ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল চেয়েছেন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) নেতারা। তাঁরা বলেন, বর্তমানে দেশে ব্যক্তিগত ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হলে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে ক্রেডিট কার্ডের জন্য রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা আছে। অথচ ক্রেডিট কার্ডও একধরনের ঋণ। এ জন্য ঋণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের নীতিটি পরস্পরবিরোধী।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যালয়ে আজ বুধবার এক প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় কর–সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অ্যামচেমের নেতারা। বিভিন্ন ব্যবসায়ী চেম্বার, পেশাজীবী সংগঠন ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য কর প্রস্তাব তৈরির অংশ হিসেবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে এনবিআর।

অ্যামচেমের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। তিনি বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা তুলে দিলে কার্ডের ব্যবহার বাড়বে এবং আর্থিক লেনদেনের শনাক্তকরণ উপায় জোরদার হবে, যা প্রকারান্তরে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।’

বাজেট প্রস্তাবে আর্থিক ও বিমা খাতের করপোরেট কর ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে অ্যামচেম। পাশাপাশি এ খাতের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ফান্ডের ওপরে করপোরেট কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া লজিস্টিক ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের করপোরেট কর কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।

অ্যামচেম আরও জানায়, বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং পরিষেবার ওপর অনশোর ব্যাংকিং পরিষেবার মতোই ৪০ শতাংশ কর আরোপ করা আছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের (ওবিইউ) ওপর শূন্য থেকে ২০ শতাংশ হারে কর আরোপ রয়েছে।

এ বিষয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, ওবিইউ মূলত রপ্তানিকারকদের সহায়তা করে এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ওবিইউর জন্য কম করহার প্রবর্তন করা হলে স্থানীয় ব্যাংকগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক শর্তে ঋণ প্রদান করতে পারবে এবং রপ্তানিকারকেরা উপকৃত হবেন।

অ্যামচেম আরও জানায়, বাংলাদেশে এখনো নগদ লেনদেনই প্রধান এবং ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভ্যাট বা কর আরোপ করা হয়। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশ এখনো ডিজিটাল পেমেন্ট উৎসাহিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমন বাস্তবতায় ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেছে অ্যামচেম। এর (প্রণোদনা) মধ্যে ৩ শতাংশ ব্যবহারকারীদের জন্য এবং ২ শতাংশ ব্যবসায়ীদের জন্য থাকবে।

সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, ডিজিটাল পেমেন্ট উৎসাহিত করলে লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়বে, কর ফাঁকি কমবে এবং আর্থিক খাত আরও নিয়ন্ত্রিত হবে।

ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন ফিলিপ মরিস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রেজা–উর–রহমান মাহমুদ, অ্যামচেমের নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কায়সার মোহাম্মদ রিয়াদ প্রমুখ। বৈঠকে আরও বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও তাঁদের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রেখেছে।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আমদানি পণ্যের মূল্যায়ন তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা এবং উৎস দেশ অনুযায়ী কাস্টমস মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ভ্যাট বা মূসকের একক হার ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। সংগঠনটি বলছে, এটা করা গেলে রাজস্ব আয় বাড়বে।

বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, সব উৎসে করের জন্য একটি রিফান্ড ব্যবস্থা আয়কর আইনের পৃথক ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। তিনি রিসাইক্লিং শিল্পকে কর অবকাশ প্রদান এবং বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ উৎসে কর অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন।

সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘আমরা কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বের হব। যারা কর অব্যাহতি পায়, তাদের অব্যাহতি ধীরে ধীরে কমিয়ে দিব। আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়ার প্রতিফলন থাকবে।’

করজাল বাড়াতে এনবিআর কাজ করছে জানিয়ে আবদুর রহমান খান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসা করতে পারেন, সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি করনীতি নেওয়া হচ্ছে।

বৈঠকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা তাঁদের মতামত প্রদান করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র স প র শ কর দ র জন য ম হ ম মদ ব যবস য়

এছাড়াও পড়ুন:

‘আমরা ভুগছি আর রাজনীতিবিদেরা ধনী হচ্ছেন, তাই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার ফেলে দিয়েছি’

