লাইনে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান অন্তঃসত্ত্বা সানজিদা
Published: 11th, February 2025 GMT
‘হঠাৎ দেখি, লাইনে দাঁড়ানো একটা মেয়ে পড়ে গেল। এর পর কয়েকজন নারী দ্রুত ধরাধরি করে তাকে তুলে ভ্যানগাড়িতে শুইয়ে দিয়েছে। তার কানের মধ্যে একটি শলা ঢুকিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলাম। দেখলাম, কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটি পুরোপুরি অজ্ঞান।’
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারুন শেখ। ঘটনাটি গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকার দীপিকার মোড়ের। সরকারি সংস্থা টিসিবি গতকাল সোমবার সেখানে সাশ্রয়ী দরে ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেছে। ট্রাকের পাশেই তিনি ভ্যানে করে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিক্রি করছিলেন।
সমকালকে এই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী বলেন, মেয়েটি পড়ে গেছে দেখে আমি আর লাইনে দাঁড়ালাম না। তাকে তোলার চেষ্টা করলাম। ট্রাক থেকে কয়েক ফুট দূরে একটি ভ্যানগাড়ির ওপর মুখে মাস্ক পরে বসে থাকা এক নারীকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে হারুন শেখ বললেন, এটিই সেই মেয়ে।
তাঁর কথার সূত্র ধরে আলাপ হয় ওই নারীর সঙ্গে। তাঁর নাম সানজিদা বেগম। বয়স হবে ২০-২২ বছর। পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দা এই নারী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নাখালপাড়া থেকে দীপিকার মোড়ের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। ভরদুপুরে তপ্ত রোদে এই পথ হেঁটে এসে আধঘণ্টা লাইনে দাঁড়ান তিনি। এর পরই সড়কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
সানজিদা বলেন, আমার স্বামী একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ছোট চাকরি করতেন। মাসখানেক আগে চাকরি চলে গেছে। এখন বেকার। এ জন্য বাধ্য হয়ে ফুফুর কাছ থেকে টাকা ধার করে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছি। রোদের কারণে মাথা ঘুরে পড়ে গেছি। এর পর আর কিছু মনে নেই।
দীপিকার মোড়ে দেখা মিলেছে আবদুল করিম নামে আরেক ক্রেতার। এই বৃদ্ধ প্রায় চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে পেরেছেন। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ আবদুল করিমের যেন সাত কেজি পণ্য বহন করার ক্ষমতা নেই। তাই পণ্য নিয়ে বসে পড়েন একটি ভ্যানের ওপর। তিনি জানান, বাসায় তাঁর মেয়ে আছে। আয়-রোজগার বলতে মেয়েটি বাসাবাড়িতে কাজ করে যা পায় তা-ই। তার স্বামীও ছোট চাকরি করে। দু’জনের এই আয়ে সংসার চলে না। তাই তিনি পণ্য কিনতে এসেছেন।
টিসিবির ট্রাকের পেছনে থাকা নারীদের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আরও একটি ঘটনা ঘটেছে মিরপুরের কালশী এলাকায়। দীর্ঘ সময় লাইনে থাকার পর সেখানেও এক বৃদ্ধ নারীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন সমকালের ফটো সাংবাদিক।
অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটেছে। দুপুর দেড়টার দিকে কারওয়ান বাজারে টিসিবির সামনে থাকা ট্রাকের পেছনে নারীদের সারিতে কে কার আগে পণ্য নেবেন, তা নিয়ে ঠেলাঠেলি লেগে যায়। এক পর্যায়ে এক নারী আরেক নারীকে ধাক্কা দিয়ে ট্রাকের নিচে ফেলে দেন। পড়ে যাওয়া রাহেলা বেগম জানান, তিনি মগবাজার থেকে এসেছেন। স্বামী নেই। আয়ের একমাত্র ভরসা ছিল ছেলে। কিন্তু ছেলে ভরণপোষণ দেয় না। তাই কম দামের পণ্যই তাঁর ভরসা।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য পরিবার কার্ডের পাশাপাশি গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগরে ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে টিসিবি। ৩১ ডিসেম্বরের পর এই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক মাস ৯ দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল থেকে আবারও ঢাকা শহরের ৫০টি এবং চট্টগ্রামের ২০টি স্থানে ট্রাকে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। বিক্রির প্রথম দিনেই ভোক্তার ব্যাপক চাপ লক্ষ্য করা গেছে।
ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল (সয়াবিন বা কুঁড়ার তেল), দুই কেজি করে মসুর ডাল ও ছোলা, এক কেজি চিনি ও ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারছেন। প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের দাম ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০ টাকা, চিনি ৭০ টাকা, ছোলা ৬০ টাকা ও আধা কেজি খেজুর ৭৮ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। মূলত আসন্ন রমজান উপলক্ষে বিক্রির তালিকায় ছোলা ও খেজুর যুক্ত করা হয়েছে।
টিসিবির ট্রাক থেকে এ পাঁচটি পণ্য কিনতে একজন ভোক্তার লাগবে ৫৮৮ টাকা। একই পরিমাণ পণ্য বাজার থেকে কিনতে খরচ হবে প্রায় ১ হাজার ২০ টাকা। সেই হিসাবে একজন ক্রেতার সাশ্রয় হয় ৪৩২ টাকার মতো। এই অর্থ সাশ্রয়ের জন্যই ক্রেতাদের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ চলে।
গতকাল রাজধানীতে সরেজমিন দেখা গেছে, শিশু থেকে বৃদ্ধ– প্রায় সব বয়সের নারী-পুরুষ পণ্য কেনার জন্য ট্রাকের পেছনে ভিড় করছেন। এই লাইনে যেমন রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ, তেমনি রয়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাও। কোনো কোনো এলাকায় চাকরিজীবীদেরও লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে। কেউ কেউ সংকোচে নিজেকে আড়াল করারও চেষ্টা করেছেন।
