মক্কা বিজয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিধন্য রমজান
Published: 20th, March 2025 GMT
ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিজয় ও মানবতার চূড়ান্ত বিজয় সংঘটিত হয় অষ্টম হিজরির ১৯ রমজান। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমনের পর দ্বিতীয় হিজরিতে কুরাইশরা মদিনা আক্রমণ করে। পরে সংঘটিত হয় বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কুরাইশরা চরমভাবে পরাজিত হলেও পরের বছর তৃতীয় হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) শনিবার তারা আবার মদিনা আক্রমণ করে। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওহুদের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সাহাবিরা নবীজি (সা.
এরপর ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) ওমরাহর উদ্দেশ্যে দেড় হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কার দিকে রওনা হন। কুরাইশরা বাধা দিলে নবীজি (সা.) হুদায়বিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। সেখানেই সম্পাদিত হয় ইতিহাসখ্যাত ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’, যা বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি।
১৯ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘কাউকে আক্রমণ করবে না।’ এভাবে জানের দুশমনদের প্রাণের দোসর বানিয়ে মানবসভ্যতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মক্কার ‘বনু খোজায়া’ গোত্র হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সঙ্গে ও ‘বনু বকর’ গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। কুরাইশদের প্ররোচনায় ‘বনু বকর’ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে ‘বনু খোজায়া’ গোত্রের আবাসভূমি ‘ওয়াতির’–এর নিভৃত পল্লিতে হামলায় অসহায় নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন করে।
প্রাণভয়ে পবিত্র কাবাঘরে আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষকেও তারা হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিকারের জন্য খোজায়া সম্প্রদায় মদিনার মিত্র মুসলমানদের সহযোগিতা চায়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই অপকর্মের প্রতিকারের জন্য দূত মারফত মক্কার কুরাইশ নেতাদের বলেন, ‘তোমরা বনি খোজায়া গোত্রকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাও, নয়তো বনু বকর গোত্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাতিল করো; না হলে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হেতু এ চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।’ কুরাইশ নেতারা তৃতীয় পন্থাই গ্রহণ করল এবং চুক্তি বাতিল করল। বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা মুকাররমাকে পঙ্কিলতামুক্ত করার জন্য অষ্টম হিজরিতে বিশ্বনবী নীরব আয়োজন করলেন।
১০ রমজানে ১০ হাজার সাহাবিসহ হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে অভিযাত্রা শুরু করেন। মক্কার উপকণ্ঠে এসে ‘মাওয়ারাউজ জাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করলেন।
১৯ রমজান রাতে আবু সুফিয়ান হাকিম ইবনে নিজাম ও বুদাইলকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলে হজরত উমর (রা.)–এর নেতৃত্বে টহলরত ছদ্মবেশী গেরিলা সাহাবিরা তাঁদের বন্দী করেন এবং তাঁদের নবীজি (সা.)–এর কাছে নিয়ে আসেন।
দীর্ঘ ২১ বছরের নিষ্ঠুরতার গুরু আবু সুফিয়ানকে রহমতের নবী (সা.) প্রেম–ভালোবাসার দীক্ষা দিলেন। পাষাণহৃদয় দয়ার সাগরে স্নাত হলো; আবু সুফিয়ান ইমান আনলেন।
প্রিয় নবী (সা.) মক্কা জয়ের আগেই মক্কাবাসীদের মন জয় করে বড় বিজয় অর্জন মনে করলেন। এ সময় নবীজির চাচা হজরত আব্বাস (রা.), যিনি কৌশলগত কারণে মক্কাবাসীদের কাছে তাঁর ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখে ছিলেন, তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণ প্রকাশ করলেন।
প্রভাতে এ উভয় কুরাইশ নেতাকে নবীজি (সা.) শান্তির পয়গাম ঘোষণার জন্য মক্কায় পাঠালেন এবং ঘোষণা দিতে বললেন, ‘যারা কাবাগৃহে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ। যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে বা তার নাম বলবে, তারা নিরাপদ। যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, তারাও নিরাপদ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
১৯ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘কাউকে আক্রমণ করবে না।’ এভাবে জানের দুশমনদের প্রাণের দোসর বানিয়ে মানবসভ্যতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত ওসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে উটে চড়ে অবনত মাথায় সবার শেষে মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ করলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবাসীদের নিয়ে একটি সভা করলেন। সভায় ভাষণে তিনি সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন, ‘হে কুরাইশরা! অতীতের সব ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো, কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সবাই এক হও। সব মানুষ সমান, এ কথা বিশ্বাস করো।’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সবাইকে এক নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের গোত্রে ও সম্প্রদায়ে পৃথক করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে–ই বেশি সম্মানিত, যে বেশি পরহেজগার।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র ইশর র জন য বলল ন করল ন
এছাড়াও পড়ুন:
মদিনায় রয়েছে বেহেশতের বাগান
মদিনার পূর্ব নাম ইয়াসরিব। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর এই শহরের নাম হয় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। মদিনা হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আশ্রয়ভূমি; প্রেম, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্থান এবং সত্যনিষ্ঠার পুণ্যময় কর্মক্ষেত্র। এটি নবীজি (সা.)-এর শহর, শান্তির নগর। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে আমার রওজা জিয়ারত করল, তার জন্য আমার সাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (দারুকুতনি: ২৬৯৫; বায়হাকি: ৩৮৬২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে হজ করল, কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি জুলুম করল।’ (দারুকুতনি, পৃষ্ঠা: ২৭২) ফকিহদের মতে, মদিনা শরিফ জিয়ারত করা সুন্নত। আল্লামা ইউসুফ ইসলাহি (রহ.) বলেন, ‘হাজি সাহেবদের জন্য রওজা শরিফ জিয়ারত করা ওয়াজিব।’ (আসান ফিকাহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৫০)
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে এবং কোনো নামাজ কাজা করেনি, সে নিফাক এবং দোজখের আজাব থেকে মুক্ত।’ (তাবরানি, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৩২৫, হাদিস: ৫৪৪৪ ও তিরমিজি: ২০০)। তিনি আরও বলেন, ‘মসজিদে নববিতে এক রাকাত নামাজ পড়লে তার সওয়াব ৫০ হাজার রাকাত নামাজের সমান।’ (ইবনে মাজাহ: ৭৫২)
রওজা শরিফ এবং এর পশ্চিম দিকে নবীজি (সা.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্বল্প পরিসর স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান বলা হয়মসজিদে নববির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ, যা হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরার মধ্যে অবস্থিত। এই রওজার পাশে হজরত আবু বকর (রা.) এবং তাঁর পাশেই হজরত ওমর (রা.)-এর মাজার অবস্থিত। এখানে আরেকটি কবরের স্থান খালি রাখা হয়েছে, যেখানে হজরত ঈসা (আ.)-এর দাফন হবে বলে বর্ণিত আছে।
রওজা শরিফ এবং এর পশ্চিম দিকে নবীজি (সা.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্বল্প পরিসর স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান বলা হয়। এই স্থান আলাদা রঙের (ধূসর সাদাটে) কার্পেট দ্বারা চিহ্নিত থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে জান্নাতের একটি বাগান রয়েছে।’ (বুখারি: ১১৯৬, মুসলিম: ১৩৯১)
মসজিদে নববির পূর্ব দিকে অবস্থিত গোরস্থানকে জান্নাতুল বাকি বলা হয়, যেখানে অসংখ্য সাহাবি, আউলিয়া, বুজুর্গ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কবর রয়েছে।
মদিনার উত্তর-পূর্ব দিকে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড় ও ওহুদের প্রান্তর অবস্থিত, যা মসজিদে নববি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। এখানে হজরত হামজা (রা.)-সহ ৭০ জন সাহাবি শহীদ হন। এখানেই কাফেররা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহীদ করেন। এখানে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা রয়েছে।
কিবলাতাইন মসজিদ: হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মসজিদ থেকে তৎকালীন কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে জোহরের নামাজ পড়ার সময় নবীজি (সা.)–এর কাছে ওহি নাজিল হয় যে ‘তুমি এখনই এই অবস্থায় কাবার দিকে কিবলা করে নামাজ সমাধা করো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
কুবা মসজিদ: এটি ইসলামের প্রথম মসজিদ। এটি রাসুলে করিম (সা.)–এর নিজ হাতে তৈরি। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসার পরই মসজিদে কুবার সম্মান। এখানে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লে এক ওমরাহর সওয়াব হয়।
খন্দক প্রান্তরের পাশে অতি অল্প পরিসর স্থানের মধ্যে পাশাপাশি ছয়টি মসজিদ আছে। এগুলো হচ্ছে মসজিদে ফাতাহ, মসজিদে সালমান ফারসি (রা.), মসজিদে আবু বকর সিদ্দিক (রা.), মসজিদে ওমর (রা.), মসজিদে আলী (রা.), মসজিদে ফাতিমা (রা.)।
রাসুল করিম (সা.) প্রথম জুমা বনি ছালেমের মহল্লায় এই মসজিদে পড়েন। এই মসজিদকে ‘মাসজিদে জুমুআ’ বলা হয়।
মাসজিদে গামামা: গামামা অর্থ মেঘ। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই মসজিদে ঈদের জামাতে ইমামতি করতেন এবং একসময় বৃষ্টির জন্য ‘ইসতিসকার’ নামাজ পড়েছিলেন।
বদর প্রান্তর: এখানে ইসলামের বিজয়সূচক প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৪ জন সাহাবি এতে শাহাদাতবরণ করেন। এখানে শহীদদের কবর রয়েছে।
মসজিদে সাকিয়া: বদরের যুদ্ধের সময় রাসুল (সা.) এই মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন এবং মদিনাবাসীর জন্য দোয়া করেছিলেন।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]