প্রকল্পে নদীর নাম হয়েছে খাল পানি ছেড়ে চলে খননকাজ
Published: 15th, March 2025 GMT
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে নলেয়া নদীকে খাল দেখিয়ে খননের অভিযোগ উঠেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। পানি ছেড়ে দিয়ে খননকাজ করায় কাঙ্ক্ষিত ফলও পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযোগ উঠেছে, শুরুতে বাঁধ দিয়ে খনন হলেও অনিয়ম করতে পরে ইচ্ছাকৃতভাবে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। এক্সক্যাভেটর দিয়ে সামান্য মাটি কেটে পারে অপরিকল্পিতভাবে রাখায় বর্ষায় ভেঙে নদী ভরাট হবে বলে জানান তারা।
এ মাটি আবাদি জমিতে পড়বে জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীর তলদেশ ৬ থেকে ৭ ফুট গভীর করার কথা। পানি থাকায় তা আর বোঝার উপায় নেই। দুই পার অপরিকল্পিতভাবে প্রশস্ত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের। এভাবে নদীকে খাল দেখিয়ে খননের বিষয়ে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলছেন, নদীর পানি ব্যবস্থাপনার কাজ করে পাউবো ও বিআইডব্লিউটিএ। খাল দেখিয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ কেন কাজ করেছে, তা বোধগম্য নয়। জেলার তালিকাভুক্ত ২৩ নদীর একটি নলেয়া। খাল বললে এর পরিচয় বিপন্ন হবে।
খাল খননে নিয়ম মানা হয়নি বলে অভিযোগ কুঞ্জ মহিপুর গ্রামের কৃষক মোতালেব মিয়ার। তিনি বলেন, শুরুতে বাঁধ দেওয়া ছিল। মাটি কাটা শুরুর এক ঘণ্টা পর বাঁধ কেটে দিয়েছে। এখন মাঝের মাটি কাটা লাগবে না। কোনোরকম কাজ শেষ করে চলে যাবে। এভাবে কাজ করলে সরকারের কোটি টাকা গচ্চা যাবে। কৃষকের উপকারে আসবে না।
জানা গেছে, ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলে সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআরপি) আওতায় সাদুল্লাপুরে খাল খননের কাজ হাতে নেয় কর্তৃপক্ষ। নলেয়া নদীর ফরিদপুর ইউনিয়নের মহেষপুর মাঝিপাড়া থেকে শুরু করে ইদিলপুর ইউনিয়নের কুঞ্জ মহিপুর সেতু পর্যন্ত প্রায় ৯ দশমিক ৯৫০ কিলোমিটার খননে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি টাকা। কাজটি পায় ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
কাজ শুরুর আদেশ দেওয়া হয় গত বছরের ২ ডিসেম্বর। ৪৫ দিনের মধ্যে শেষ করার কথা বলা হলেও চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ হয়। সরেজমিন দেখা যায়, কুঞ্জ মহিপুর এলাকায় কাজ করছিল একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সড়কের পাশে একসঙ্গে পাঁচটি এক্সক্যাভেটর দিয়ে খননকাজ চলছিল। উজান থেকে আসা পানিতে ভরে ছিল নদী। জায়গাটিতে সদ্য পানি ছেড়ে দিয়ে কাজ শুরুর বিষয়টি স্পষ্ট। পানির মধ্যেই মাটি কাটা হচ্ছিল। ভেজা, কাদামাটি যত্রতত্র রাখা হচ্ছিল পাড়ে।
কাজ শেষ করা কিছু স্থানে গিয়ে দেখা মিলেছে এমন চিত্র। পার কোথাও সরু, কোথাও প্রশস্ত। কিছু জায়গা অগভীর। অমসৃণ পারে হেঁটে যাওয়াও মুশকিল। কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলছিলেন, পানি ছেড়ে দিয়ে কাজ করছেন ঠিকাদার। কোথায় কতটুকু গভীর করছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। লোকদেখানো কাজ করে বিল নিয়ে চলে যাবেন ঠিকাদার।
এলাকার কৃষক পানি সংকটে আছেন জানিয়ে কুরবান আলী বলেন, তাঁর ৭০ শতাংশ জমির মধ্যে অর্ধেক নদীতে পড়েছে। সবার স্বার্থে তিনি জমি ছেড়ে দিয়েছেন। তার পরও পানি ছেড়ে দিয়ে খনন করবে কেন? দুই পারের অনেক জায়গায় দূরত্ব কম। এভাবে তো খনন ঠিক হবে না। কৃষকের পানির জন্যই তো সরকার এত টাকা ব্যয় করছে।
সালাম মিয়াসহ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, খননকাজে চালাকি করা হচ্ছে। পানির মধ্যে কিছু দেখা যায় না। অনুমান করে পার খুঁড়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের কাজ ঠিকভাবে হয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
পানিপ্রবাহ বন্ধ রেখে শুকনো অবস্থায় খাল বা নদী খননে নিয়ম রয়েছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর ভাষ্য, পানি ছেড়ে দিলে তলদেশের কোথায় কতটুকু খনন করা হচ্ছে, তা বোঝা যাবে না। তাঁর প্রশ্ন, খননকাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড; বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ কেন?
