‘আম্মা আমারে মাফ করছোনি আর আধা ঘণ্টা বাঁচুম’
Published: 22nd, February 2025 GMT
পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে পৈতৃক ঘরবাড়ি বিক্রি করে ইতালি যেতে ১৫ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার রাসেল মিয়া। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে দেশও ছাড়েন। দালালরা তাঁকে নিয়ে যায় লিবিয়া। কিন্তু সেখানে গিয়েই স্থানীয় মানব পাচার চক্রের হাতে বন্দি হন রাসেল। জিম্মি করে মুক্তিপণের জন্য রাসেলের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। ফলে দেশ থেকে দুই দফায় চক্রটির কাছে আরও অন্তত ৩০ লাখ টাকা পাঠায় রাসেলের পরিবার। কিন্তু আরও ১০ লাখ টাকার দাবিতে রাসেলের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছিল চক্রটি। কিন্তু সেই টাকা দিতে না পারায় ২১ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ায় দালালরা বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে রাসেলকে হত্যা করে। গতকাল শনিবার এক প্রবাসীর মাধ্যমে রাসেলের মৃত্যুর খবর জানতে পারে পরিবার।
রাসেল নাসিরনগর উপজেলার ধরমণ্ডল ইউনিয়নের ধরমণ্ডল গ্রামের লাউস মিয়ার ছেলে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাসেল সবার বড়।
ধরমণ্ডল গ্রামের স্থানীয়রা জানান, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ইতালি পাড়ি জমাতে রাসেল পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা তুলে দেন একই গ্রামের দালাল লিলু মিয়ার হাতে। কথা ছিল, লিবিয়া থেকে রাসেলকে ইতালি পাঠানো হবে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে পৌঁছে তাঁর কপালে জোটে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। লিবিয়া নিয়ে লিলু মিয়ার লোকজন ১০ লাখ টাকায় দেশটির মানব পাচার চক্রের কাছে রাসেলকে বিক্রি করে দেয়। এর পরই শুরু হয় দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। মানব পাচার চক্র রাসেলকে নির্যাতন করে একাধিকবার ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ৩০ লাখ টাকা। সর্বশেষ গত সপ্তাহে আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে চক্রটি। পরিবারের দাবি, টাকা না দেওয়ায় গত শুক্রবার বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে রাসেলকে হত্যা করা হয়।
গতকাল ধরমণ্ডল গ্রামে রাসেলের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম। কাঁদতে কাঁদতে রাসেলের মা আউলিয়া বেগম বলেন, ‘আমার পুতরে তোমরা আইন্যা দেও। কই যাইলে আমার পুতের খোঁজ পামু। আমার পুত আমারে ফোন দিয়া কইছে, আম্মা আমারে মাফ করছোনি? আম্মা আমি আর আধা ঘণ্টা বাঁচুম। আমারে শরীরে কিতা য্যান দিছে গো। আমি মইরা যাইতেছি।’ এভাবে ফোনের অপর পাশ থেকে হঠাৎ কথা আসা বন্ধ হয়ে যায়। ছেলের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে দিতে একসময় জ্ঞান হারান আউলিয়া বেগম।
নিহতের বোন ফাহিমা বেগম বলেন, আমার ভাই আমাকে সব সময় ফোন করত। কিছুদিন পরপর দালালরা ভিডিও কলে ভাইকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেখাত আর টাকা চাইত। ভাইকে বাঁচানোর জন্য আমরা সব চেষ্টা করেছি। কিন্তু দালাল আমার ভাইকে বাঁচতে দেয়নি। টাকা নেওয়ার পরও কেন আমার ভাইকে ওরা হত্যা করল? আমি আমার ভাইয়ের হত্যায় জড়িত মানব পাচারকারী লিলু মিয়ার ফাঁসি চাই।
রাসেলের বাবা আউয়াল মিয়া বলেন, ‘আমার শেষ সম্বল বসতভিটা ও ফসলি জমি বিক্রি কইরা ৫০ লাখ টাকা দিছি। দালালরা আরও টাকা চায়। কিন্তু দিতে না পারায় রাসেলরে হত্যা করছে দালাল লিলু মিয়া ও মাফিয়া চক্র।’
এদিকে রাসেলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই গতকাল ধরমণ্ডল গ্রামে দালাল লিলু মিয়ার বাড়িতে হামলা করেন ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। এ সময় বিক্ষুব্ধরা লিলু মিয়ার বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। তবে বাড়িতে সে সময় লিলু মিয়ার স্বজন কেউ ছিলেন না। বাড়িটি থেকে লিবিয়ায় পাঠানোর জন্য আরও দেড় শতাধিক মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ও ছবি পাওয়া যায়।
রাসেলের মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলতে দালাল লিলু মিয়ার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। লিলু মিয়ার ব্যবহৃত ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
লিবিয়াফেরত ধরমণ্ডল গ্রামের ভুক্তভোগী মাসুক মিয়া ও মমিন মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকজন মানব পাচারকারী আছে। এর মধ্যে লিলু মিয়া, শামীম ও শাফি আলম অন্যতম। ওরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ২০০ লোককে একসঙ্গে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে একটি মরুভূমিতে আটকে রাখে। আমাদের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা নিয়ে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। আমরা চোখের সামনে মানুষকে টাকার জন্য পিটিয়ে হত্যার করতে দেখেছি। আমরা কীভাবে বেঁচে ফিরেছি, আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
ধরমণ্ডল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম মানব পাচারে জড়িত লিলু মিয়াসহ অন্যদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
নাসিরনগর থানা ওসি খায়রুল আলম বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইউএনও শাহীনা নাসরিন বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। যারা মানব পাচারে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র র আম র ভ ই র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
নুরাল পাগলার দরবার থেকে চুরি হওয়া জেনারেটর উদ্ধার, যুবক গ্রেপ্তার
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার দরবার থেকে চুরি হওয়া একটি জেনারেটর উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ সময় মো. মিজানুর রহমান (২৪) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে মিজানুরকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও গোয়ালন্দ ঘাট থানা-পুলিশ। মিজানুরের বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার লক্ষ্মীকোল সোনাকান্দর গ্রামে।
আরও পড়ুননিহতের বাবার মামলায় গ্রেপ্তার আরও ২, দেড় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির দাবি১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫এ নিয়ে দুই মামলায় মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. শরীফ আল রাজীব।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ৫ সেপ্টেম্বর গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার দরবারে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ সময় মিজানুর রহমান জেনারেটর চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন—এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মিজানুরকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। মিজানুরকে দরবারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, লাশ পোড়ানো ও হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁকে রাজবাড়ীর আদালতে সোপর্দ করার প্রস্তুতি চলছে।
আরও পড়ুননুরাল পাগলার দরবারে হামলায় হত্যা মামলা, মসজিদের ইমামসহ চারজন গ্রেপ্তার০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ওই দিন পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে প্রায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে ৬ সেপ্টেম্বর মামলা করেন। এই মামলায় মোট ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে দরবারে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা ও কবর থেকে লাশ তুলে মহাসড়কে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় নিহত ভক্ত রাসেল মোল্লার বাবা আজাদ মোল্লা বাদী হয়ে ৮ সেপ্টেম্বর মামলা করেন। ওই মামলায় সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত মিজানুরসহ নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।