নেপালে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে জেন–জিদের বিক্ষোভে সরকারের পতন ঘটেছে। তবে এ জয় এসেছে চড়া মূল্যে।

বিক্ষোভের সংগঠকদের একজন তনুজা পান্ডে। তিনি বলেন, ‘আমরা গর্বিত হলেও এর সঙ্গে মানসিক আঘাত, অনুশোচনা ও ক্ষোভের মিশ্র বোঝাও যোগ হয়েছে।’

হিমালয়ের দেশ নেপালে গত সপ্তাহের বিক্ষোভে ৭২ জন নিহত হয়েছেন। এটিকে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অস্থিরতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বিক্ষোভে সরকারি ভবন, রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবন ও গত বছরের জুলাইয়ে চালু হওয়া হিলটনের মতো বিলাসবহুল হোটেলে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী এখনো জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাঁদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সংকটবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আশীষ প্রধান বলেন, ‘এই বিক্ষোভ দশকের পর দশক ধরে নেপালের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের বিরুদ্ধে বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত বহন করে।’

তবে আশীষ আরও উল্লেখ করেন, বিক্ষোভের কারণে সরকারি সেবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের সমান্তরাল হতে পারে। ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

শুধু রাজধানী কাঠমান্ডুতে এ ধ্বংসযজ্ঞ সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিক্ষোভে সারা দেশে কমপক্ষে ৩০০টি স্থানীয় সরকারি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই বিক্ষোভ দশকের পর দশক ধরে নেপালের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের বিরুদ্ধে বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত বহন করে।আশীষ প্রধান, জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ

কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিক্ষোভের কারণে প্রায় তিন লাখ কোটি নেপালি রুপির (২ হাজার ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার) ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় অর্ধেক। এ সময় নেপালের বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

৮ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ বিক্ষোভ শুরুর দুই দিন আগে ২৪ বছর বয়সী পরিবেশকর্মী তনুজা পান্ডে একটি ভিডিও আপলোড করেন। ভিডিওতে তিনি অঞ্চলটির অন্যতম সংবেদনশীল পর্বতশ্রেণি চুরেতে একটি খনি দেখান। তিনি লিখেছিলেন, ‘নেপালের সম্পদের মালিকানা শুধু জনগণের। রাজনীতিবিদদের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নয়।’ এ সময় সমবয়সীদের প্রতি ‘দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে’ বিক্ষোভের আহ্বান জানান তিনি।

এশিয়ায় তরুণদের অন্যান্য আন্দোলনের মতো নেপালের জেন–জিদের বিক্ষোভও ছিল নেতৃত্বহীন। দীর্ঘদিন ধরে ‘নেপো বেবিজ’দের (ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদদের সন্তানদের) বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধ সম্পদের আড়ম্বরপূর্ণ প্রদর্শনীর অভিযোগ আনা হয়।

সবচেয়ে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর মধ্যে একটিতে প্রাদেশিক মন্ত্রীর ছেলে সৌগত থাপাকে দেখা গেছে। ছবিতে তাঁকে লুই ভুতোঁ, গুচি, কার্টিয়ারসহ বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের বাক্স দিয়ে তৈরি একটি ক্রিসমাস ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এর জবাবে সৌগত দাবি করেন, ছবিটি নিয়ে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ দেওয়া হচ্ছে। তাঁর বাবা ‘জনসেবা থেকে উপার্জিত প্রতিটি রুপি’ জনগণের কাছে ফেরত দিয়েছেন।

তনুজা পান্ডে বলেন, এটা দুঃখজনক যে শিক্ষিত তরুণেরাও দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, এখানে যে বেতন দেওয়া হয়, তা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় অনেক কম।

নেপালের গণতন্ত্র খুব একটা পুরোনো নয়। মাওবাদীদের নেতৃত্বে এক দশকের গৃহযুদ্ধের পর ২০০৮ সালে নেপাল একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। সেই সময় ১৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু এরপরেও প্রতিশ্রুত স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি আসেনি। ১৭ বছরে নেপালে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে এবং কোনো নেতাই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।

নেপালের কাঠমান্ডুতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও কারফিউ চলাকালে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে মুঠোফোনে ছবি তুলছেন আন্দোলনকারীরা। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, নেপাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