হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন– ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চার সপ্তাহে সব ‘অবৈধ’ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে; অন্যথায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। ইটভাটা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ– এটি সত্য। এটিও সত্য– ইট তৈরিতে যে মাটির প্রয়োজন, তা যত্রতত্র সংগ্রহ করলে জীববৈচিত্র্যের ওপর আঘাত আসতে পারে। বায়ুদূষণ হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর টেকসই ইট তৈরির পেছনে জোর দিয়েছে। ‘ইট উৎপাদন ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩’-এর ৫ অনুচ্ছেদ যেমন মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণের কথা বলছে, তেমনি ৮ অনুচ্ছেদ কতিপয় স্থানে ইটভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিষিদ্ধ করছে। অন্যান্য অনুচ্ছেদে জ্বালানি ব্যবহার, বর্জ্য নির্গমন ও গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলা হয়েছে। আইন ভঙ্গকারীর দণ্ড কী হবে, তাও বর্ণিত রয়েছে আইনটিতে। এই আইন পরিবেশ রক্ষা ও বায়ুদূষণ কমানোর জন্য জরুরি। তাই এর যথাযথ প্রয়োগ যাতে হতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কঠোর হওয়াই স্বাভাবিক। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে তা হলো, শ্রমিক অধিকার।
সরকারকে বুঝতে হবে, ইটভাটার মালিক যদি আইন ভঙ্গ করেন, সে দণ্ড মালিকের প্রাপ্য। রাতারাতি যদি ভাটা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ আসে তবে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ওপর অবর্ণনীয় চাপ নেমে আসতে পারে। এটি আমাদের উপমহাদেশের ইটভাটার শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য। অবাক বিষয়, বাংলাদেশের ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় ৫০ শতাংশ নাকি বন্ডেড লেবার বা ঋণ পরিশোধের বিনিময়ে ঋণদাতার জন্য কাজ করেন। এটা এক ধরনের ঋণদাসত্বের। এ তথ্য জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনীতি ব্যুরোর ৩২৮২৯ নম্বরযুক্ত ওয়ার্কিং পেপার থেকে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ট মিলার এবং আরও কয়েকজন মার্কিন সহ-গবেষক, বাংলাদেশের আইসিডিডিআর,বির চারজন এবং বুয়েটের একজন গবেষকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২০২৪ সালে ৩০০টি ইটভাটার ওপর এ গবেষণা চালান। রেন্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে এ গবেষণায়। পাঠকের হয়তো স্মরণে আছে, ২০১৯ সালে অর্থনীতির গবেষণায় এ পদ্ধতি অনুসরণ করে অভিজিৎ ব্যানার্জি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। একটি ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করতে গেলে, যেমন ধরুন ইটভাটা, সে ক্ষেত্রের সব প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণ করা দুষ্কর।
বাংলাদেশে ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী ৭ হাজার ৮৮১টি ভাটা রয়েছে। সব ভাটা পর্যবেক্ষণ দুরূহ। এই প্রতিবন্ধকতা জয় করার জন্য আরসিটি পদ্ধতি অনুসরণে মোট নমুনার ৫ শতাংশ বা তার বেশি নমুনা র্যান্ডম উপায়ে নির্বাচন করলে পুরো নমুনা সেটের প্রতিনিধিত্ব করা যেতে পারে। আরসিটি অনুসৃত এ গবেষণায় গ্র্যান্ট মিলার ও তাঁর সহ-গবেষকদের মূল লক্ষ্য ছিল ইটভাটার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার বৃদ্ধি করা যায় কিনা তার নিরীক্ষা। সে লক্ষ্যে গবেষণাটি বাংলাদেশের ইটশিল্পে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিক স্বার্থ নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছে। গবেষকরা বলছেন, নির্বাচিত ভাটাগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশে বন্ধন-শ্রমের খোঁজ মিলেছে; আর প্রায় ৭০ শতাংশে শিশুশ্রম লক্ষ্য করা গেছে।
বন্ডেড লেবার বন্দিদশার নানারূপে আরোপ করা হয়। এমন শ্রমকে আধুনিক দাসত্ব বলেও আখ্যায়িত করা হয়। উপমহাদেশ বিশেষত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই দাসত্বের সবচেয়ে পুরোনো ও প্রচলিত পন্থাকে দেনা পদ্ধতিও বলা হয়। এ পন্থায় ভাটার মালিক স্বল্পশিক্ষিত প্রান্তিক শ্রমিককে অগ্রিম মজুরি দিয়ে থাকেন। এর বিপরীতে থাকে সেই অগ্রিম মজুরি পরিশোধের অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা। মজুরি এতটাই স্বল্প ধার্য করা থাকে, এই অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করতে প্রায় সারাজীবন কেটে যায় শ্রমিকের। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রয়াণের পর তার সন্তানদের ওপর সেই দায় বা দেনার ভার বর্তায়।
বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকস্বার্থ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসেছে। এর মধ্যে ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইন ১৪ বছরের নিচের সব শিশুশ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সীদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমদান নিষিদ্ধ করেছে। ইটভাটায় কাজের পরিবেশ নিশ্চিতভাবে অস্বাস্থ্যকর। অথচ প্রায় ৭০ শতাংশ ভাটা শিশুশ্রম ব্যবহার করছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বন্ধন-শ্রমবিরোধী ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস প্রটোকল’-এ সম্মতি দিয়েছে এবং ২০২২ সালে বিশ্ব শ্রম সংস্থার ‘ফোর্সড লেবার কনভেনশনের ২০১৪-প্রটোকল’কে স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারের এসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ আমাদের প্রান্তিক শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে– এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে: ইটভাটার শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কতটুকু? শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই কি ভাটা বন্ধের এই আদেশ? যদি ভাটা শ্রমিকদের ঋণমুক্তি নিশ্চিত করা যায়; যদি তাদের অন্যত্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তবেই কেবল হাইকোর্টের এ আদেশ যুক্তিযুক্ত হবে।
