ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিজয় ও মানবতার চূড়ান্ত বিজয় সংঘটিত হয় অষ্টম হিজরির ১৯ রমজান। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমনের পর দ্বিতীয় হিজরিতে কুরাইশরা মদিনা আক্রমণ করে। পরে সংঘটিত হয় বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কুরাইশরা চরমভাবে পরাজিত হলেও পরের বছর তৃতীয় হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) শনিবার তারা আবার মদিনা আক্রমণ করে। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওহুদের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সাহাবিরা নবীজি (সা.

)–এর নির্দেশনা ভুলে যাওয়ার কারণে মুসলমানদের পরাজয় হয়।

এরপর ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) ওমরাহর উদ্দেশ্যে দেড় হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কার দিকে রওনা হন। কুরাইশরা বাধা দিলে নবীজি (সা.) হুদায়বিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। সেখানেই সম্পাদিত হয় ইতিহাসখ্যাত ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’, যা বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি।

১৯ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘কাউকে আক্রমণ করবে না।’ এভাবে জানের দুশমনদের প্রাণের দোসর বানিয়ে মানবসভ্যতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মক্কার ‘বনু খোজায়া’ গোত্র হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সঙ্গে ও ‘বনু বকর’ গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। কুরাইশদের প্ররোচনায় ‘বনু বকর’ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে ‘বনু খোজায়া’ গোত্রের আবাসভূমি ‘ওয়াতির’–এর নিভৃত পল্লিতে হামলায় অসহায় নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন করে।

প্রাণভয়ে পবিত্র কাবাঘরে আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষকেও তারা হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিকারের জন্য খোজায়া সম্প্রদায় মদিনার মিত্র মুসলমানদের সহযোগিতা চায়।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই অপকর্মের প্রতিকারের জন্য দূত মারফত মক্কার কুরাইশ নেতাদের বলেন, ‘তোমরা বনি খোজায়া গোত্রকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাও, নয়তো বনু বকর গোত্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাতিল করো; না হলে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হেতু এ চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।’ কুরাইশ নেতারা তৃতীয় পন্থাই গ্রহণ করল এবং চুক্তি বাতিল করল। বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা মুকাররমাকে পঙ্কিলতামুক্ত করার জন্য অষ্টম হিজরিতে বিশ্বনবী নীরব আয়োজন করলেন।

১০ রমজানে ১০ হাজার সাহাবিসহ হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে অভিযাত্রা শুরু করেন। মক্কার উপকণ্ঠে এসে ‘মাওয়ারাউজ জাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করলেন।

১৯ রমজান রাতে আবু সুফিয়ান হাকিম ইবনে নিজাম ও বুদাইলকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলে হজরত উমর (রা.)–এর নেতৃত্বে টহলরত ছদ্মবেশী গেরিলা সাহাবিরা তাঁদের বন্দী করেন এবং তাঁদের নবীজি (সা.)–এর কাছে নিয়ে আসেন।

দীর্ঘ ২১ বছরের নিষ্ঠুরতার গুরু আবু সুফিয়ানকে রহমতের নবী (সা.) প্রেম–ভালোবাসার দীক্ষা দিলেন। পাষাণহৃদয় দয়ার সাগরে স্নাত হলো; আবু সুফিয়ান ইমান আনলেন।

প্রিয় নবী (সা.) মক্কা জয়ের আগেই মক্কাবাসীদের মন জয় করে বড় বিজয় অর্জন মনে করলেন। এ সময় নবীজির চাচা হজরত আব্বাস (রা.), যিনি কৌশলগত কারণে মক্কাবাসীদের কাছে তাঁর ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখে ছিলেন, তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণ প্রকাশ করলেন।

প্রভাতে এ উভয় কুরাইশ নেতাকে নবীজি (সা.) শান্তির পয়গাম ঘোষণার জন্য মক্কায় পাঠালেন এবং ঘোষণা দিতে বললেন, ‘যারা কাবাগৃহে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ। যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে বা তার নাম বলবে, তারা নিরাপদ। যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, তারাও নিরাপদ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

১৯ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘কাউকে আক্রমণ করবে না।’ এভাবে জানের দুশমনদের প্রাণের দোসর বানিয়ে মানবসভ্যতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত ওসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে উটে চড়ে অবনত মাথায় সবার শেষে মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ করলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবাসীদের নিয়ে একটি সভা করলেন। সভায় ভাষণে তিনি সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন, ‘হে কুরাইশরা! অতীতের সব ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো, কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সবাই এক হও। সব মানুষ সমান, এ কথা বিশ্বাস করো।’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সবাইকে এক নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের গোত্রে ও সম্প্রদায়ে পৃথক করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে–ই বেশি সম্মানিত, যে বেশি পরহেজগার।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক র ইশর র জন য বলল ন করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

দোয়ার ফজিলত ও আদব

দোয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ আহ্বান করা বা প্রার্থনা করা। পরিভাষায় দোয়া হলো কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার রোধে মহান আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।

প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘দোয়াই ইবাদত।’ (বুখারি ও মুসলিম) ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কিছু চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি: ৩৩৭৩)

আল–কোরআনের বর্ণনা, ‘আর তোমাদের রব বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬০)

মুমিনের পরিচয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার কৃতকর্মের জন্য তাদের কী কী চোখজুড়ানো প্রতিদান লুকায়িত আছে।’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ১৬-১৭)

‘আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ইমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৬)

দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১)

দোয়া ও আমল কবুল হওয়ার মূল শর্ত হলো ইখলাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। অতএব, তাঁকে ডাকো খাঁটি ইবাদতের মাধ্যমে।’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬৬)

দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎ কাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১) ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পাক পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রিজিক হিসেবে দান করেছি।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৭৩)

নবীজি (সা.) বলেন, ‘উষ্কখুষ্ক ধুলায় ধূসরিত অবস্থায় দীর্ঘ সফরকারী একজন যে স্বীয় দুই হাত আকাশের দিকে প্রসারিত করে বলে, “হে প্রভু! হে প্রভু!” অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম দ্বারা লালিত, তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১৬৮৬)

নির্জনে নীরবে বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো কাকুতি মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫)। পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তাকে আহ্বান করো ভয় ও আশাসহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫-৫৬)

দোয়ার আদব হলো দৃঢ়সংকল্প ও আকুতির সঙ্গে দোয়া করা, দোয়া কবুলে প্রবল আশাবাদী হওয়া।

হজরত জাকারিয়া (আ.) তাঁর দোয়ায় বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার কাছে দোয়া করে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪) হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন, ‘আশা করি, আমার প্রতিপালকের নিকট দোয়া করে আমি বিফল হব না।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪৮)

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দোয়ার ফজিলত ও আদব