১২ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি নওগাঁর এনায়েতপুরের মেসার্স খান ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির দুটি আইডির বিপরীতে কাজ করেছেন মসলেম ও আইয়ুব আলী নামের দুই ঠিকাদার। তারা শতভাগ কাজ শেষ করেছেন। অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমাদের ১ হাজার ২০০ মিটার অংশে বাঁধ দিয়ে শুকনো অবস্থায় খনন করেছি। এ ধরনের অনিয়ম আমাদের অংশে হয়নি।’
নওগাঁর আরেক ঠিকাদার আব্দুল মজিদ দুই আইডিতে ১ হাজার ৬০০ মিটার অংশের কাজ শেষ করেছেন। তাঁর হয়ে কাজ করেছেন সাজু ও মজিদ নামের দুই ঠিকাদার। সাজুর ভাষ্য, পানি ছেড়ে দিয়েও কাজ করা যায়।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাইবান্ধা রিজিয়নের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পানি ছেড়ে দিয়ে খনন করা ঠিক হয়নি। ঠিকাদারকে মেজারমেন্ট অনুযায়ী কাজ করতে বলেছি। প্রয়োজনে প্রতিটি জায়গায় মেপে নেব। পানি ছেড়ে কাজ করার বিষয়ে জবাব চাওয়া হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক জ শ ষ কর বর ন দ র খননক জ কর ছ ন ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ফুলবাড়ী চা বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১ নম্বর গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের আশপাশের গাছপালা, মারা যায় বহু পশুপাখি। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা বাগান, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ প্রতিবেশ ও ভূমিস্থ পানিসম্পদ। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে। অথচ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কূপ খননকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। উল্টো নিজেদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার বীমার টাকা তুলে ভেগেছে অক্সিডেন্টাল।
১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। অনুসন্ধান শুরুর পর তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা– এই ভেবে কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজারের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তেল-গ্যাসের সন্ধানে ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খননের লক্ষ্য নিয়ে কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ৮৪০ মিটার খননের পরই ঘটে দুর্ঘটনা। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রিসহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস।
বিভিন্ন সময় তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়; যার দাম ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতি ছিল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। ওই ঘটনার সরকারি তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ধারণা করা হয়, আগুনের কারণে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলপথও ধ্বংস হয়। এতে রাজস্ব ছাড়া ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়কপথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজগুলোতে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি হয় ১২ লাখ টাকা।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর জ্বলতে থাকা কূপের উৎস মুখ বন্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয় পরের বছর ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এতে দেশজুড়ে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা এক মাসের মধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে সেই সময়ই অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। অথচ যে অক্সিডেন্টালের কারণে এত বড় ক্ষতি হলো, তাদের কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ কমলগঞ্জে মানববন্ধন করবে পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবি জানিয়েছে তারা।