বন্ধন-শ্রমের ভয়াল দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রয়াস আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে অব্যাহত। ভারতের তামিলনাড়ুতে ইটভাটার বন্ধন-শ্রমে আবদ্ধদের পুনর্বাসনে শ্রমিকদের মালিকানায় ভাটা তৈরি ও পরিচালনার পদক্ষেপ নিয়েছে রাজ্য সরকার। আবার পাকিস্তানে সংহতি সংস্থা ভাটা শ্রমিকদের বন্ধন-শ্রম পর্যালোচনা করেছে। সরকার আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছে তাদের ঋণের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে। বাংলাদেশের ইটভাটা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে তাই আওয়াজ তুলতে হবে আমাদের। পরিবেশ রক্ষা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সরকারের দায়িত্ব। তবে তা প্রান্তিক শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে নয়। এমন নির্দেশ অনুসরণে ভাটা মালিকদের দণ্ড দিতে গিয়ে যেন আমরা ভাটা শ্রমিকদের কথা ভুলে না যাই। ওদের শ্রমের ওপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের অট্টালিকাময় সভ্যতা।
নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব
টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও
পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ ইটভ ট র আম দ র পর ব শ সরক র র ওপর ন সরণ
এছাড়াও পড়ুন:
চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম সড়ক চালু ফ্রান্সে
জ্বালানিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ছে। তবে এসব গাড়ি বাসা বা নির্দিষ্ট স্থানেই শুধু চার্জ করা যায়। ফলে দূরে ভ্রমণের সময় গাড়ির চার্জ শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়েন অনেকেই। এ সমস্যা সমাধানে তারের সংযোগ ছাড়াই বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ওয়্যারলেস চার্জিং সড়ক’ চালু করেছে ফ্রান্স। প্যারিসের উপকণ্ঠে চালু হওয়া সড়কটিতে চলাচলের সময় বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক গাড়ি, বাস ও ভারী ট্রাকের ব্যাটারি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হয়ে যাবে।
বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করার জন্য সড়কটিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ২০০ কিলোওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। প্রয়োজনে সেটি ৩০০ কিলোওয়াট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যা টেসলার ভি থ্রি সুপারচার্জারের মতো বিশ্বের দ্রুততম চার্জারগুলোর সমান শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম। এই সড়কের নিচে স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য তামার কুণ্ডলী। এসব কুণ্ডলী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, যা বিশেষ রিসিভারযুক্ত বৈদ্যুতিক গাড়িতে শক্তি স্থানান্তর করে। পদ্ধতিটি অনেকটা ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তির মতো, যেখানে পাওয়ার ব্যাংক বা চার্জিং প্যাডে মোবাইল ফোন রেখে চার্জ নেওয়া হয়। চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ স্থানান্তর হওয়ায় ভারী বৃষ্টি, বরফ বা তুষারপাতেও চার্জিং প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। দ্রুত চার্জিং সুবিধার ফলে গাড়ি ও ট্রাক এখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে, মাঝপথে চার্জ নিতে থামার প্রয়োজন হবে না। ফলে গাড়িতে বড় ও ভারী ব্যাটারি বহনের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যাবে।
এরেনা ইভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই স্বয়ংক্রিয় চার্জিং সড়কে মাত্র কয়েক মিনিট চললেই বৈদ্যুতিক গাড়ির রেঞ্জ বা চলার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ির দীর্ঘ যাত্রায় চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সমাধানে প্রযুক্তিটি নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। প্রযুক্তিটি যদি ব্যাপকভাবে চালু করা যায়, তবে তুলনামূলকভাবে হালকা, সাশ্রয়ী এবং কম ব্যাটারিসমৃদ্ধ বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে গাড়ির উৎপাদন খরচও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রিওনের তৈরি সড়কটির নকশাতেও রয়েছে বাড়তি সুবিধা। বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করার প্রযুক্তি রাস্তার ভেতরের অংশে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কম। ফ্রান্সের পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশজুড়ে প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার ওয়্যারলেস চার্জিং সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে বৈদ্যুতিক যানবাহন চলাচল আরও সহজ, কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস