বিএনপির ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ আশঙ্কা কেন?
Published: 20th, March 2025 GMT
এক-এগারোর সময়কার মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা হচ্ছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জেতার জন্য বিএনপির যত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তত বেশি বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করা হচ্ছে (সমকাল অনলাইন, ১৭ মার্চ ২০২৫)।
কথা হচ্ছে, মিডিয়া ট্রায়াল আসলে কী? এটি কীভাবে কাজ করে? সহজ ভাষায় বলতে গেলে, প্রচলিত আদালতের বাইরে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করাকে মিডিয়া ট্রায়াল বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে, এমন কোনো বেআইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যা কোনো ব্যক্তির জীবন, সুনাম এবং সম্পত্তির ক্ষতির কারণ হয়। এ ছাড়াও দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলা যাবে না।
দুনিয়াজুড়েই প্রচলিত আদালতের রীতি হচ্ছে, বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় তৈরি করা। একজন বিচারক এই রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম ও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম সঠিক কারণ প্রকাশ না করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে একতরফা দোষারোপ করতে পারে। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বা রীতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় না, যা সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচারের নীতি লঙ্ঘন করে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে। আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে। বিপরীত পক্ষের বানোয়াট যুক্তি দিয়ে কোনো ব্যক্তির বিচার করা যায় না। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে এই সুযোগ থাকে না। ফলে একজন ব্যক্তি শুধু তাঁর মর্যাদাই হারান না; মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হন। যদি সেটি দলগত অবস্থান হয়, তাহলে তারাও প্রতিপক্ষের তুলনায় পিছিয়ে পড়েন।
বিএনপির শীর্ষ নেতার আশঙ্কা, বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপির এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে চাইলে আমরা ২০০৭ সালের দিকে ফিরে তাকাতে পারি। সেই সময়ে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়ে দলটি ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়েছিল। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ কোনো ধরনের মামলা ছাড়াই তৎকালীন সেনা সমর্থিত মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের ওয়ান-ইলেভেনের সরকার জরুরি বিধিমালায় তারেক রমহানকে গ্রেপ্তার করেছিল। তার পর থেকেই তারেক রহমানের চরিত্র হননে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। লক্ষণীয়, সেই আমলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরে টাস্কফোর্স, এনবিআর, দুদকসহ সরকারের সব সংস্থা অনুসন্ধান করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অথবা অবৈধ সম্পদ অর্জনের কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু তারেক রহমানকে ‘টেন পার্সেন্ট’ বা ‘খাম্বা তারেক’ প্রভৃতি নেতিবাচক বিশেষণে হাজির করা হয়েছিল। ২০ মার্চ ২০২৫, বৃহস্পতিবার সব মামলা থেকে বিচারিক খালাস পেয়েছেন তিনি।
আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিতে না পারি, মিডিয়া ট্রায়ালের অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় না আনা যায়, তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সহজ হবে না। এটি কেবল একটি দলের প্রতি ঘটানো অবিচার নয়; পুরো দেশের বিচার ব্যবস্থার একটি চিত্র।
এখন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, মিডিয়া ট্রায়াল কেন হয়? উত্তর হচ্ছে, বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা ও ক্ষেত্রেবিশেষে আস্থাহীনতার জন্যই এমনটা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় একজন মানুষের আজীবনের অর্জিত সুনাম ভূলুণ্ঠিত হতে পারে। এর মাধ্যমে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও ছন্দপতন ঘটে। বিঘ্নিত হয় ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের দর্প চূর্ণ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলেছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির যে বদল ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। এখন এটা নিশ্চিত করা দরকার, বিচারিক প্রক্রিয়া প্রভাবমুক্ত থাকবে। সারা দুনিয়াতেই সংবাদমাধ্যমকে নানাভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। সংবাদমাধ্যমের একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে জনমত তৈরি। অর্থাৎ সম্মতি উৎপাদন। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের লক্ষ্য হচ্ছে, অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ সুরক্ষাও দেওয়া। অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে কোনো প্রকার সামাজিক বা মিডিয়ার বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না।
একটি ব্রিটিশ প্রবাদ রয়েছে। যার বাংলা অনেকটা এমন– তুমি যদি কোনো কুকুরকে হত্যা করতে চাও তাহলে তার একটা খারাপ নাম দাও। অর্থাৎ কাউকে হত্যা বা ধ্বংস করতে চাইলে তাকে একটা ঘৃণিত নাম দিতে হবে। তারপর তুমি তাকে ধ্বংস করতে পারো।
‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হচ্ছে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতিও এক ধরনের হুমকি। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার আগেই বিচারকাজকে প্রভাবিত কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে সংস্কার। যদি আমরা সত্যিকারের সংস্কার চাই, তাহলে প্রত্যাশার পাশাপাশি প্রতিজ্ঞাও থাকতে হবে– রাজনৈতিক মত যা-ই থাকুক না কেন, প্রতিপক্ষকে মিডিয়া ট্রায়ালের দিকে ঠেলে দেব না। যেহেতু মিডিয়া সর্বগ্রাসী; এটি কখন কার দিকে তাক হবে– এমন ঝুঁকি থেকেই যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, যে কোনো মিডিয়া ট্রায়ালকে না বলা।
বিএনপি কেন মিডিয়া ট্রায়ালের ভয়ে ভীত হচ্ছে, তার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। দলটির সামনে এখন রাজনৈতিক বড় ধরনের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। এমন বাস্তবতায় নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের অসংগতি যদি সংবাদমাধ্যমের বরাতে ছড়িয়ে পড়ে, সেটি দলটির জন্য সুখকর হবে না। এমন আশঙ্কা থেকেই বিএনপি অতীতের ঘটনা সামনে টেনে আনার মধ্য দিয়ে দলটির নেতাকর্মীকে সাবধান করতে চাইতে পারে। তবে শেষ কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দল এবং সংবাদমাধ্যম যদি নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে, সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথ বাধাগ্রস্ত করবে। সেটা গণতন্ত্রকামী কারও কাম্য হতে পারে না।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ ত র ক রহম ন র জন ত ক প রচল ত ব এনপ র র জন য সরক র অপর ধ দলট র ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত, সচিব কমিটি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাবে
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে অধ্যাদেশের খসড়াটি সচিব কমিটির মাধ্যমে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের জন্য যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রমের খসড়া তৈরি করেছে।
খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন। সদস্য থাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ; গ্রেড-২ পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা; অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা; পুলিশ একাডেমির একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ; আইন, অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ের একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; ১৫ বছর অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন একজন মানবাধিকারকর্মী।
আরও পড়ুনপুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন কমিশন অপরিহার্য৮ ঘণ্টা আগেকমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন।কমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন। সদস্যরা যোগদানের দিন থেকে চার বছর নিজ নিজ পদে থাকবেন। মেয়াদ শেষে কোনো সদস্য আবার নিয়োগের যোগ্য হবেন না।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বলা হয়েছে—এই কমিশন যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সত্তাকে কোনো নির্দেশ দিলে উক্ত কর্তৃপক্ষ বা সত্তা অনধিক তিন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। তবে কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো অসুবিধা হলে সে ক্ষেত্রে নির্দেশ বা সুপারিশ পাওয়ার অনধিক তিন মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। কমিশন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে যে নির্দেশ বা সুপারিশ পাঠাবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশ বা সুপারিশ কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করে কমিশনকে জানাতে হবে।
আরও পড়ুনকোনো দল নয়, পুলিশের আনুগত্য থাকবে আইন ও দেশের প্রতি৯ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।এই কমিশনের সদস্য পদে নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য সাত সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রধান বিচারপতির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মনোনীত একজন সরকারদলীয় এবং একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যকে বাছাই কমিটিতে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম হওয়া ও বাছাই কমিটির বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে খসড়া প্রস্তাবে।
আরও পড়ুন‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা১৭ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ খসড়ায় কমিশন প্রতিষ্ঠা, কার্যালয়, সদস্যদের নিয়োগ, মেয়াদ, কমিশনের সদস্য হওয়ার জন্য কারা অযোগ্য, সদস্যদের পদত্যাগ, অপসারণ, পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধি, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, নাগরিকের অভিযোগ অনুসন্ধান-নিষ্পত্তি, পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসন, পুলিশপ্রধান নিয়োগ, আইন-বিধি, নীতিমালা প্রণয়ন ও গবেষণা বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুনমাঝেমধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কি আমাদের লোক’: আইজিপি১৭ ঘণ্টা আগে