাধে হাতেখড়ি হলেও, এখন নিজেই চালান বাহিনী। গত বছরের ২৯ আগস্ট রাতে নগরের কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে আধিপত্যের লড়াইয়ে গুলিতে নিহত হন মো. আনিস (৩৮) ও মাসুদ কায়ছার (৩২)। এ ঘটনায় হাটহাজারী ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার পৃথক মামলাতেই আসামি সাজ্জাদ।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে বায়েজিদ বোস্তামীর কালারপুলে নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে গুলি চালান সাজ্জাদ। ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়া এলাকায় মাইক্রোবাসে এসে গুলি করে হত্যা করেন ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন তাহসীনকে (২৬)। পরে গত ৫ ডিসেম্বর অক্সিজেন এলাকায় সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালালে পুলিশের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে পালিয়ে যান সাজ্জাদ। দুই পুলিশসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুই মাসেও তাঁর নাগাল পায়নি পুলিশ। অবশ্য ২৭ জানুয়ারি অস্ত্রসহ তাঁর ছয় অনুসারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী এলাকায় সাজ্জাদের বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত পাঁচ বাসিন্দা জানান, মানুষ সাজ্জাদের বাহিনীর কাছে অসহায়। এখানে তাঁকে চাঁদা না দিয়ে একটি ইটও সরানো যায় না। একে একে তিনটি খুনের পরও আঁতাতের কারণে সাজ্জাদকে ধরে না পুলিশ।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (জনসংযোগ) রইছ উদ্দিন বলেন, সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করতে গেলে গুলি করে পালিয়ে যান তিনি। গ্রেপ্তার করে তাঁর কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করাই পুলিশের লক্ষ্য।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর র এল ক য় সহয গ নগর র অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনকে ফেসবুকে হুমকি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মুখ্য সংগঠক মোত্তাসিন বিশ্বাস। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে এ হুমকি দেন তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আনোয়ার হোসেন।
ফেসবুক পোস্টে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের দুটি ছবি লাল দাগ দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেন মোত্তাসিন। ক্যাপশনে তিনি আনোয়ার হোসেনের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘....সত্য লিখুন, না হলে আপনিও ছাড় পাবেন না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
মোত্তাসিন বিশ্বাসের পোস্টের পর মন্তব্যের ঘরে আনোয়ার হোসেনকে একাধিক আইডি থেকে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার বেলা ৩টা ১৬ মিনিটে মোত্তাসিনের আইডি থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পর পোস্টটি তাঁর ওয়ালে আবার দেখা যায়। এ হুমকির প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ’।
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে মোত্তাসিন বিশ্বাস আজ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক পোস্টে হলুদ কথাটা লেখা ঠিক হয়নি। এটি গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের শহীদ সাটু অডিটরিয়ামে জেলা পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাধা দিয়ে থামিয়ে দেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘পুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ খবরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েই এমন পোস্ট করেছেন বলে জানিয়েছেন মোত্তাসিন।
তাৎক্ষণিকভাবে লিখে ফেলেছিলেন, পরে মুছে দিয়েছেন। আনোয়ার হোসেনের করা কোন সংবাদটির বিষয়ে পোস্ট করেছেন, জানতে চাইলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাকে বাধা দেওয়ার সংবাদটির কথা জানান।
মোত্তাসিন বিশ্বাস আরও বলেন, প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন চব্বিশের আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু সংবাদটি এভাবে কেন লিখেছেন, তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি তাঁদের এড়িয়ে গেছেন। সে জন্যই তিনি ফেসবুকে লিখেছেন।
আনোয়ার হোসেন জিডিতে উল্লেখ করেছেন, স্ট্যাটাসে তাঁর দুটি ছবি ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই পোস্টে মোত্তাসিনের অনুসারীসহ আরও অনেকে খারাপ মন্তব্য করে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় জিডি করার কথা জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন। এটি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আবদুর রাহিম বলেন, এই পোস্ট দেওয়ার পর রাতে তাঁরা এটি নিয়ে সভা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পোস্টটি ডিলিট করা হবে।
আরও পড়ুনপুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা২৭ এপ্রিল ২০২৫সাংবাদিক সমাজের নিন্দা-প্রতিবাদআনোয়ার হোসেনকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় জরুরি সভা করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ। বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গতকাল মঙ্গলবারের সভায়। অবহিত করার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাবতীয় সংবাদ বর্জন করা হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিটিজেএ) সভাপতি রফিকুল আলম। উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রেসক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিটিজেএর নেতা ও সদস্যরা।
সভার পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশে একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে আপত্তিজনক ও হুমকিস্বরূপ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব অধিকারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বাক্স্বাধীনতার অধিকার। একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে ফেসবুকে এমন পোস্ট সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ, যা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত করেছে।’ অবিলম্বে মোত্তাসিন বিশ্বাস তাঁর দেওয়া পোস্টটি প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ না করলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।