মহানবী (সা.) এবং এক ইহুদি ছেলের গল্প
Published: 6th, March 2025 GMT
সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন যারা, তাদের মধ্যে আনাস ইবনে মালিক (রা.) অন্যতম। তিনি নাজ্জার গোত্রের জুনদুব ইবন আমিরের বংশধর। এই জুনদুব হলেন নবীজির (সা.) দাদা আবদুল মুত্তালিবের মা সালামার ভাই। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন মদিনায় নবীজির (সা.) আপনজন। তার বয়স যখন দশ, তখন তার মা উম্মু সুলাইম তাকে নবীজির ঘরের কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে রেখে যান। তিনি নবীজি (সা.
এই সময় নবীজির (সা.)ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে একটি ইহুদি ছেলেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। মদিনার অধিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি তখন ইহুদি। ছেলেটিও ছিল সাধারণ ইহুদি পরিবারের একজন। জীবিকার তাগিদে সে একটি কাজ খুঁজছিল, যা মাধ্যমে পরিবারকে সাহায্য করা যায়। সে মদিনার বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করছিল। ছোটখাটো কাজ, ফুটফরমাশ খাটা বলতে যা বোঝায়। অল্প আয়ের সন্তুষ্ট থাকত সে। (ইসলাম ওয়েব, শামায়িলু রসুলিল্লাহ, ১,৫৪,৪৫৭)
আরও পড়ুনতওবা যেভাবে করা যায়১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫শেষে ছেলেটি মহানবী (সা.)-র বাড়িতে কাজ করার সুযোগ পায়। আনাস (রা.) বলেন, সে নবীজির (সা.) জুতা ঠিক করে দিত, অজুর পানি এগিয়ে দিত এবং অন্যান্য কাজ করত। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫৩১ ও ৭,৫৬৫)
এই হাদিসের আলোচনায় বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থ উমদাতুল কারিতে লেখা হয়েছে, ছেলেটির নাম ছিল আবদুল কুদ্দুস।
আবদুল কুদ্দুস এই বাড়িতে এসে এক মহৎ চরিত্রের দেখা পায়, যে অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয়নি। সে দেখে, বাড়ির প্রধান কখনো তার দাসকে প্রহার করেন না, বরং তার সঙ্গে সদাচরণ করেন। যেমন, আনাস (রা.) বলেছেন, তিনি ১০ বছর নবীজির সান্নিধ্যে ছিলেন, নবীজি (সা.) কখনো তাঁকে কোনো কাজে তিরস্কার করেননি। কখনো মারেননি। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তিনি কখনো আমাকে বিরক্ত হয়ে উফ্ বলেননি, কোনও কাজের জন্য কখনো বলেননি, কেন তুমি এটা করেছ? অথবা, কেন তুমি এটা করোনি?।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩০৯)
ইহুদি ছেলেটি দেখল, নবীজি (সা.) তাকে তা-ই খাওয়ান-পরান, যা তিনি নিজে খান ও পরেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ছেলেটি নবীজি(সা.)কে গভীরভাবে ভালোবাসতে শুরু করে।
আরও পড়ুনদাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে মহানবী (সা.) এর স্ত্রী০৭ জানুয়ারি ২০২৫দিনগুলো মধুর কেটে যাচ্ছিল তার। নবীজির (সা.) বাড়ির জীবনযাত্রার কথা সে তার বাবাকে গিয়ে বলত। বলত নবীজির(সা.) চরিত্র ও জীবনের কথা। তার বাবা অবাক হয়েছিলেন, তা নয়। কেননা ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা, যারা আল্লাহর কিতাবপ্রাপ্ত ছিলেন, কোরআন বলছে, ‘তারা নবীজি(সা.)কে চেনে এমনভাবে, যেভাবে তারা তাদের সন্তানদের চেনে।’ (সুরা আল-আনআম, আয়াত: ২০)
তবে তার বাবা খুশি ছিলেন সে বাড়িতে তার সন্তানের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে।
একবার নবীজি (সা.) তাকে দেখতে না পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানেন যে সে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছে। নবীজি (সা.) বললেন, ‘চলো, আমরা তাকে দেখতে যাই।’ তিনি সাহাবিদের নিয়ে দ্রুত তার বাড়িতে গেলেন। আশা করেছিলেন, সময়ের আগে পৌঁছতে পারবেন।
আনাস (রা.) বলেন, বাড়ির ভেতরে গিয়ে নবীজি (সা.) তার কাছে গিয়ে মাথার পাশে বসলেন। ছেলেটির বাবা তার বিপরীতে বসেছিলেন। নবীজি (সা.) তার প্রতি প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেন, এত অল্প বয়সে তাকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দেখে তাঁর হৃদয় ভারাক্রান্ত হলো। তিনি ছেলেটিকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তা করতে বললেন। মানে তার দীন—যা নিয়ে সে তার প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে। তিনি যেমন তার চাচা আবু তালিবের মৃত্যুশয্যায় শিয়রে বসে বলেছিলেন, ‘ইসলাম গ্রহণ করুন’, তেমনি এই ছেলেটিকেও বললেন, ‘ইসলাম গ্রহণ করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৬৫৭)