ক্রেতার কেউ কেউ ট্রাকের সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কাঁঠালবাগান এলাকায় পণ্য কিনতে আসা হাবিবুর রহমানে নামের এক ক্রেতা বলেন, ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন থাকে। চার-পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়েও অনেকে পণ্য কিনতে পারছেন না। ট্রাকের সংখ্যা ও পণ্যের পরিমাণ বাড়ালে আমাদের উপকার হতো।
টিসিবি জানিয়েছে, আসন্ন রমজান উপলক্ষে আগামী ২৮ মার্চ পর্যন্ত ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হবে। পাশাপাশি বিক্রি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডও বিতরণ চলছে। উপকারভোগীরা নিকটতম ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউএনও অফিস থেকে এসব কার্ড সংগ্রহ করতে পারবেন।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, আপাতত পণ্যের সংখ্যা বাড়বে না। ক্রেতার চাপ সামলাতে বড় ও বিভাগীয় শহরে ট্রাকের সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। এ বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে হিন্দু নেতাদের সাক্ষাৎ
আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা এ সময় প্রধান উপদেষ্টাকে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান।
আজ সোমবার বিকেলে হিন্দু নেতারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যান। এ সময় তাঁদের কাছে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি তাঁদের বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে সব সময় দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ হয় না। পূজা উপলক্ষে বছরে একবার সামনাসামনি দেখা হয়, কথা বলার সুযোগ হয়।’
হিন্দুধর্মীয় নেতারা জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর এক হাজারের বেশি পূজামণ্ডপ বেড়েছে। সারা দেশে পূজামণ্ডপ তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
নেতারা বলেন, ধর্ম উপদেষ্টা নিয়মিতভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, মন্দির পরিদর্শন করেন। দুর্গাপূজা উৎসবমুখর করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে। গতবারের মতো এবারও নির্বিঘ্নে পূজা উদ্যাপন হবে বলে তাঁরা আশা করছি।
এ সময় স্থায়ী দুর্গামন্দিরের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব। তিনি বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ জন্য আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রেখেছেন। গত বছরের মতো এ বছরও পূজায় আমরা দুই দিন ছুটি পেয়েছি। এ জন্যও আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। গত বছর ৮ আগস্ট দেশে ফেরার পরপরই আপনি ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করে বলেছিলেন, আমরা সবাই এক পরিবার। আপনার বক্তব্য আমাদের মনে গভীরভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, ‘গত বছর দুর্গাপূজায় ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে আপনি বলেছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে কড়া পাহারা বসিয়ে পূজা হবে এমন দেশ আমরা চাই না। আমরা প্রথমবারের মতো কোনো সরকারপ্রধানের কাছে এমন বক্তব্য শুনেছি। আমরাও আপনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত, আমরাও চাই এ আয়োজনে সবাই সহযোগিতা করুক, দেশের সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক।’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব এস এন তরুণ দে বলেন, ‘আপনি দায়িত্বে থাকাকালীন দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছেন। আমরা লক্ষ করেছি, এক বছর ধরে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর মিথ্যা কথা, ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। আপনার নেতৃত্বে ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণ হবে, আমরা সেটাই কামনা করি।’
বৈঠকে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘ধর্ম মন্ত্রণালয় সব ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে আমরা কল্যাণকর কর্মসূচিগুলো নিশ্চিত করি।’ এ সময় তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও পূজার অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান এবং দুর্গাপূজা ঘিরে যাতে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের সুযোগ তৈরি না হয়, সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার ও সচিব দেবেন্দ্র নাথ উঁরাও, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণানন্দ (একক), বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজসংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, শ্রীশ্রী গীতা হরি সংঘ দেব মন্দিরের সভাপতি বিমান বিহারী তালুকদার, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন ফ্রন্টের আহ্বায়ক অপর্ণা রায় দাস, শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত ও সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণীতা সরকার উপস্থিত ছিলেন।