অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীন ও জাপান সফরে যাচ্ছেন। ২৬ মার্চ থেকে ২৯ মে তথা প্রায় দুই মাসের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি সফর অনুষ্ঠিত হবে। সফরকালে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টার চীন ও জাপান সফরের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। দেশ দুটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মূলত দুই দেশেই দুটি পৃথক বহুপক্ষীয় ফোরামে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পরে চীন ও জাপান নিজেদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও প্রধান উপদেষ্টাকে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানায়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা ২৬ থেকে ২৯ মার্চ চীন সফর করবেন। তিনি ২৬ মার্চ দুপুরে চীনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন। চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠেয় বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা অধ্যাপক ইউনূসের। সম্মেলন শেষে ২৮ মার্চ তিনি বেইজিংয়ে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। ২৯ মার্চ তিনি দেশে ফিরবেন।

অন্যদিকে জাপানের টোকিওতে ২৯ ও ৩০ মে নিক্কেই ফোরামের বৈঠকে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।

প্রসঙ্গত, বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ায় যোগ দিতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানান ২৫ দেশের এই জোটের মহাসচিব ঝ্যাং জুন। ওই সময় দুই দেশের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তিতে মার্চে প্রধান উপদেষ্টাকে বেইজিং সফরে নিতে চায় চীন। প্রধান উপদেষ্টাকে বেইজিং সফরে নিতে চীনের পক্ষ থেকে ভাড়া করা উড়োজাহাজ পাঠানোর বিষয়টিও বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুই দেশের সম্পর্ক গভীর করতে মনোযোগ দিচ্ছে চীন। বিশেষ করে দুই দেশের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তিতে সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করার জন্য সহায়ক সময় হিসেবে দেশটি বিবেচনা করছে। এরই অংশ হিসেবে দুই দেশের মধ্যে উচ্চতর পর্যায়ে সফর আয়োজনের প্রস্তাব দেয় চীন। এরই ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো.

তৌহিদ হোসেন বেইজিং সফর করেন।

সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের শর্ত

চীন দুই দেশের মধ্যে উচ্চতর সফর বিনিময়ে আগ্রহী হলেও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় পরিসরে আলোচনার বিষয়টিতে প্রাধান্য দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ৫ আগস্ট–পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, ঢাকা–ওয়াশিংটন সম্পর্ক চীন কীভাবে দেখছে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌতূহল—এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখেছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে পুরোপুরি দ্বিপক্ষীয় পরিসরে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক না হলে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর নিয়ে বাংলাদেশ ততটা আগ্রহী ছিল না।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনকে বলা হয়েছিল, সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নিশ্চিত হলে প্রধান উপদেষ্টার সফরটি হতে পারে। পরে চীনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

স্বাস্থ্য কূটনীতির পথ ধরে আকাশপথে যোগাযোগ

ঢাকা–বেইজিং সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তিকে সামনে রেখে দুই দেশ চিকিৎসা খাতে নিবিড় সহযোগিতায় মনোযোগ দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত জানুয়ারিতে বেইজিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে চীনের কুনমিংয়ের তিনটি শীর্ষস্থানীয় বিশেষায়িত হাসপাতালে বাংলাদেশের নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই তিন হাসপাতালের পাশাপাশি একটি ক্যানসার হাসপাতালকেও বাংলাদেশের রোগীদের জন্য নির্বাচিত করা হচ্ছে। কুনমিংয়ে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশের রোগীদের প্রথম দল ১০ মার্চ চীন যাচ্ছে।  

কুনমিংয়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রথম মৈত্রী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দুই দেশ কাজ করছে। এ ছাড়া ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বিশেষায়িত আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সহায়তা দিতে যাচ্ছে চীন।

ইউনান প্রদেশে চিকিৎসাসেবার পথ সুগম করতে আকাশপথে চট্টগ্রাম ও কুনমিংয়ের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ও চীন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কুনমিংয়ে সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হবে। এর পাশাপাশি দুই দেশ চট্টগ্রাম ও সাংহাইয়ের মধ্যে আকাশপথে যোগাযোগের বিষয়ে আলোচনা করছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরর ষ ট র পর য য় ন সফর করব ন

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