আরও পড়ুন নবীজি (সা.)-এর কান্না২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সে-ও তো ইসলামকে কাছ থেকে দেখেছে। কিন্তু পিতার কর্তৃত্বের প্রতিও সে ছিল শ্রদ্ধাশীল। মনস্থির করতে পারছিল না। তাই সে বাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল, তার অনুমতি কামনা করে। হতে পারে সে ইসলাম গ্রহণ করতে চেয়েছে আগেই, কিন্তু বাবার ভয়ে সাহস পায়নি। নবীজি (সা.) পুনরায় তাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। তিনি চান সে ইসলামে প্রবেশ করে বিজয়ীদের অন্তর্ভুক্ত হোক। দেখলেন, তার জীবন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বললেন, ‘সাক্ষ্য দাও, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি তাঁর রাসুল।’ বাবা বললেন, ‘আবুল কাসিমের কথা মানো, মুহাম্মদ যা বলছে তা বলো।’ নবীজি (সা.) কে আবুল কাসিম বলা হতো। এবার দ্বিধা না করে উচ্চারণ করল, ‘সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল।’
এর পর সে মারা গেল।
নবীজি (সা.) সন্তুষ্ট মনে বাইরে এলেন, আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাকে আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। তাকে আগুন থেকে রক্ষা করতে আমাকে ব্যবহার করেছেন।’ তারপর তিনি তার সাহাবিদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য তোমরা জানাজার নামাজ পড়ো।’ (সুনান আবু দাউদ, ৩,০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, ১২,৩৮১)
খ্যাতিমান হাদিসবেত্তা শুয়াইব আরনাউত লিখেছেন, এই হাদিসের বর্ণনাকারী একাধিক স্থানে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন ‘সহিহ বুখারি’ ছাড়াও ইমাম নাসায়ি তার ‘আল-কুবরা’ (হাদিস: ৮,৫৩৪) এবং সুলাইমান ইবনে হারব থেকে মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার ‘সহিহ’ হাদিস: ২,৯৬০) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। (তাখরিজ আল-মুসনাদ লিশুয়াইব, হাদিস: ১২,৭৯২)
আরও পড়ুননবীজি (সা.)-এর হাসি২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এই হাদিসের সনদে অন্যতম বর্ণনাকারী হলেন, সুলাইমান ইবনে হারব; যিনি ইমাম বুখারির শিক্ষক। এই হাদিস বর্ণনার পরিবেশ সম্পর্কে ইমাম আবু হাতেম রাজি বলেছেন, ‘আমি বাগদাদে সুলায়মান ইবনে হারবের আসরে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল।’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৩৩১)
ইহুদি বালক নবীজির (সা.) ব্যক্তিগত সহকারী বা সেবক ছিল মাত্র। উপরন্তু ভিন্নধর্মীও বটে। তদুপরি তার অসুস্থতায় খোঁজখবর নিতে নবীজি (সা.) নিজে তার ঘরে গেছেন। তাকে ইসলামের আহ্বান জানানোর দায়িত্ব পালনে তিনি সংকোচ করেননি। যেমন, আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা কিতাবপ্রাপ্ত এবং যারা নিরক্ষর, তাদের বলে দাও, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করেছ কি? যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯-২০)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এই হাদিসের ভিত্তিতে অভিমত দিয়েছেন, শিশুদের ইসলাম গ্রহণ বৈধ (মিরকাতুল মাফাতিহ, ২,৪১৯)। শাইখ আতিয়্যা সালিমের মতে, অসুস্থ অমুসলিমকে পরিদর্শন করা এবং তার কল্যাণ কামনা করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। এই শিক্ষা আমাদের মানবিকতা ও পরোপকারিতার মূল্যবোধ জাগ্রত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সাহায্য করে (শারহু বুলুগ আল-মারাম, ১১২/৫)। শাইখ উসামা সুলাইমান লিখেছেন, অমুসলিম শিশুদের ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া এবং ইসলামের আহ্বান জানানোর উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী অমুসলিমকে দেখতে যাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। (শারহু সহিহ বুখারি, ১৪/৩)
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-র হাঁটাচলার ধরন২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র এই হ দ স র আল ল হ কর ছ ন বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা
রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।
এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত
ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত
উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”
এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।
ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।
ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
ঢাকা/ফিরোজ