ঘরের সঙ্গে আয়ের উৎসও হারিয়েছে ৩৬ পরিবার
Published: 27th, February 2025 GMT
রাঙামাটির সাজেকের রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রে ভয়াবহ আগুনে রিসোর্ট-কটেজ, রেস্তোরাঁ, দোকানঘরের সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়েছে স্থানীয় ত্রিপুরা ও লুসাই জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অনেক বসতঘরও। এসব পরিবারের বেশির ভাগের আয়ের উৎস ছিল রিসোর্ট ও হোটেল মালিকদের কাছে জমি লিজ দিয়ে পাওয়া ভাড়ার টাকা।
কেউ কাজ করতেন হোটেল-রিসোর্টগুলোয়। ফলে আগুনের ভয়াবহতা শুধু হোটেল-রিসোর্ট মালিকদেরই নিঃস্ব করেনি, অবর্ণনীয় দুরবস্থায় ফেলেছে স্থানীয়দেরও। ঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিনযাপন করতে হচ্ছে তাদের অনেককে।
গত সোমবার দুপুরে রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রে আগুন লাগে। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পুড়ে ছাই হয় ৯৭টি কটেজ-রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, দোকানঘর ও বসতঘর। এর মধ্যে ৩৬টি বসতঘর ত্রিপুরা ও লুসাই সম্প্রদায়ের মানুষের। তা ছাড়া ৩৪টি কটেজ ও রিসোর্ট, ২০টি দোকানঘর ও ৭টি রেস্তোরাঁ পুড়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক শতকোটি টাকার বেশি।
গতকাল বুধবার রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রে সরেজমিনে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া হোটেল-রিসোর্ট ও বসতঘরগুলোর ধ্বংসস্তূপ এখনও আগুনের ভয়াবহতার সাক্ষী দিচ্ছে। ঘর হারিয়ে স্থানীয় অনেকের আশ্রয় হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কেউ পোড়া টিন দিয়ে কোনো রকমে ঝুপড়ি তুলে মাথা গোজার ঠাঁই বানিয়েছেন।
এমনই একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ওয়াইতুই রাম ত্রিপুরা। পোড়াভিটায় ক্ষতিগ্রস্ত টিন জড়ো করে কোনোমতে তৈরি করা ঝুপড়িতে বসে ছিলেন তাঁর বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। ওয়াইতুই জানান, ঘরের পাশের জমি তরুছায়া নামে একটি রিসোর্টকে লিজ দিয়েছিলেন। সেই ভাড়ার টাকায় চলত তাঁর সংসার। আগুনে ওই রিসোর্টসহ তাঁর ঘরও পুড়েছে। তিনি এখন নিঃস্ব। মা, স্ত্রী, দুই সন্তান, বোন ও তাঁর দুটি সন্তান নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
ওয়াইতুইয়ের স্ত্রী ভারতী ত্রিপুরা জানান, আগুনের সময় তাঁর এক সন্তান ঘরের বাইরে ছিল। তাঁকে খুঁজে আনার সময় আগুন ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে বৃদ্ধ শাশুড়িকে ঘর থেকে বের করে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। আগুন থেকে ঘরের কিছুই রক্ষা করতে পারেননি।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত সাংপুই লুসাই জানান, আগুনের ঘর পুড়ে যাওয়ার পর গির্জায় আশ্রয় নিয়েছেন। পাশের কংলাক ও খগেনপাড়ার লোকজন যে খাবার পাঠাচ্ছেন তা দিয়ে কোনোরকমে দিন পার করছেন। রোয়াত্তি লুসাই নামে ক্ষতিগ্রস্ত আরেকজন জানান, আগুনে বসতঘর, রিসোর্ট ও চায়ের দোকান হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। কী করে ঘুরে দাঁড়াবেন বুঝে আসছে না।
এদিকে সাজেকের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। গতকাল দুপুরের দিকে তিনি সাজেক পৌঁছান। পরে ক্ষতিগ্রস্ত রিসোর্ট-কটেজ মালিক, কর্মচারী ও ঘর হারানো স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় ক্ষতিগ্রস্তরা উপদেষ্টার কাছে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। উপদেষ্টা এ সময় বসতবাড়ি হারানো প্রতিটি পরিবারকে দুই টন করে চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের জেলা পরিষদ থেকে খাদ্যশস্য ও জেলা প্রশাসন থেকে ঢেউটিন দেওয়ার কথা জানান।
পরে সাংবাদিকদের উপদেষ্টা বলেন, সাজেকে অতিদ্রুত একটি বিশেষায়িত ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অনুরোধ করবেন। ক্ষতিগ্রস্ত কটেজ ও রিসোর্ট মালিকদের করপোরেট ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে কথা বলবেন অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে। এ ছাড়া সাজেকে পানি সংকট নিরসনে জলাধার স্থাপন ও ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘর পরিবারকে যতটুক সম্ভব পুনর্বাসনের কথা জানান।
এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান সুদত্ত বিকাশ চাকমা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে দুপুরে জেলা প্রশাসনের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরে কমিটির প্রধান রাঙামাটির স্থানীয় সরকার প্রকৌশলের প্রধান প্রকৌশলী মোবারক হোসেন জানান, ইকো ভ্যালি নামের রিসোর্ট থেকে আগুন ধরেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্যুতের শর্টসার্কিট, সিগারেট অথবা দাহ্য পদার্থ থেকে আগুন লেগেছে। বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
