ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ব্লক বি নগর প্লাজার নকশাবিহীন ৯১১টি অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেন। এই উচ্ছেদ নিয়ে আরেক সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্যে বাহাস উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতিতে। তাপস অভিযোগ করেন, পার্কিং, লিফট, সিঁড়ি, টয়লেট অবৈধভাবে দখল করে সাঈদ খোকনের আমলে অবৈধ দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এ নিয়ে নকশাবহির্ভূত দোকান বরাদ্দে ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল খোকনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে। এবার এই মার্কেটেই দোকান বরাদ্দে অনিয়ম ও মোটা অঙ্কের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেটের জালিয়াতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮০টি দোকানের বিপরীতে ৪৫১টি পে-অর্ডার জমা পড়ে করপোরেশনে। আবার প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের পে-অর্ডার জমাদানে বাধা দিয়ে জোর করে নামমাত্র টাকায় ১৫০ দোকান কেনে সিন্ডিকেট। এতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক মেয়র তাপসের গড়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ব্লক বি দোকান মালিক সমিতির সদস্য সংখ্যা ৫৯৫। এর মধ্যে ২১৫ জনকে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন সময়ে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৩৮০ জনকে দোকান বরাদ্দ না দেওয়ায় সমিতি একাধিকবার আবেদন করে। পরে ২০১৭ সালে দোকান মালিকরা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট এ মামলার ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮০ জনকেও দোকান বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দেন। এই আদেশের আলোকে গত বছরের ২০ মার্চ করপোরেশনের দোকান বরাদ্দ কমিটির সভায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮০ জনকে মার্কেটের ষষ্ঠ থেকে অষ্টমতলায় লটারির মাধ্যমে দোকান বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। 

কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রারম্ভিক সালামি জমা দিতে করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ থেকে চিঠি দেওয়ার কথা। তবে এই চিঠি শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছায়নি। ডিএসসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ওমর বিন আবদাল আজিজ তামিম, দোকান মালিক সমবায় সমিতির সহসভাপতি শাহ আলম চৌধুরী, জাকের মার্কেট সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শ্রমিক লীগের সহসভাপতি সহিদুর রহমান, মেয়রের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নাছিরুল হাসান সজীব, করপোরেশনের অঞ্চল-৪-এর তৎকালীন বাজার ও বিবিধ রাজস্ব পরিবীক্ষণের রাজস্ব কর্মকর্তা মিয়া জুনায়েদ আমিন, কর কর্মকর্তা আনিসুর রহমান এবং বাজার সুপারভাইজার হাবীবুর রহমান সিন্ডিকেট করে ডাকঘর থেকে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চিঠি নিজেদের কাছে রেখে দেন। পরে তামিম ও ফিরোজ আহমেদের কাছে এ চিঠি ক্ষতিগ্রস্তরা নিতে গেলে তাদের কাছে ৫-৭ লাখ টাকা দাবি করেন তারা। 

পরে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবির মুখে অঞ্চল-৪-এর রাজস্ব বিভাগের তিন কর্মকর্তা করপোরেশনের ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি না নিয়েই ক্ষতিগ্রস্তদের চিঠির ফটোকপি পাঠান। তবে চিঠির ফটোকপি দিলেও মূল চিঠি ছাড়া সালামির পে-অর্ডার জমা নেননি তারা। আবার অনেকের জমা নিলেও পে-অর্ডারের রসিদ দেননি। ফলে বাধ্য হয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ৫-৭ লাখ টাকা দিয়ে রাজস্ব বিভাগের প্রকৃত চিঠি নিয়ে সালামির টাকা জমা দেয়। এতে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। আর যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৫০ জনের কাছ থেকে নামে-বেনামে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে দোকান কিনে নেয় তামিম ও ফিরোজ চক্র। বর্তমানে এসব দোকানের প্রতিটির বাজারমূল্য ২০-২২ লাখ টাকা। এতে ১৫০ দোকানের বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। 

তবে তৎকালীন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হকের হস্তক্ষেপে ফটোকপি চিঠি দিয়ে কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীও সালামি জমার সুযোগ পান। এ জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৮০ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর স্থানে ৪৫১ জনের কাছ থেকে সালামি গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। এখন প্রকৃত সদস্যদের চিহ্নিত করতে করপোরেশনই জটিলতার মধ্যে পড়েছে।  করপোরেশনের বাজার সুপারভাইজার হাবীবুর রহমান গত ১২ ফেব্রুয়ারি অন্যত্র বদলি হলেও এখনও নিয়মিত অফিস করছেন। তাঁর স্থলে শাহীন হাওলাদারকে পদায়ন করা হলেও এখন পর্যন্ত তাঁকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আর সাবেক মেয়র তাপস পালিয়ে যাওয়ার পর এখন সিটির রাজস্ব বিভাগের এ সিন্ডিকেটের হাতবদল হয়েছে। কাউন্সিলর তামিম গা-ঢাকা দেওয়ার আগে ফিরোজ আহমেদের কাছে দোকানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। এই সিন্ডিকেটে নতুন যোগ দিয়েছেন বংশাল থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মামুন আহম্মেদ এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো.

আবু সুফিয়ান। জাল-জালিয়াতির দোকান বরাদ্দে ঝামেলা এড়াতে মামুনকে ১০টি দোকানের কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয় ফিরোজ সিন্ডিকেট। এ বিষয়ে মামুন ও সুফিয়ানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। 

এদিকে ৫ আগস্টের পরে ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী তাপসের সময়ে দোকান বরাদ্দের প্রারম্ভিক সালামি জমা দিতে না পেরে ডিএসসিসি প্রশাসকের কাছে সালামি জমাদানে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে লিখিত অভিযোগ দেন। তবে সিন্ডিকেটের চাপে করপোরেশন এসব অভিযোগ তদন্তে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এদিকে, গত আগস্ট ও অক্টোবরে সিটি করপোরেশনকে দুবার চিঠি দিয়ে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের জানাতে বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। পরে করপোরেশন গত ১৪ নভেম্বর সমিতির সভাপতিকে চিঠি দিয়ে ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যদের চিহ্নিত করে প্রত্যয়নপত্রসহ অঞ্চল-৪-এর কর কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে অনুরোধ করে। তবে সিন্ডিকেটের চাপে একই তারিখে ও স্মারকে সমিতির সভাপতিকে ৩০ দিনের মধ্যে ৩৮০ জন ক্ষতিগ্রস্তের জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি চেয়ে করপোরেশনে আরেকটি চিঠি পাঠায়। প্রায় চার মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত বিষয়টির সুরাহা হয়নি। তবে সিন্ডিকেটের জাল সদস্যদের দোকান বরাদ্দ নিতে করপোরেশনের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে মোটা অঙ্কের অর্থ আর দোকান ভাগবাটোয়ারা চলছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ফিরোজ করপোরেশনে লিখিত অভিযোগে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী হিসেবে সালামির টাকা জমা দেওয়ার জন্য তারা বাজার সুপারভাইজার হাবীবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় হাবীব কাউন্সিলর তামিমের কাছ থেকে মূল কপি সংগ্রহ করতে বলেন। তামিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পে-অর্ডারের চার লাখ টাকার সঙ্গে আরও সাত লাখ টাকা দাবি করেন। পে-অর্ডারের টাকা ছাড়া আর টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের বাধায় টাকা জমা দিতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ব্লক বি দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল আহছান সমকালকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পরেও দোকান বরাদ্দের অগ্রগতি না হলে সাবেক কাউন্সিলর তামিম সাবেক মেয়র তাপসের কাছ থেকে দোকান বরাদ্দ প্রক্রিয়া শুরু করবেন বলে ৫ কোটি টাকা দাবি করে। উপায় না দেখে সমিতির সদস্যরা মিলে তাঁকে আড়াই কোটি দেই। কিন্তু দোকান বরাদ্দ প্রক্রিয়া শুরু হলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সালামি জমাদানের চিঠি তামিম ও ফিরোজ নিজেদের কাছে রেখে চাঁদাবাজি শুরু করেন। যারা চাঁদার টাকা দিতে পারেনি, তাদের কাছ থেকে নামমাত্র টাকায় ১৫০টি দোকান বিক্রয় করতে বাধ্য করে। এখন প্রকৃত সদস্য চিহ্নিতকরণে সমিতির প্রত্যয়নপত্র বা সমিতিকে না রাখলে সিন্ডিকেট আবার জালিয়াতি করবে।

তবে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে অভিযুক্তদের বক্তব্য নিতে যোগাযোগ করা হলে তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। আনিসুর রহমানের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। সমিতির সহসভাপতি শাহ আলম চৌধুরী সিন্ডিকেটে নিজের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করে বলেন, সাবেক মেয়র তাপস, ফিরোজ ও তামিমরা মিলে এসব করেছেন।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ ৩৮০ জন ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যের মধ্যে ৪৫১টি পে-অর্ডার জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭১ জন সদস্য দুটি করে পে-অর্ডার জমা দেওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকৃত সদস্য বাছাই করতে একটি গোষ্ঠী চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন বলে সিটি করপোরেশনে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে বেআইনি কার্যকলাপে যুক্ত হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রকৃত সদস্যরাই যেন দোকান পান, এ জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি দিয়ে যাচাই-বাছাই করা হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান সমকালকে বলেন, এই বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা নেই। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই যেন দোকান পান আর এতে যেন জালিয়াতির ঘটনা না ঘটে, এতে করপোরেশন সজাগ দৃষ্টি রাখবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ ক ন বর দ দ য গ য গ কর কর মকর ত ড এসস স র রহম ন এখন প

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।

নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।

মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।

ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।

শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।

চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।

কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।

পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।

ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।

এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