অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশ এখন অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। নানাবিধ সংস্কার, নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের চড়া আঁচ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসঙ্গের পাশাপাশি নারী অধিকারের বিষয়টিও নিয়ত মূলধারার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি, নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের নানা রকম নজিরের জের ধরে হওয়া এসব আলোচনা জন্ম দিচ্ছে একরাশ আশঙ্কার। আশঙ্কাগুলো আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশ কিছু বছরের মধ্যে প্রথমবার হ্রাস পাওয়ার খবর চোখে পড়ে।

গত বেশ কিছু বছর বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এই হার ছিল ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা এর পূর্ববর্তী জরিপ বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি ছিল। তবে গত দুই বছরের জরিপের তথ্য অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার কমছে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে যা ৩৬ দশমিক ৬১ শতাংশে এসে ঠেকেছে। ফলে শ্রমবাজারে নারীদের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে কার্যত ২০১৬ সালে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই ফিরে গেছি। শহরের নারীদের বেলায় এ চিত্র আরও সঙিন যেখানে ২০১০ সাল থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

নারীর সার্বিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি অপরিহার্য বিষয়। নারী যখন জীবিকা অর্জন করার সুযোগ তৈরি করতে পারেন এবং উপার্জিত অর্থ নিজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যয় করতে পারেন, তখন পরিবার ও সমাজে গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে নারী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তাঁর সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হয় এবং সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা ও নানা অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন তিনি। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু তাঁর একারই নয়, বরং পুরুষ, পরিবার ও সমগ্র সমাজের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা এগোলেও আমরা যে এখনো পাস নম্বর থেকে অনেক দূরে, সে কথা ‍অনস্বীকার্য। আমাদের দেশে শ্রমবাজারে নারীরা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, সেগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে গৃহস্থালির কাজ, সন্তান জন্মদান, লালন-পালনসহ পুনরুৎপাদনশীল কাজের দায়িত্ব, গুটিকয়েক পেশার বাইরে বিকল্পের অভাব, দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা, জনপরিসরে নারীর চলাচলের ওপর সামাজিক বিধিনিষেধ, হয়রানি ও নারী নির্যাতনের বিষয়গুলো অন্যতম।

এসব অন্তরায়ের সঙ্গে পুরুষতন্ত্র এবং সমাজে বিদ্যমান জেন্ডারসম্পর্কিত প্রথাগুলোর যে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, তা খানিকটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর ওপর পুরুষের অবস্থানের কারণে জীবিকা অর্জন ও নিজের উপার্জনের ওপর নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত হচ্ছেন যুগের পর যুগ, যা তাঁদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্রের অন্যায্য শর্তগুলো মেনে চলতে বাধ্য করায় ভূমিকা রাখছে। একই কারণে জীবিকার তাগিদে আন্দোলনরত নারীরা শুনছেন, ‘স্বামীর সংসার কর, এখানে আসছোস ক্যান?’

নারী অধিকারবিরোধী সর্বসাম্প্রতিক যেসব ঘটনা সামনে এসেছে, তার প্রতিটি পুরুষতন্ত্রের উগ্র চেহারার প্রতিচ্ছবি, যা নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক খাতে নারীর বিদ্যমান সংকুচিত পদচারণকে আরও খর্ব করার আশঙ্কা সৃষ্টি করবে। পুরুষতন্ত্রের এই বহিঃপ্রকাশ যে আগে ছিল না বা এগুলো যে একেবারেই নতুন, এমন কিন্তু নয়। কিন্তু অভ্যুত্থানকালীন নারীপুরুষ–নির্বিশেষের বৈষম্যহীন একটি দেশের প্রত্যাশার বিপরীতে নারী যখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হন, যেখানে তাঁদের অধিকারের লড়াইটা একটুও সহজ হয়নি, তখন দেশের তরুণ নাগরিক হিসেবে প্রচণ্ড হতাশা অনুভূত হয়।

এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে এবং নারী-পুরুষের সম–অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ যা নারী-পুরুষের অসম সামাজিক সম্পর্কের অবসান ঘটাবে। আর সে উদ্দেশ্যেই অধিকার আদায়ের প্রতিবাদের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে এই অসম সম্পর্কের অন্যায্যতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার উন্নয়ন। যদিও এ ধরনের উন্নত বোঝাপড়া নারীর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম, এই লেখায় শুধু অর্থনৈতিক দিকটির ওপরই নজর দিচ্ছি।

আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষ পরস্পরের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি যে জানেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। বিশেষ করে কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে, যে সময় মানুষ পরিবার, সমাজ ও কর্মজীবনে তাঁর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে সংবেদনশীল হওয়া শুরু করেন, সে সময় বিপরীত লিঙ্গের আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি জানার সুযোগ থাকে খুবই কম। ফলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীর অপরিহার্য ভূমিকা ও তাঁর কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে পুরুষ যেমন একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেন, তেমনি নারীও পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গড়া কঠোর, আগ্রাসী, কর্তৃত্ববাদী পুরুষের ছবি নিয়েই বড় হন।

ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষ ও নারী একে অপরের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত না হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান। কৈশোর থেকেই পুরুষ সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোয় নিজের উঁচু অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়ার পাশাপাশি টের পেতে থাকেন রোজগার করার চাপ। অতিরিক্ত কাজের চাপের জন্য অনেক পুরুষ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো থেকে বঞ্চিত হন, অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়েন। আর নারী হয় উৎপাদনশীল কাজে পুরুষের কর্তৃত্ব স্বীকার করে সমাজ, এমনকি নিজের কাছেও মূল্যহীন, ধন্যবাদহীন গৃহস্থালি কাজে মনোযোগ দেন অথবা প্রতিপক্ষ পুরুষের সঙ্গে জীবিকা অর্জনের এক অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হন। এভাবে পুরুষতন্ত্র নারী-পুরুষের মধ্যে তৈরি করে একটি অন্যায্য, দ্বান্দ্বিক ও অকল্যাণকর সম্পর্ক।

অথচ ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে পুরুষ যদি নারীর চোখে জীবন দেখার চেষ্টা করতে শেখেন, জীবিকা অর্জনে নারীদের সম্মুখীন হওয়া প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে অনুধাবন করতে শেখেন, তবে তার মা, বোন বা বন্ধুরা কোন পেশা বেছে নিতে চান, কোন কাজ করতে আগ্রহ বোধ করেন, সেগুলো জানার সুযোগ হয়তো তিনি পাবেন। নিজের জীবিকার স্বপ্নের সঙ্গে হয়তো তাদের স্বপ্নের মিল-অমিল খুঁজে নেবেন এবং অসম ব্যবস্থার যুক্তিহীনতা ধীরে ধীরে ধরতে পারবেন। নিজে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, কর্মক্ষেত্রকে হয়তো নারীবান্ধব করে তোলার চেষ্টা করবেন। হয়তো ঘরের কাজের মূল্যায়ন করতে শিখবেন এবং দায়িত্ব ভাগ করে নেবেন, সময় দিতে চেষ্টা করবেন পরিবারকে।

এ ক্ষেত্রে মীনা কার্টুনের একটি পর্বের কথা মনে পড়ে যেখানে এক দিনের জন্য নিজেদের কাজ অদলবদল করে মীনা ও রাজু উভয়েই পরস্পরের জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ পায় এবং আগের তুলনায় আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মীনার পরিবার ও সামাজিক সংগঠনগুলো যেমন এগিয়ে এসেছে, তেমনি আমাদেরও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে হবে।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নানাবিধ চাহিদা, জীবিকা অর্জনের বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আমাদের অকপট আলোচনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া উন্নয়নের পাশাপাশি দরকার ছেলে বা মেয়েসন্তানের আকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে সামাজিক বাধা-বিপত্তিগুলো উত্তরণে সাহায্য করা।

সামাজিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন যেমন বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দল, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতে নারী-পুরুষের অন্যায্য সম্পর্ক কেন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা গোটা সমাজের জন্য অকল্যাণকর, সে বিষয়ে জনমত সৃষ্টি করা জরুরি। রোকেয়া সাখাওয়াতের কথা ধার করে বললে, সমাজের অর্ধাঙ্গের অগ্রগতি ছাড়া আমাদের অগ্রসর হওয়া যে অসম্ভব, সামাজিকভাবে সেই বোধ গড়ে তোলা ও সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক।

আর এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে, তার বিভিন্ন নীতিমালা ও চর্চার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সহযোগী হওয়ার পথ সুগম করা। সে জন্য প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার বৈষম্যের বিষয়গুলো শুধু অন্তর্ভুক্ত না করে সেগুলোর পাঠদান নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের অঙ্গসংগঠনগুলোয় নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, যেন রাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো নারীকে তাঁর জীবিকার লড়াইকে বাধা না দিতে পারে, হেয় না করতে পারে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে নারী-পুরুষ উভয়ের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

সব সামাজিক সম্পর্কের মতোই নারী-পুরুষের বিদ্যমান অসম সম্পর্কের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটবে না। তবে নতুন বাংলাদেশকে যদি সত্যিই একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে অন্যান্য সম্পর্কের পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কেও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এই সম্পর্ককে গড়ে তুলতে প্রয়োজন শক্তিশালী, নিরলস সামাজিক আন্দোলন, যেখানে পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে নারী-পুরুষ একে অপরের সহযোগী হবে, প্রতিপক্ষ নয়।

জাহিদ নূর

পিএইচডি গবেষক, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সহযোগী, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন য য য আম দ র র অন য র জন র র জ বন র জন য পর ব র সহয গ র ওপর গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ 

কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি। 

এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। 

বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। 

দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়। 

মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন। 

বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।

শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের 

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ 

রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। 

প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে