আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলির মধ্যে নাগরিকের সর্বাপেক্ষা নিকটে থাকে বলিয়া পুলিশের জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও সর্বাধিক। বর্তমানে এহেন কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়িয়াছে বলিয়াই প্রতীয়মান। রবিবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশের জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়িয়াছে। আমরা বিস্মিত, গত বৎসর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভাঙিয়া পড়া পুলিশি ব্যবস্থা স্বাভাবিক হইতে যথায় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম বৃদ্ধি জরুরি ছিল, ততায় উহা বন্ধ রহিয়াছে! পুলিশের সহিত জনগণের দূরত্ব বৃদ্ধির কারণেই যে আইন প্রয়োগ করিতে গিয়া বাহিনীটিকে বারংবার বাধার মুখে পড়িতে হইতেছে– উহা অস্বীকার করা যাইবে না।
আমরা জানি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহিত পুলিশের সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়া আস্থার সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ কিংবা ‘বিট পুলিশিং’ প্রবর্তিত হইয়াছিল। জনসাধারণের সহিত মতবিনিময়ে সূচিত হইয়াছিল ‘ওপেন হাউস ডে’। কিন্তু পূর্বের শাসনামলে স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী ও সক্রিয় অনেকে অনুপস্থিত কিংবা নিষ্ক্রিয় হইবার কারণে এই সকল কার্যক্রমে ভাটা পড়িয়াছে। আমরা মনে করি, এই সকল কার্যক্রম অবিলম্বে সূচিত হওয়া জরুরি। বরং পূর্বাপেক্ষা অধিক হারে চালাইবার বিকল্প নাই। পুলিশের বিদ্যমান সংকটময় সময়ে এই ধরনের কার্যক্রম যত বৃদ্ধি পাইবে, মানুষের সহিত ততোধিক সম্পর্ক তৈয়ার হইবে। ইহাতে যদ্রূপ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হইবে, তদ্রূপ অঞ্চলভিত্তিক অপরাধীরাও ভীত থাকিবে। সর্বোপরি পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর হইবে।
আমরা দেখিয়াছি, রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ও আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তৎসহিত বেসরকারি কর্মীদিগের ‘অক্সিলারি ফোর্স’ তথা সহযোগী বাহিনীরূপে নিয়োগের কথা জানাইয়াছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ। এই সিদ্ধান্ত খুব বেশি সাড়া না ফেলিলেও কিছুদিন ধরিয়া ‘সিটিজেন ফোরাম’ গড়িয়া স্থানীয় বাসিন্দাদের সহিত সম্পর্কের ভিত তৈয়ারের চেষ্টা করিতেছে পুলিশ। উহাকে আমরা স্বাগত জানাই।
আমরা দেখিয়াছি, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেও ছাত্রদিগের সমন্বয়ে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ রহিয়াছে। কারণ যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশেই ছাত্রদিগের মাধ্যমে কমিউনিটি পুলিশিং পদ্ধতি প্রচলিত। পূর্বে কমিউনিটি পুলিশিং শুধু অপরাধ দমনের কৌশলরূপে সীমাবদ্ধ রাখা হইত। ইহার সহিত অফিস ও বাড়িতে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদিগের পদ্ধতিগত কাঠামোর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত কার্যে যুক্ত করিলে নিরাপত্তা সুসংহত হইতে পারে। দেশে যেই গ্রাম আদালত ও চৌকিদারি ব্যবস্থা বিদ্যমান, উহাকে যথাযথরূপে কার্যকর করিলে অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহযোগী ভূমিকা পালন করিতে পারে। এই ক্ষেত্রে কমিশন কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দের যেই পরামর্শ দিয়াছে, উহা যথাযথ।
অবশ্য স্মরণে রাখিতে হইবে, ইতোপূর্বে পুলিশকে যেইভাবে দলীয়করণ করা হইয়াছিল, উহাই সকল সংকটের মূল। গত বৎসরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক জনমত জরিপে দেখা গিয়াছে, পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান চায় প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ। বিরোধী দল-মত দমনে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা পুলিশ সদস্যদিগের শাস্তিও দাবি করিয়াছে মানুষ। ‘গায়েবি’ মামলার অবসান চান সকলেই। একই সঙ্গে পুলিশের দুর্নীতি বন্ধও এখনকার জনদাবি। মানুষের সেই মতামতের প্রতিফলনরূপেও পুলিশকে পেশাদার বাহিনীরূপে দাঁড় করানো জরুরি। অন্যথায় সম্পূরক কিংবা সহযোগী সকল পদক্ষেপই গরল ভেল হইতে বাধ্য। উদ্ভিদের মূল কর্তন করিয়া অগ্রভাগে জলসিঞ্চনে ফল পাইবার সম্ভাবনা শূন্যই বটে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।