কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর এলাকায় সবজি বিক্রি করে ভাতের অভাব দূর করতে পেরেছিলেন খুরশেদ মিয়া (৩৫)। সচ্ছল জীবনের আশায় পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন ইতালিতে। কঠিন এ যাত্রায় লিবিয়ায় কেটেছে তাঁর এক বছর আট মাস। এ সময় প্রতিদিন নতুন নতুন ঝুঁকি আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে রাতের অন্ধকারে কখনো চারতলা ভবনের জানালার কার্নিশে, আবার কখনো গাছের ডালে বসে কেটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার মাফিয়া চক্রের কাছে ধরা পড়ার আশঙ্কায় দোতলা ভবন থেকে লাফ দিতে হয়েছে তাঁকে। এতে ধরা পড়া এড়ানো গেলেও পঙ্গুত্ব সঙ্গী হয়েছে।
এ অবস্থায় খুরশেদকে এখন ‘পঙ্গু খুরশেদ’ পরিচয়ে বিছনায় দিন পার করতে হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, এখন তিনি সহায়-সম্বলহীন। নেই ভিটামাটি। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।

খুরশেদ পাশের জেলা নরসিংদীর বেলাব উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে। ১০ বছর ধরে তিনি ভৈরব পৌর শহরের লক্ষ্মীপুর এলাকায় থাকেন। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার।

শনিবার দুপুরে খুরশেদের সঙ্গে কথা হয়। দোচালার একটি ঘরের সামনের দিকের কক্ষে মশারি টানিয়ে শুয়ে ছিলেন। ঘরে তিনি একা। স্ত্রী হাজেরা খাতুন গেছেন অন্যের বাসায় কাজ করতে। সন্তানেরাও ঘরে নেই। ওই সময় তিনি লিবিয়ায় কাটানো এক বছর আট মাসের কঠিন দিনগুলোর কথা বলেন। কথায় কথায় জানা গেল, খুরশেদ ভৈরবে সবজির ব্যবসা করেছেন ১০ বছর। সচ্ছল জীবনের আশায় ২০২৩ সালের ১৪ জুন চার লাখ টাকা দিয়ে প্রথমে লিবিয়ায় যান তিনি। কথা ছিল, ইতালিতে যাওয়ার আগপর্যন্ত দালাল লিবিয়ায় কাজ বের করে দেবেন। লিবিয়ায় রংমিস্ত্রির কাজ পান খুরশেদ।

খুরশেদ বলতে থাকেন, গত বছরের ১০ জুলাই রাত দেড়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা খুরশেদদের বাসায় অভিযান চালান। ভবনটির চতুর্থ তলায় তাঁরা থাকতেন ১১ জন। বিপদ বুঝে খুরশেদ জানালার নেট কেটে চারতলা ভবনের কার্নিশে গিয়ে আশ্রয় নেন। দুই ঘণ্টা বসে ছিলেন কার্নিশে। প্রতিটি মিনিটকে মনে হয়েছে বছরের মতো।

এ ঘটনার পর খুরশেদ সেখান থেকে চলে যান। তিনি কর্মহীন ছিলেন এক মাস। পরে ৫০০ দিনারের বিনিময়ে একটি শপিং মলে কাজ জোটে তাঁর। মাস শেষে ১ হাজার ৪০০ দিনার দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় অর্ধেক। শপিং মলে প্রতারিত হওয়ার পর তিনি কাজ নেন একটি তেল কোম্পানিতে। প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ দিনার বেতনে সেখানে ছিলেন চার মাস। এর মধ্যে ৯ লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালিতে পৌঁছে দেওয়ার কথা হয় এক দালালের সঙ্গে। দুই দফায় ছয় লাখ টাকা দিয়েও ইতালিতে পৌঁছাতে পারেননি তিনি।

নতুন একটি স্থানে কিছুদিন রাখা হয় খুরশেদকে। সেখানে তাঁর সঙ্গে আরও ২১০ জনকে রাখা হয়। একদিন রাত ১০টায় আবার ওই স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালান। বিপদ বুঝে গোপন পথ দিয়ে বের হয়ে একটি উঁচু গাছের মাথায় গিয়ে অবস্থান নেন খুরশেদ। গাছের মাথায় নীরবে বসে থাকতে হয়েছে চার ঘণ্টা। ওই দিনের অভিযানে ১৬০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিপদ এড়াতে দালাল খুরশেদকে নতুন একটি স্থানে নিয়ে রাখেন। কিছুদিনের মধ্যে ওই ভবনে মাফিয়া চক্র হামলা চালায়। প্রাণে বাঁচতে এবার খুরশেদ দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েন। এতে তাঁর হাত ও পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসা নিতে না পারায় তাঁর পায়ের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে।