ক্ষতিগ্রস্ত ৩৬ পরিবারকে সহায়তা আগুনের ঘটনার দুই দিন পর ক্ষতিগ্রস্ত ৩৬ পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল, সাড়ে ৭ হাজার টাকা, শুকনো খাবার ও কম্বল দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরিন আক্তার গতকাল এ ত্রাণ বিতরণ করেন।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
লাখ লাখ মানুষের সমাগমে চাঙা সিলেটের পর্যটন ব্যবসা
সিলেটে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় বর্ষা মৌসুম। কিন্তু এবার পঞ্জিকার হিসাবে বর্ষা ঋতু শুরু হওয়ার আগেই দফায় দফায় বৃষ্টি নামায় বর্ষার আমেজ এসে গেছে। নদ-নদী, হাওর-খাল–বিল সব জায়গা নতুন পানিতে ভরেছে। টইটম্বুর পানিতে পর্যটনকেন্দ্রগুলো মোহনীয় রূপ পেয়েছে। এ রকম অবস্থায় ঈদের লম্বা ছুটি মিলেছে। তাই বেড়ানোর মওকা পেয়ে অনেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্যটন গন্তব্য সিলেটে ছুটে এসেছেন।
স্থানীয় প্রশাসন ও পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষার আমেজে সিলেটের পর্যটন ব্যবসা এবার চাঙা হয়ে উঠেছে। গত দেড় সপ্তাহে অন্তত সাড়ে ৮ লাখ পর্যটক এসেছেন এই জনপদে। হোটেল-রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ ও পরিবহন খাতের পাশাপাশি চা-পাতা, মণিপুরি কাপড়, সাতকরা ও আচার কেনাবেচাসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। এতে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তাঁরা ধারণা করছেন।
জানতে চাইলে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ফয়েজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে ঈদের ছুটি কিংবা পর্যটন মৌসুমের শুরুতে এবারই সবচেয়ে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। সিলেটের সব কটি পর্যটনকেন্দ্রেই উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যও জমেছে। মৌসুমের শুরুতেই এমন রমরমা অবস্থায় খুশিতে আছেন এখানকার পর্যটন খাত–সংশ্লিষ্ট সবাই।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় শতাধিক পর্যটনকেন্দ্র আছে। আর ভ্রমণ পর্যটনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শতাধিক দৃষ্টিনন্দন রিসোর্ট। পর্যটনকেন্দ্র ছাড়াও সিলেট নগরে অবস্থিত হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার এবং সিলেটের গোলাপগঞ্জের শ্রীশ্রী চৈতন্য দেবের পৈতৃক ভিটায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ সিলেটে আসেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেন্দ্রিক ট্যুরিজমের পাশাপাশি ধর্মীয় ট্যুরিজম বিবেচনায় পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ট্যুরের জন্য অনেকেরই এখন পছন্দের জায়গা সিলেট। সাধারণত সিলেটের চার জেলায় বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ পর্যটক আসেন। এর মধ্যে সিলেটে আসেন ১২ থেকে ১৩ লাখ। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে প্রায় ৫ লাখ করে ১০ লাখ এবং হবিগঞ্জে প্রায় ২ লাখ পর্যটক আসেন। তবে এবার মৌসুমের শুরুতেই চার জেলায় পর্যটকের ঢল নেমেছে।
গত কয়েক বছরের মধ্যে ঈদের ছুটি কিংবা পর্যটন মৌসুমের শুরুতে এবারই সিলেটে সবচেয়ে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। সব কটি পর্যটনকেন্দ্রেই উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যও জমেছেফয়েজ হাসান, সভাপতি, সিলেট চেম্বারসিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিলেটে এবারের ঈদের ছুটিতে কমপক্ষে ৫ লাখ পর্যটক এসেছেন। এতে পর্যটন খাতে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যবসা হয়েছে। যেহেতু পর্যটন মৌসুম কেবল শুরু হয়েছে, সেহেতু চলতি বছর বিপুল পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে আশা করছি।’
সিলেট ছাড়া অন্য তিন জেলায় ঈদের ছুটিতে কী পরিমাণ পর্যটক এসেছেন কিংবা কেমন ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই মৌসুমের শুরুতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন। এর মধ্যে সিলেটে ৫ লাখ, মৌলভীবাজারে ২ লাখ এবং সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় দেড় লাখ পর্যটক এসেছেন। চার জেলায় পর্যটন খাতে কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।
ষড়্ঋতুর দেশ বাংলাদেশে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসকে বর্ষাকাল বলা হয়। পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ শনিবার পয়লা আষাঢ়। অর্থাৎ কাগজে–কলমে আজ থেকে শুরু হচ্ছে এ বছরের বর্ষাকাল।
এবারের ঈদের ছুটিতে সিলেটের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড় হয়েছে। এসব জায়গায় জল-পাথর আর পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন দেশের নানা এলাকা থেকে আসা পর্যটকেরা। সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে