উদীয়মান ‘এশিয়ান টাইগার’ বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ যেমন সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতেও অনেক অবদান রাখছে। যেমন– যুক্তরাষ্ট্রে যে আটটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়তে যায়, বাংলাদেশ তার অন্যতম। প্রতিবছর পড়তে যাওয়া ১৪-১৫ হাজার শিক্ষার্থীর টিউশন ফি, জীবনযাত্রার ব্যয় থেকে যুক্তরাষ্ট্র মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অবকাঠামো উন্নয়নের ইট-বালুকণার সঙ্গেও বাংলাদেশিদের ঘাম-শ্রম জড়িয়ে আছে। বৃহৎ অর্থনীতিগুলোতে বড় অবদান রাখার পরও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সম্মানজনক জায়গা তৈরি না হওয়ার বড় কারণ গত ৫০ বছরে আমরা স্বতন্ত্র পরিচয়, স্বতন্ত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমরা রাষ্ট্র পেয়েছি, তবে ‘নেশন বিল্ডিং’ হয়নি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সেই সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে জাতীয় স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল, ধর্ম, বর্ণের লোক একত্র হয়েছে। 

বর্তমানে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ১০ কোটিই তরুণ, যাদের বয়স ৪০ বছরের নিচে। এই ১০ কোটি তরুণ আগামী দিনে রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই তরুণরা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয়ের ব্যাপারে একমত। ফলে আমরা যদি স্বতন্ত্র পরিচয় বিশ্বপরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারব।  
এদিকে কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও নতুন মেরূকরণ হচ্ছে। আগে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার ফোকাস ছিল– ‘ওয়ার অন টেরর’। সেখান থেকে সরে এসে তারা বর্তমানে ‘অ্যান্টি ইসলামোফোবিয়া ডে’ পালন করছে। ওয়ার অন টেররের রাজনীতি নতুন পর্যায়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলছে। আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকেও নতুন বন্ধু খুঁজতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে মুখে বলা হতো, ভারত আমাদের একমাত্র বন্ধুরাষ্ট্র। এর বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো রাষ্ট্রকে আমরা বন্ধু হিসেবে দেখাতে পারিনি; আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মানবসম্পদ রপ্তানিসহ নানা বিষয়ে অংশীদারিত্ব বাড়াতে পারেনি। শুধু ভারতনির্ভরতার কারণে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক কিছুই একপক্ষীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো। 
বাংলাদেশে যেমন সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, তেমনি প্রতিবেশী মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর পতনও প্রায় হয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় সরকারের পতন হয়েছে; নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তানে নতুন সরকার এসেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সব রাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে এ অঞ্চলে নতুন একটি সমীকরণ দাঁড়িয়েছে। এখানে বাংলাদেশ কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটা নির্ধারণ করবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কতটা জনগণকেন্দ্রিক। আমরা যদি ভালো সম্পর্কের ভিত্তিতে সবার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটাতে পারি তাহলে আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পারবে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। কিন্তু দেশটি বড় ভুল করেছে শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে। ফলে শেখ হাসিনার সঙ্গে সঙ্গে এখানে তাদেরও পরাজয় ঘটেছে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হলে তাদের স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে– বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অস্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত নয়। এটি তাদের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ সমস্যা, স্থানীয়ভাবেই সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বড় প্রতিবন্ধকতা। ভারতের সঙ্গে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও চীনের সীমান্তও রয়েছে। কিন্তু কোনো সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যাকাণ্ড না হলেও বাংলাদেশ সীমান্তে সেটা ঘটে। ভারতের অভিযোগ, তারা চোরাকারবারিদের প্রতি গুলি চালায়। কিন্তু পাকিস্তান বা নেপাল সীমান্তেও মাদক, চোরাকারবারি ঘটে; সেখানে তারা সরাসরি গুলি করে না। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজের দিক থেকে কাজ করতে হবে। ভারতকেও বুঝতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির পরিবর্তন হচ্ছে। 
অন্যদিকে আশঙ্কা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রোহিঙ্গা ইস্যুকেন্দ্রিক তহবিল বরাদ্দ কমিয়ে দেবে। ফলে আমাদের দক্ষতাভিত্তিক অর্থনীতির চিন্তা করতে হবে। আমরা যদি আমেরিকার বাজারে সস্তায় শ্রম, সুলভ মূল্যে পণ্য রপ্তানি করতে পারি তাহলে ট্রাম্পের মেয়াদেও ভালো সম্পর্ক সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আইসিটি ও রপ্তানিমুখী কৃষির মতো খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আগামী দিনে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের তৈরি শিল্প থেকে বিভিন্ন খাতে ব্যবসার সম্পর্কে যেতে হবে। আমরা যদি চীনের থেকে কম দামে পণ্য, ভারতের থেকে কম মজুরিতে আইটি ইঞ্জিনিয়ার দিতে পারি, তাহলে আমেরিকা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বাধ্য হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলে বিশ্বমণ্ডলে কর্মসংস্থানের উপযোগী প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করা জরুরি। বাংলাদেশের নাগরিক পরিশ্রমী ও বিশ্বস্ত হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষায় গৌরবজনক ভূমিকা পালন করছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে; এখন প্রয়োজন কেবল দক্ষতা বৃদ্ধি ও উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম।
বর্তমানে দেড়-দুই কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কেবল বৈদেশিক সম্পর্কে সীমাবদ্ধ। এটাকে প্রবাসীদের জন্য সেবামূলক নীতিতে রূপান্তর ঘটাতে হবে। বিভিন্ন দেশে আমাদের মিশনগুলোর মূল কাজ হবে প্রবাসীদের উত্তম সেবা দেওয়া, ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, ভাষা শিক্ষা, ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি, চিকিৎসা সহায়তা ও মৃত্যুর পর লাশ দেশে আনার বিষয়ে সাহায্য করা। মিশনগুলোতে তরুণ ও সক্রিয় লোকজনকে যুক্ত করাও জরুরি।

আমাদের মানবসম্পদ রপ্তানির খাতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে সীমিত না রেখে সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। শুধু গার্মেন্টস বা চামড়ার ওপর নির্ভর না করে নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরির কথা ভাবতে হবে। আবার প্রবাসীরাও যাতে দেশে দ্রুত ও নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করতে পারে, সে জন্য বিদ্যমান আইন সহজ করতে হবে। 
সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য জরুরি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বেশি। এটাকে টেকসই করা গেলে বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক বাড়বে। আমাদের বৈশ্বিক অবস্থানও সুদৃঢ় হবে।

আকরাম হুসাইন: যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পাটি (এনসিপি)

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত স বতন ত র র র জন ত র জন ত ক ত র পর আম দ র প রব স আম র ক ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৩৫ কিলোমিটারজুটে যানজট

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার নিমশার থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটারজুড়ে যানজট দেখা দিয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকেরা। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি কাভার্ড ভ্যান উল্টে যাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এ যানজট দেখা দেয়। 

হাইওয়ে পুলিশ  জানায়, বৃহস্পতিবার ভোরে মহাসড়কে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার নূরীতলা এলাকায় একটি কাভার্ড ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। ফেনী থেকে রেকার এনে কাভার্ড ভ্যানটি উদ্ধারের কাজ শুরু করে পুলিশ। 

সকাল সাড়ে ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মহাসড়কে যানজট দেখা গেছে। 

ঢাকাগামী রয়েল পরিবহনের চালক রমিজ উদ্দিন বলেন, সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করে বুড়িচংয়ের নিমশার বাজারে যানজটে এক ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। ৫ মিনিট গাড়ি চললে ২০ মিনিট বসে থাকতে হয়। এভাবে ১০টা ৪০ মিনিটে চান্দিনায় পৌঁছেছি। এ সময়ে ঢাকার কাছাকাছি থাকার কথা ছিল। 

নিমশার বাজারে আটকে থাকা প্রাইভেট কারের যাত্রী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভোর থেকে যানজট অথচ সড়কে হাইওয়ে পুলিশ দেখছি না। 

ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুহুল আমিন বলেন, মহাসড়কের নূরীতলা এলাকায় উল্টে কাভার্ড ভ্যানটি আড়াআড়িভাবে পড়ে ছিল। পরে ঢাকামুখী লেনের বেশ কিছু গাড়ি উল্টো পথে ঢোকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ফেনী থেকে ক্রেন এনে গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে। যান চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। 

হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিওনের পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি মো. খাইরুল আলম সমকালকে বলেন, দুর্ঘটনার কারণেই যানজট দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনা কবলিত কাভার্ড ভ্যানটি উদ্ধার করা হয়েছে। যান চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