পাঁচ দিন পর খুরশেদকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে জানানো হয়, পায়ে সংক্রমণ হয়েছে। ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে দালালের লোকজন খুরশেদকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সরিয়ে একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ছিলেন সাড়ে তিন মাস। এ সময়ে তাঁর পাঁচটি অস্ত্রোপচার হয়। পরে এক ব্যক্তির সহযোগিতায় খুরশেদ চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে আসেন।

এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে খুরশেদের চিকিৎসা চলছে। তিনি হাঁটতে পারেন না। পায়ের ক্ষত শুকায়নি। হুইলচেয়ারে করে নড়াচড়া করতে হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সুস্থ হতে অনেক দিন সময় লাগবে তাঁর। তবে আগের মতো আর স্বাভাবিক হতে পারবেন না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তিনি বলেন, ইতালিতে যাওয়ার জন্য সব মিলিয়ে তাঁর ১৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চিকিৎসায়ও খরচ হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে বসতঘরের জায়গা বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

একসময় কাজ সেরে বাড়ি ফেরেন খুরশেদের স্ত্রী হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘এই ইতালি আমারে ঘরবাড়িহারা করল। স্বামীকে পঙ্গু বানাল। আমাকে অন্যের বাড়িতে কাজের বুয়া বানাল। সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিয়ে গেল। এখন আমি নিঃস্ব। কিছু নাই। বাকি দিনগুলো পার করার মতো মনের সাহসও নাই।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘কৃষির উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে’

স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, “জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যতম প্রধান অংশীদার ও পরীক্ষিত বন্ধু। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)-এর মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে আসছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে।”

বুধবার (৩০ এপ্রিল) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর অফিসকক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত Saida Shinichi-এর সাক্ষাৎকালে তিনি এসব কথা বলেন।

বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে কৃষি খাতে সহযোগিতা বিশেষ করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, ফসলের পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও সংরক্ষণ, জলবায়ু ও স্মার্ট কৃষি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, ২০২৭ সালে জাপানের ইয়োকোহামাতে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপো’তে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, কৃষি বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ সংস্কার, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যু সহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠকের শুরুতে রাষ্ট্রদূতকে স্বাগত জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “জাপান বাংলাদেশের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগামী দিনগুলোতে এ সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।” 

উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “২০২৭ সালে জাপানের ইয়োকোহামা'তে ‘আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপো’ অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক এ এক্সপো'তে বাংলাদেশকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ।”

উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। আর জাপান কৃষি খাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারী দেশ। তাই জাপান বাংলাদেশের কৃষি খাতে বিশেষ করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, ফসলের পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও সংরক্ষণ, জলবায়ু ও স্মার্ট কৃষি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা করতে পারে।” 

তিনি বলেন, “জাপান বাংলাদেশের কৃষি পণ্য সংরক্ষণে আধুনিক হিমাগার স্থাপন ও কুলিং ভ্যান সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে পারে। তাছাড়া জাপান আমাদেরকে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সহায়তা করতে পারে।” 

তিনি এসময় রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানান।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “কৃষি বিষয়ক দু'দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সর্বশেষ সভা ২০২৪ সালের মে মাসে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্রুত এ সংক্রান্ত পরবর্তী সভা আয়োজন করা দরকার।” 

উপদেষ্টা জানান, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের পরবর্তী সভা এ বছরের অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ সভা আয়োজনের বিষয়ে বাংলাদেশ সব ধরনের সহযোগিতা করবে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমানে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। তবে এটির আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে এবং আমরা এ ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছি।” 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কোনো সুযোগ নেই, বরং দিন দিন এটির উন্নতি ঘটবে বলে আমি আশা করছি।”

পুলিশের সামর্থ্য ও গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, “৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতির তুলনায় বর্তমানে পুলিশের সামর্থ্য, মনোবল ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি বেড়েছে।” 

তিনি এসময় আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জাপানের সহায়তা কামনা করেন। তাছাড়া তিনি নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডকে পেট্রোল ভেসেল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা এবং অধিক সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে জাপানে উন্নত প্রশিক্ষণে প্রেরণের জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন। 

রাষ্ট্রদূত জানান, আগামী ইন্টারপোল নির্বাচনে নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে জাপানের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদান করা হবে। উপদেষ্টা এ পদে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করেন।
বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাপান দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ৪৫% রাজনৈতিক
  • নির্বাচনে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত করাসহ ১২ প্রস্তাব
  • ‘কৃষির উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে’
  • ডিবির অভিযানে আ.লীগের সাবেক এমপিসহ গ্রেপ্তার ৭
  • পুলিশ সপ্তাহ শুরু মঙ্গলবার, নির্বাচনী নির্দেশনা পাবে আইনশৃঙ্খলা ব
  • সাবেক আইজিপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আবার বাড়ল