ফিলিপাইনে মাদকবিরোধী যুদ্ধের সব দায় নিলেন দুতার্তে
Published: 13th, March 2025 GMT
ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে বলেছেন, তাঁর প্রশাসনের ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ সম্পূর্ণ দায়ভার তিনি গ্রহণ করছেন।
দুতার্তের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক ভিডিও বার্তায় এ কথা বলেন ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট।
মাদকবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পরোয়ানার আওতায় গত মঙ্গলবার ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় দুতার্তেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই দিন দুতার্তেকে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত আইসিসির উদ্দেশে পাঠানো হয়। ৭৯ বছর বয়সী দুতার্তে এখন এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন।
দুতার্তে কয়েক দফায় ফিলিপাইনের দাভাওয়ের সিটি মেয়র ছিলেন। পরে তিনি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দুতার্তে মেয়র ও প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। কথিত এই মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে বহু মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে দুতার্তের মাদকবিরোধী অভিযানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে তদন্ত করে আইসিসি। এই তদন্তের আলোতে আইসিসি দুতার্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আইসিসির পরোয়ানা মেনে গত মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। হংকং থেকে সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে ম্যানিলা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরই গ্রেপ্তার হন দুতার্তে।
গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মাথায় মঙ্গলবার রাতেই দ্য হেগগামী একটি উড়োজাহাজে দুর্তাতেকে তুলে দেওয়া হয়। দুতার্তে দ্য হেগে পৌঁছানোর পর গতকাল বুধবার তাঁকে হেফাজতে নিয়েছেন আইসিসি।
গ্রেপ্তারের ধারাবাহিকতায় দুতার্তেকে দ্য হেগগামী উড়োজাহাজে তুলে দেওয়ার পর এই প্রথম তিনি কোনো বার্তা দিলেন।
দুই মিনিটের একটু বেশি সময়ের ভিডিও বার্তায় দুর্তাতে বলেন, ‘অতীতে যা-ই ঘটুক না কেন, আমি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর সামনে থাকব। আমি আগেই বলেছি, আমি আপনাদের রক্ষা করব এবং আমি সবকিছুর জন্য দায়ী থাকব।’
আরও পড়ুনআইসিসির পরোয়ানা: ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তে গ্রেপ্তার১১ মার্চ ২০২৫দুতার্তের ভিডিও বার্তাটি ইতিমধ্যে এক কোটিবার দেখা হয়ে গেছে। ভিডিওতে শুধু দুতার্তেকেই কথা বলতে দেখা যায়। তাঁর পরনে ছিল সাদা রঙের একটি জামা।
দেখে মনে হয়েছে, উড়োজাহাজের ভেতরে ভিডিওটি ধারণ করা। ভিডিওতে তাঁর কথা বলার সময় ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
দুতার্তেকে নিয়ে আইসিসি একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুতার্তে আইসিসির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। মানুষ হত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফিলিপাইনের কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
দুতার্তেকে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে দ্য হেগের আইসিসির বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। তাঁকে নেদারল্যান্ডসের একটি বন্দিশালায় রাখা হয়েছে।
ভিডিও বার্তায় দুতার্তে তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমি ঠিক আছি, চিন্তা করবেন না।’
দুতার্তে আরও বলেন, ‘এটা একটা দীর্ঘ আইনিপ্রক্রিয়া হবে। তবে আমি আপনাদের বলছি, আমি আমার দেশের জন্য কাজ করে যাব এবং যদি এটাই আমার নিয়তি হয়, তবে তা–ই হোক।’
দুতার্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে (২০১৬-২০২২ সাল) মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে তিনি ‘ডেথ স্কোয়াড’ গঠন ও পরিচালনা করেছিলেন। এভাবে বহু মানুষ হত্যার মাধ্যমে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
এশিয়ার দেশগুলোর সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দুতার্তেই প্রথম আইসিসিতে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন।
আরও পড়ুনফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে আইসিসিতে পাঠানো হয়েছে১২ মার্চ ২০২৫আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় বলা হয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুতার্তে কথিত মাদক ব্যবহারকারী ও মাদক কারবারিদের হত্যা করতে ডেথ স্কোয়াড গঠন করেন। অর্থায়ন করেন। অস্ত্রের জোগান দেন।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুতার্তের ছয় বছরের শাসনামলে ফিলিপাইনে মাদকবিরোধী অভিযানে ৬ হাজার ২০০ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
দুতার্তের মেয়ে সারা দুতার্তে ফিলিপাইনের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দ্য হেগে পৌঁছেছেন বলে তাঁর কার্যালয় থেকে জানানো হয়।
আইনজীবী ও শিক্ষাবিদেরা বলছেন, দুতার্তেকে গ্রেপ্তার করে দ্য হেগে নিয়ে যাওয়াটা আইসিসির জন্য একটি বড় ঘটনা।
আইসিসির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আছে। তা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করার জন্য এই আদালতের নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, দুতার্তের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ওয়াশিংটন অবগত।
আরও পড়ুনঅপরাধ দমনে ‘ডেথ স্কোয়াড’ রাখার কথা স্বীকার করলেন দুতার্তে২৯ অক্টোবর ২০২৪আরও পড়ুনআইসিসির পরোয়ানায় গ্রেপ্তার হলেও দুতার্তের বিচার করা কি সম্ভব হবে২২ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ ল প ইন র স ব ক প র স ড ন ট গ র প ত র কর ম নবত ব র ধ ম দকব র ধ আইস স র পর য় ন র জন য অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’