‘জেনোসাইড’, না মানবতাবিরোধী অপরাধ?
Published: 17th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে একটি স্বাধীন তথ্যানুসন্ধান মিশন পরিচালনা করে। এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১২ ফেব্রুয়ারি। বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধের বিবরণ তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
ওএইচসিএইচআর মনে করে, বিক্ষোভ ও ভিন্নমত দমনের কৌশল হিসেবে বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর সেগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অবগতিতে, সমন্বয়ে ও নির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছে।
তারা এ–ও মনে করে, হত্যা, নির্যাতন, কারাবরণ ও অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যুক্তিসংগত ভিত্তি রয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নির্যাতন (স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে) কোন মাত্রায় সংঘটিত হয়েছে, তা মূল্যায়নের জন্য অতিরিক্ত ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা অভিমত দেয়।
যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ীই তা করতে হবে। প্রায় এক মাসের এই হত্যাযজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বললেই সেটা বেশি যুক্তিযুক্ত হবেঅভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে হত্যা, নির্যাতন, কারাবরণ ও অন্য অমানবিক অপরাধগুলোকে ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করার একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
এর কারণ হয়তো মানসিক আঘাত-উত্তর চাপ কিংবা নৃশংস অপরাধকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে এনে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু তা করতে গিয়ে ‘জেনোসাইড’–এর বাংলা অনুবাদ ‘গণহত্যা’ করলে আইনগতভাবে শব্দটি ভুল হবে! আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, শব্দ বা শব্দমালার ব্যবহার যথাযথভাবে অর্থপূর্ণ করতে না পারলে এ ধরনের মামলায় ন্যায্যতা নিশ্চিত করা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়!
আইনবিদ রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে গ্রিক শব্দ ‘জেনোস’ (জাতি বা গোত্র) এবং লাতিন শব্দ ‘সাইড’ (হত্যা)-কে একত্র করে ‘জেনোসাইড’ শব্দটির প্রচলন ঘটান। ‘জেনোসাইড’ বলতে তিনি ‘জাতিগত নিধনকে’ বুঝিয়েছেন। অথচ জেনোসাইডকে বাংলায় ‘গণহত্যা’ অনুবাদ করার কারণে একে ‘ম্যাস কিলিং’ থেকে আলাদা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
জেনোসাইডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে ভুল আভিধানিক অর্থে আমরা বহু বছর ধরে ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনি ভাষায় ‘গণহত্যা’ শব্দটি ‘ম্যাস কিলিং’-কে নির্দেশ করে, ‘জেনোসাইড’–কে নয়! আর আন্তর্জাতিক আইনে এই ‘ম্যাস কিলিং’ অপরাধটিকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
‘জেনোসাইড’–এর সংজ্ঞা আর ব্যাখ্যা বোঝাতে দুটি আইনি দলিল বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। তার মধ্যে একটি হলো ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন এবং অধ্যাপক গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টনের ‘টেন স্টেজেস অব জেনোসাইড’ নামে প্রকাশিত লেখাটি।
জেনোসাইড কনভেনশন (ধারা ২) অনুযায়ী, যখন এই আইনের আওতায় সুরক্ষিত কোনো জনগোষ্ঠীকে (ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতীয়তার ভিত্তিতে স্বীকৃত) সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে (ইনটেনশন) কনভেনশনের দলিলে বর্ণিত পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের কোনো একটিও যদি সংঘটিত হয়, তাকে ‘জেনোসাইডাল’ অপরাধ বলা যাবে।
উল্লেখ্য, এখানে মূল বিষয়টি হলো ‘কোনো একটি সুরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন’ করার উদ্দেশ্য প্রমাণ করা। এই বিশেষ উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় নিয়ে এমনকি একজন মানুষকেও যদি হত্যা করা হয়, সেটা জেনোসাইডাল অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর এই বিশেষ উদ্দেশ্যকে অকাট্যভাবে চিহ্নিত করতে না পারলে আইনি লড়াইয়ে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে প্রমাণ করা যাবে না।
কোনো একটি জনগোষ্ঠীকে আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন বলতে কী বোঝায়? ধরা যাক, ১৯৭১ সালের জেনোসাইড। তখন আমরা সুরক্ষিত ভিন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা ছিলাম ‘ভাষাগত’ পরিচয় বা ‘জাতীয়তা’র ভিত্তিতে। আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হলো। আর যদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুধু নারীদের অথবা সনাতন ধর্মের মানুষদের হত্যা করে বা চেষ্টা চালায়, তখন তা হবে আংশিক রূপে।
