বাঘাইর চরটি উত্তাল যমুনা নদীর মাঝ বরাবর। শুষ্ক মৌসুমে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বর্ষায় সময় কম লাগলেও প্রমত্তা নদীর স্রোত ভেঙে মানুষ একান্ত অনন্যোপায় না হলে নদীতীরে আসে না। এই চরের উৎপত্তি কবে, কত বছর আগে থেকে মানুষ বসবাস শুরু করেছে, তা বৃদ্ধরাও বলতে পারে না। চরের মাঝ বরাবর মানববসতি।
ফি-বছর বন্যার পানি যখন নেমে যায়, রেখে যায় নষ্টবিনষ্ট ধানক্ষেত, ভেঙে পড়া বাড়িঘর– সেই সাথে মানুষের স্বপ্ন। তবু মানুষ এখানে আছে। যাওয়ার জায়গা নেই। নদী পয়স্তি এই চর খাসজমি– নদী শিকস্তি পরিবারগুলো মামলা-মোকদ্দমা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর– সমাধান নেই।
কালাম এসব নিয়ে ভাবে– নাহ, এসব চিন্তা করে লাভ নেই, বরং বাড়িঘর মেরামত, জমিতে ফের আবাদ– এই তাদের নিয়তি।
সে এটুকু জেনেছে, তার জীবন মানে, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করা। বউ সুলতানা প্রতিদিন সকালে উঠে নীরবেই তার নির্ধারিত কাজ শুরু করে। ভাঙাচোরা ঘরটিতে রান্না করে, মোরগ-মুরগিকে খাবার দেয়, ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে, আর ছেলের দেখাশোনা করে। অবসর সময়ে তার চোখেও শূন্যতা।
এমন নয় যে তার স্বপ্ন ছিল না। তারও স্বপ্ন ছিল, তবে এখন সে স্বপ্ন দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
কালাম মাঝে মাঝে তাকে দেখে ভাবে, ‘আমি কি ওর জন্য, বাচ্চাটার জন্য কিছু করতে পারি? এই জীবন কি বদলানো সম্ভব?’ ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে আবারও সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে।
২.
গ্রামের দক্ষিণ কোণে জলাভূমি পেরিয়ে একটা সাদা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এই গ্রামের ইতিহাসের মতো পুরোনো। কেউ জানে না এটি কে তৈরি করেছে, কেন তৈরি করেছে! তবে দেয়ালটি নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে।
একজন বয়স্ক মানুষ– কাসেম মাতবর, প্রায়ই বলে, ‘এই দেয়ালের ওপারে যা আছে, তা মানুষের চোখে দেখার জন্য নয়। সেখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। এ পর্যন্ত যারা দেয়াল টপকে গিয়েছে তারা কেউই ফিরে আসেনি। দেয়ালের ওপারে স্বপ্নের পৃথিবী।’
কালাম জলাভূমি পেরিয়ে কখনও দেয়ালের কাছে যায়নি। যেতে ইচ্ছে করে। অনেক মানুষই জলাভূমিতে ছোট ছোট কোশা নৌকা নিয়ে মাছ ধরে। দেয়ালের কাছে যায় না।
কাসেম মাতবরের বলা গল্পগুলো তার মনে কৌতূহল জাগায়। বিশেষ করে যখন তার নিজের জীবন ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছে। গেল বছরের মতো এ বছরেও বন্যায় তার জমির সব ফসল শেষ। ঘর ভেঙে গেছে। অর্পণের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেওয়াও কষ্ট।
রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে জলাভূমির ওপারে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবে, ‘এমনও তো হতে পারে দেয়ালেরই ওপারে আমার স্বপ্ন পূরণের চাবি।’
শিশুকাল থেকেই দেয়ালটি নিয়ে তার মনে নানা কৌতূহল। সেই কৌতূহলের কথা শুধু সুলতানাকেই বলেছে– আর কাউকে নয়। সাহসী কালাম কিশোর বয়স থেকেই ভাবে, সুযোগ পেলে সে দেয়ালের ওপরে উঠে দেখবে কী আছে। দেয়ালের ওপারে যাবে না।
পূর্ণিমার এক রাতে কালাম সুলতানাকে না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে জলাভূমির কাছে আসে। আকাশে তখন সোনার থালার মতো পূর্ণ চাঁদ।
আকাশের গায়ে সেঁটে থাকা অসংখ্য তারকা যেন কালামকেই দেখছে। চাঁদের আলোয় জলাভূমির পানিতে ভেসে থাকা সাদা শাপলা, লাল পদ্ম ফুলগুলো অপূর্ব এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
জলাভূমির ঘাটে বেঁধে রাখা একটা কোশা নৌকা নিয়ে সে দেয়ালের দিকে বৈঠা চলায়। দূরে নদীর দিকে তাকালে মনে হয়, সে যেন তাকে পেছনে ডাকছে। নদীর স্রোতের গর্জনও পরিষ্কার শোনা যায়। তবুও কালাম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ– যেহেতু ঘর থেকে বের হয়েছে, আজ সে ফিরে যাবে না।
জলাভূমি পেরিয়ে কালাম দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাছে থেকে দেয়ালটি আরও অদ্ভুত মনে হয়। তার গায়ে কোনো ফাটল নেই, তবু এটি যেন স্থির কিছু নয়। ধোঁয়ার মতো কাঁপে। কালাম হাত বাড়িয়ে দেয়াল ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ধোঁয়া তার আঙুলের ভেতর দিয়ে চলে যায়।
সে ভয় পায়, আবার কৌতূহলও হয়। ধীরে ধীরে সে দেয়ালের গায়ে পা রাখে। দেয়ালের গায়ে পা রাখতেই সে দেখে দেয়াল নেই।
ওপারে নানা বর্ণের ফুলের বাগান। পৃথিবী যেন স্বপ্নের মতো! সবকিছু নিখুঁত সাজানো। আকাশে উজ্জ্বল আলো। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ। মূল্যবান পোশাক পরিহিত লোকেরা হাসছে– সুখী মানুষের মতো। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে কালাম কিছু অস্বাভাবিকতাও লক্ষ করে। মানুষগুলোর চোখে যেন একধরনের শূন্যতা। তারা জীবিত না মৃত বোঝা যায় না।
কালাম ভাবে, ‘স্বর্গে চলে এলাম?’
একটি লোক এগিয়ে আসে। তার মুখে হাসি, কিন্তু তার চোখ পুরোটাই সাদা– চোখের অক্ষিগোলক নেই। সে বলে, ‘এখানে তুমি নতুন বুঝি? তোমার গায়ে নোংরা পোশাক দেখে তাই মনে হয়। এখানে তুমি সব পাবে। কোনো দুঃখ নেই, কোনো কষ্ট নেই। যা চাইবে, তাই হবে।’
কালাম অবাক হয়ে চারপাশ দেখে। সত্যিই তার যা প্রয়োজন, তা সে শুধু মনে চাইলেই উপস্থিত হয়। কিন্তু তার মন অস্বস্তিতে ভরে যায়। এখানে কোনো কাজ নেই, পরিশ্রম নেই, আশেপাশের বাগানে অসংখ্য খাবার সাজিয়ে রাখা– হাত বাড়িয়ে খেয়ে নিতে হয়। এখানে ঝাঁ চকচকে রোদ নেই, ঝোড়ো বাতাস নেই, ঘনঘোর বৃষ্টি নেই, অন্ধকার নেই। শুধুই কৃত্রিম সুখ।
কালাম কয়েকদিন সেই পৃথিবীতে থাকে। তার মনে হয়, সে বেঁচে নেই, বরং একধরনের ঘোরের মধ্যে আছে। দিনগুলো যেন একঘেয়ে। কিছুই বদলায় না। সুলতানার কথা, অর্পণের কথা খুব মনে পড়ে। ওরা কীভাবে আছে? খাচ্ছেই-বা কী? একদিন সে দেয়ালের কাছে ফিরে আসে এবং গ্রামে ফেরার চেষ্টা করে। কিন্তু দেয়ালটি যেন শক্ত হয়ে গেছে। ধোঁয়ার বদলে সেটি পাথরের মতো হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ তার চারপাশের লোকেরা তার দিকে তাকায়। তাদের চোখে অদ্ভুত শূন্যতা, কিন্তু এবার সেই শূন্যতা ভয়ানক। তারা এগিয়ে আসে।
কালাম চিৎকার করে, ‘আমি এখানে থাকতে চাই না! আমাকে আমার গ্রামে ফিরতে দাও!’
একজন লোক বলে, ‘তুমি ফিরতে পারবে না। তুমি আমাদের মতো হয়ে যাও। এখানে সুখ আছে।’
এই পৃথিবী একধরনের মায়া। এ পৃথিবী সুখী দেখায়, কিন্তু এতে কোনো প্রাণ নেই। মনে মনে ভাবে, ‘আমাকে ফিরতেই হবে।’
আবারও শক্তি জড়ো করে সে দেয়ালের দিকে দৌড়ায়। দেয়াল ভেদ করার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়। কিন্তু চেষ্টা থামায় না। সমগ্র ইচ্ছাশক্তি জড়ো করে সে বারংবার চেষ্টা করতে থাকে।
হঠাৎ মনে হলো দেয়াল বুঝি ক্ষণিকের জন্য আবারও ধোঁয়ায় পরিণত হলো। পরের চেষ্টাতেই কালাম দেয়ালের ভেতর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে। তার রেখে যাওয়া কোশা নৌকা তেমনই আছে। ভয়ে কেউ নিশ্চয় নৌকার খোঁজে এতদূর আসেনি।
গ্রামে ফিরে এসে কালাম দেখতে পায়, সবকিছু ঠিক আগের মতো। নদী তার স্বভাবসুলভ গর্জনে বইছে। সুলতানা তাকে দেখে কিছু বলতে পারে না– শুধু কাঁদে। অর্পণ ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। গ্রামের লোকেরা জড়ো হয়। তারা জানতে চায়, ‘দেয়ালের ওপারে কী দেখেছ?’
কালাম তাদের বলে, ‘দেয়ালের ওপারে যা দেখেছি, তা আমাদের জন্য নয়। সেখানে সুখ আছে, কিন্তু প্রাণ নেই।’
“সেটা কেমন?”
“সেখানে কিছু পেতে কোনো কষ্ট করতে হয় না। আমি বুঝেছি, এই কষ্টই আমাদের প্রাণ।’
তার কথা কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। কালাম সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর দেয়ালের দিকে ফিরে তাকাবে না। আবার জমিতে কাজ শুরু করে। সুলতানা তাকে দেখে হাসে। অর্পণ বাবার পাশে বসে তার গল্প শোনে।
একদিন অর্পণ বলে, ‘বাবা, আমরা কি কখনও সেই দেয়ালে যাব না?’
কালাম মাথা নাড়ে। ‘না, বাবা। আমরা এখানেই থাকব। যা খুঁজছি, তা এখানেই আছে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য ত র মন ক ত হল শ ন যত
এছাড়াও পড়ুন:
একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা
হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।
চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।
শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।
আরো পড়ুন:
বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’
শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’
চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’
ঢাকা/রাজীব