ইদানীং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ই-সিগারেট, ভেপ, হিটেট টোব্যাকো পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। লোকজনকে এ বলে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে যে, ‘ই-সিগারেট প্রচলিত সিগারেটের বিকল্প, ধূমপান ত্যাগে কার্যকর। সবচেয়ে বিভ্রান্তির কথা হলো, ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর।’
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিকোটিনযুক্ত ই-সিগারেট আসক্তি বাড়ায় ও স্বাস্থ্যহানিকর। দীর্ঘ মেয়াদে এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে এখনো জানা না গেলেও এটা প্রতিষ্ঠিত যে এগুলো বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে কিছু উপাদান ক্যানসার, ফুসফুস ও হার্টের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ই-সিগারেটের ব্যবহার বুদ্ধি বিকাশের প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত করে। এটি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ভ্রূণের বিকাশ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এমনকি পথচারীদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ ই-সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া।
সবচেয়ে বিভ্রান্তির কথা হলো, ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর।অন্যান্য ক্ষতি
ই-সিগারেট একটি কৃত্রিম সিগারেট, যা আগুন ধরানো ছাড়াই টান দিলে ধোঁয়া বের হয়। এটি নেশা উদ্দীপক ও মাদকাসক্তি তৈরি করে। ভেপিং ব্যবহারকারীদের শরীরে ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়ে, যা মস্তিষ্কে প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি তৈরি করে। ফলে একধরনের আসক্তি হয়।
ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণ গরম হয়ে উৎপাদিত ফরমালডিহাইড শরীরে রক্ত সঞ্চালন ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ই-সিগারেটের ধোঁয়া থেকে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বের হয়, তা অন্যান্য স্বাভাবিক তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যেও রয়েছে। তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব আসল সিগারেটের চেয়ে কম নয়।
ই-সিগারেট থেকে নির্গত ফ্রি র্যাডিকলস ফুসফুসের কোষগুলোতে বিষক্রিয়া তৈরি করে। ই-সিগারেটের হিটিং এলিমেন্ট এর তরল দ্রবণকে অ্যারোসলে রূপান্তরিত করে। এতে উৎপন্ন বাষ্প নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে শরীরে ঢুকে সরাসরি ফুসফুস, রক্তপ্রবাহ ও শরীরের অন্যান্য কোষও আক্রমণ করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ ক্ষতিকর। ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের শিকার হতে পারেন।
শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্যও বিপজ্জনক ই-সিগারেটের নিকোটিন। এই নিকোটিন শুধু শ্বাসনালির মিউকাসের ক্ষতি করে না, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে।
ই-সিগারেটে ব্যবহৃত শক্তিশালী ব্যাটারি দিয়ে তাপ উৎপন্ন হয়। ব্যাটারির বিস্ফোরণে ব্যবহারকারীর মারাত্মকÿ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, এমনকি মৃত্যুপর্যন্ত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যে তরুণেরা ই-সিগারেট ব্যবহার করেন, পরবর্তী সময়ে তাঁদের সাধারণ সিগারেট ব্যবহার করার সম্ভাবনা প্রায় তিন গুণ। আবার অনেকে ই-সিগারেটের সঙ্গে ধূমপানও করেন, যা ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে। সাধারণ ধূমপায়ীদের তুলনায় দ্বৈত রকমের সিগারেট ব্যবহারকারীদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি ৫০০ শতাংশ বেশি।
শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিশ্বের ১২১টি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ও বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে ৩৯টি দেশ। তাই এ বিষয়ে আমাদেরও সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
ড.
অরূপ রতন চৌধুরী, প্রফেসর ও অনারারি সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ডেন্টিস্ট্রি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স গ র ট ব যবহ র
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।