অধ্যাপক স্ট্যান্টন বলেছেন, জেনোসাইড মূলত হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। তা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। যেমন প্রথম পর্যায় বা ধাপটি হচ্ছে ‘আমি বনাম তুমি’-তে ভাগ করে মানুষে মানুষে ‘শ্রেণিবিভাগ’ করা। যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ‘খাঁটি মুসলিম’ নেই। এ রকমভাবে আমাদের বিমানবীকরণ (ডিহিউম্যানাইজেশন) করা হয়েছিল জাতিগত নিধনের অভিপ্রায়ে। এভাবে বৈষম্যসহ আরও অনেক ধাপ পার হয়ে শেষ ধাপটি হলো ‘ডিনায়াল’ বা অপরাধকে ‘অস্বীকার’ করা।
অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে ম্যাস কিলিং ছাড়াও আরও কিছু অপরাধের তালিকা দেওয়া আছে। যেমন রাজনৈতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘ব্যাপক’ বা ‘পদ্ধতিগত’ আক্রমণের অংশ হিসেবে করা কোনো অমানবিক কাজ।
এ সংজ্ঞা ২০০২ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সংবিধির সংশ্লিষ্ট ধারার সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। তাই আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত কিছু মামলার রায়ে ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ বলতে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, তা আমাদের জানা প্রয়োজন। যুগোস্লাভিয়ার এমনই একটি মামলায় বলা হয়েছে যে আক্রমণের ব্যাপকতা বলতে আক্রমণটির ধরন ও যাদের আক্রমণ করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা ‘বড় আকারের’ হতে হবে। অন্যদিকে ‘পদ্ধতিগত’ মানে যা অপরিকল্পিতভাবে সংঘটন করা অসম্ভব।
সবকিছু বিবেচনায় বলা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে শুধু ‘ব্যাপক’ এবং–অথবা ‘পদ্ধতিগত’ শর্তটি যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনের অধীন এ অপরাধের বিচার সহজেই করা সম্ভব। আইনগত জায়গা থেকে ‘ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি’র চেয়ে জেনোসাইডের মতো অপরাধ প্রমাণ করা দুরূহ। কারণ, সেখানে ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ অকাট্যভাবে চিহ্নিত করতে হয়।
যদি বিচারপ্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করা হয়, তবে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডে সেটিকে জেনোসাইড প্রমাণ করা দুরূহ হতে পারে। উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, জেনোসাইডের অভিযোগে অভিযুক্ত করে নয়।
মোটকথা, পতিত সরকারের নৃশংস অপরাধকে শুধু ‘জেনোসাইড’ হিসেবে আখ্যায়িত না করলে এর গভীরতা বোঝা যাবে না, এমন নয়। যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ীই তা করতে হবে। প্রায় এক মাসের এই হত্যাযজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বললেই সেটা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে।
● মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
● উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম নবত ব র ধ ন শ চ ত কর জনগ ষ ঠ ক অপর ধ র গণহত য পর চ ল আইন র ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতম বর্বরতা থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
আজ বুধবার ফিলিস্তিন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ইসরায়েল এ পর্যন্ত ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী সকলকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান।
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠনই বলছে, ‘গাজায় গণহত্যা চলছে’
ফিলিস্তিন সংকট সমাধান: সবার দৃষ্টি জাতিসংঘের বিশ্ব সম্মেলনে
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থন পুর্নব্যক্ত করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি স্থাপনের একমাত্র পথ হিসেবে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
গাজা পুনর্গঠনে আরব পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের নেতৃত্বে গাজা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে প্রস্তত রয়েছে। তিনি গাজায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম বাধা দেয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা সর্বাত্বকভাবে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান।
২০২৩ সালের অক্টোবরের পর হতে গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ এবং একটি স্থায়ী সমাধানের পথ সুগম করতে জাতিসংঘের সদস্যদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করার জন্য ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী ‘জাতিসংঘ হাইলেভেল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ফর দ্য পিসফুল সেটেলমেন্ট অব দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন অ্যান্ড দ্য ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য টু-স্টেট সল্যুশন’ শীর্ষক মন্ত্রী পর্যায়ের এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
এতে বাংলাদেশসহ ১১৮টি দেশের প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছে।
ঢাকা/হাসান/ফিরোজ